গত বিধানসভা নির্বাচনে আসন বণ্টনের পর জোট সঙ্গীর কাছ থেকে সাকুল্যে একটি মাত্র আসন পেয়েছিল তারা। তার জোরেই নদিয়া জেলায় কংগ্রেস ‘শক্তি সঞ্চয়ের’ চেষ্টা করেছিল এত দিন। তবে নাম মাত্র সেই আসন নিয়ে কর্মীদের মনোবল যে ‘চাঙ্গা’ করা যায়নি নেতারাই তা কবুল করেছেন। আর ফল, পঞ্চায়েত নির্বাচনে নদিয়ায় কংগ্রেসে ‘ভরাডুবি’।
১৮৭টি গ্রাম পঞ্চায়েতের ফল বেরোলে দেখা গিয়েছে, সাকুল্যে ১২টি পঞ্চায়েত নিয়েই তাদের দৌড় শেষ হয়ে গিয়েছে। গত নির্বাচনে যেখানে তাদের আসন সংখ্যা ছিল ৫৩। দলের নদিয়া জেলা সভাপতি শঙ্কর সিংহ তাই অকপটেই বলছেন, “নমোঃ নমোঃ করে ওই একটি বিধানসভা আসন নিয়ে কি আর ভাল ফল আশা করা যায়। কর্মীদের চাঙ্গা করা যায়নি। প্রচারেও তাঁরা তেমন সাড়া ফেলতে পারেননি।” |
জেলা জুড়ে গ্রাম পঞায়েতের ৩২৪৬টি আসনের মধ্যে মাত্র ১৮৯১টি আসনে প্রার্থী দিতে পেরেছিল কংগ্রেস। তারই ফল, সোমবার মিলেছে। ফল বেরোলে দেখা গিয়েছে, জেলায় যে জায়গাগুলি তাদের শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত ছিল সেখানেও প্রভাব ধরে রাখতে পারেনি তারা। ভোট ব্যাঙ্কে ধস নামার পিছনে জেলার একমাত্র বিধায়ক অজয় দে’র কথায় মিলেছে অন্তর্কলহের ইঙ্গিত। তিনি বলেন, “আসলে জেলায় কংগ্রেস নেতৃত্বের অভাব বোধ করেছে বরাবর। ফলে যে জায়গাগুলি কংগ্রেসের চেনা ঘাঁটি বলে পরিচিত ছিল সেখানেও হেরে গিয়েছি আমরা।”
একদা শঙ্করবাবুর ঘনিষ্ট অজয় দে’র সঙ্গে সাম্প্রতিক কালে জেলা সভাপতির সম্পর্ক যে বেশ ‘মধুর’ তা রাজনৈতিক মহলের বাইরেও অজানা নয়। অজয়বাবুর ‘নেতৃত্বের অভাব’-এর ইঙ্গিতে যে শঙ্করবাবুকেই তা বলাই বাহুল্য। শঙ্করবাবু অবশ্য এর পাল্টা বলছেন, “আমি দলের জন্য কতটা করতে পারি তার জন্য নতুন করে পরীক্ষা দেওয়ার দরকার নেই। কুপার্স পুরসভা দখলই তার প্রমাণ। পঞ্চায়েতের নির্বাচনের আগেও এমন কোনও জায়গা নেই যেখানে আমি প্রচারে যাইনি।”
রাজনৈতিক কারবারিদের ব্যাখ্যা, কংগ্রেসের এই দলীয় কোন্দলই, কংগ্রেসের ভরাডুবির কারণ। যার সুযোগ নিয়ে জেলায় কিঞ্চিৎ শক্তি বাড়িয়েছে বামফ্রন্ট। ইতিমধ্যেই ঘোষিত আসনের ৫৩টি তারা পেয়ে গিয়েছে। ত্রিশঙ্কু ৪২টি আসনের মধ্যেও বেশ কয়েকটি যে বকলমে বামেদেরই দখলে থাকবে তাও একরকম নিশ্চিত। গত পঞ্চায়েতে তাদের দখলে ছিল ৪৪টি আসন। পরে অবশ্য আরও কয়েকটি ত্রিশঙ্কু ও নির্দল আসনও গিয়েছিল বামেদের দখলে। জেলা সিপিএমের দাবী, এ বার সংখ্যাটা ৬০-এর কাছাকাছি যাবে। ত্রিশঙ্কু বা টাই পঞ্চায়েতের মধ্যে অন্তত ৩৫ টি তাঁরা পাবেন বলে জেলা সিপিএম সূত্রে জানা গিয়েছে। সিপিএমের নদিয়া জেলা সম্পাদক সুমিত দে বলেন, ‘‘ওই পঞ্চায়েতগুলিতে যে শাসক দল জেতেনি তা স্পষ্ট। আমাদের আশা ওই ত্রিশঙ্কু পঞ্চায়েতের অধিকাংশই আমাদের দখলে আসবে।’’ বামেদের এই অভাবনীয় সাফল্যের কারণ? সুমিতবাবু জানান, তৃণমূলের অন্তর্কলহের পাশাপাসি, শাসক দলের ‘গুন্ডারাজে’ মানুষ ত্রস্ত। তিনি বলেন, “প্রশাসন যদি নিরপেক্ষভাবে কাজ করত, যদি তৃণমূলের চাপা সন্ত্রাস না থাকত তাহলে তাদের জনবিচ্ছিন্নতা আরও স্পষ্ট হত।’’ |
এই প্রশ্নেই শাঙ্করবাবু বলেন, “ওরা যে সন্ত্রাসের পুরনো চেহারাই নতুন মোড়কে ফিরিয়ে আনবে তা জানতাম বলেই প্রথম থেকেই জোটের বিরোধীতা করেছি।’ তিনি জানান, মানুষের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার আশঙ্কাতেই তিনি জোট চাননি। ২০০৯ লোকসভা এবং ২০১১-র বিধানসভা ভোটের সময়ে তাই স্পষ্টই জোট-বিরোধীতা করে হাইকমান্ডের নির্দেশ এক রকম উড়িয়ে দিয়ে নিজেই উদ্যোগী হয়ে জেলার বিভিন্ন জায়গায় নির্দল প্রার্থী দিয়েছিলেন শঙ্কর। এই তৃণমূল বিরোধীতা আঁকড়েই জেলায় কংগ্রেসের জমি তৈরির চেষ্টা করেছিলেন তিনি। তবে রানাঘাট ও লাগোয়া এলাকার বাইরে তার ছাপ যে তেমন স্পষ্ট নয়, এই ফলই তার প্রমাণ। সংগঠনের অভাবে দলের পুরনো কর্মীদের অনেকেই ইতিমধ্যে পা বাড়িয়েছেন শাসক তৃণমূলের দিকে। সংগঠন ধরে রাখা যায়নি। অধিকাংশ জায়গায় প্রার্থী দেওয়া যায়নি। জেলা কংগ্রেসর এক নেতার কথায়, “এই অবস্থায় এক ডজন পঞ্চায়েতই ঢের!”
জেলায় তৃণমূল অবশ্য তাদের পুরনো শক্তিই ধরে রেখেছে। গত পঞ্চায়েতে তাদের দখলে ছিল ৭০টি আসন। এ বার ইতিমধ্যেই তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৩। গত দু-বছরে কংগ্রেসের বহু কর্মী নেতা ইতিমধ্যেই শাসক দলে যোগ দিয়েছেন। ভোটের আগে দলনেত্রীর দু-দুবারের সফরে মমতা-ম্যাজিকও কাজ করেছে। তৃণমূলের জেলা সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্ত বলেন, ‘‘গতবার ৭০ টির মতো গ্রাম পঞ্চায়েত আমাদের দখলে ছিল। এবার সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছএ ৭৩। যে ৪৮ টি গ্রাম পঞ্চায়েতে অস্পষ্টতা রয়েছে তারমধ্যে সত্তরভাগ গ্রামপঞ্চায়েতে আমাদের আসন সংখ্যা বেশি। সবমিলিয়ে আমরা প্রায় ১০০ টিরও বেশি গ্রাম পঞ্চায়েত দখল করব।” তার কথায় স্পষ্ট স্বস্তি। |
কল্লোল প্রামাণিক ও সুদীপ ভট্টাচার্যের তোলা ছবি। |