বিয়ে ঠেকিয়ে লেখাপড়া চালাতে গিয়ে আগুনে পুড়তে হয়েছিল তাকে। টানা দু’মাস কলকাতার হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করার পরে এ বার ছাড়া পাচ্ছে হুগলির খানাকুলের রৌশেনারা খাতুন। কিন্তু কোথায় যাবে সে, কারা চালাবেন তার চিকিৎসা ও লেখাপড়ার খরচ, সেই সব প্রশ্ন আপাতত তাড়া করে বেড়াচ্ছে এই কিশোরীকে।
চিকিৎসকেরা জানিয়ে দিয়েছেন, প্রাণ বাঁচানোর জন্য যা যা করা দরকার, সেটুকু তাঁরা করেছেন। দু’-দু’টি বড় অস্ত্রোপচারও হয়েছে। কিন্তু এখনও ঝলসে যাওয়া শরীরটার নানা চিকিৎসা বাকি। মুখের বিকৃতি দূর করতে বাকি কসমেটিক সার্জারিও। কী ভাবে হবে তার সংস্থান? তার চেয়েও বড় কথা, লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার যে অদম্য জেদ থেকে নিজের জীবন বাজি রাখতে হয়েছিল তাকে, সেই লেখাপড়ার খরচই বা জুটবে কী ভাবে?
পাড়ার লোকেরা রৌশেনারার ভবিষ্যৎ নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনায় বসেছিলেন। কিন্তু সেখান থেকে কোনও সমাধানসূত্রই বেরিয়ে আসেনি। প্রতিবেশী মহম্মদ সালেকিন বলেন, “এখানে সকলেই তো দিন আনা দিন খাওয়া পরিবার। দিনের পর দিন খরচ চালানো কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। মেয়েটার খাওয়া-পরার দায়িত্ব কে নেবে, সেটা নিয়েই তো আমরা দুশ্চিন্তায় রয়েছি।”
পুরুলিয়ার বীণা কালিন্দী, সঙ্গীতা বাউরিরা বিয়ে ঠেকাতে সরাসরি থানায় পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু খানাকুলের রৌশেনারা সেই সুযোগটুকুও পায়নি। জোর করে বাড়ির লোকেরা তার বিয়ের ঠিক করেছিলেন। সে রাজি হয়নি। তার পরে গত ৯ মে বাড়ির লোকজনই তার গায়ে আগুন লাগিয়ে দেয় বলে অভিযোগ। ৬০ শতাংশ দগ্ধ অবস্থায় তাকে প্রথমে আরামবাগ মহকুমা হাসপাতাল ও পরে কলকাতার এসএসকেএমে ভর্তি করা হয়। এই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ তার বাবা, সৎ মা এবং সৎ দিদিমাকে গ্রেফতার করে। |
বাবা আর সৎ মা এখন জেলে। বাড়িতে এখন শুধু তিনটে ছোট ভাই। তাদের খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করতেই কাকা নুরুল ইসলামের জেরবার অবস্থা। তাঁর নুন আনতে পান্তা ফুরনো সংসারে বাড়তি আর একটা পেটের ভাত জোগাড় করা বড় কঠিন কাজ। রৌশেনারার এক পিসি তাঁকে দিন কয়েক নিজের বাড়িতে রাখতে রাজি হয়েছেন। কিন্তু তার পর? রৌশেনারা বলে, “এখনও কিছু বুঝতে পারছি না। শুধু নিজেকে বলছি, আমাকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে।”
বার্ন ওয়ার্ডে একটানা কিছু দিন থাকলেই গভীর অবসাদে ভুগতে থাকেন রোগীরা। নিজের শরীরের জ্বালা-যন্ত্রণা, ওয়ার্ডের অন্য রোগীদের আর্তনাদ, পোড়া ঘায়ের দম আটকানো গন্ধ, সব মিলিয়ে জীবন থেকে মুখ ফেরানোর একটা প্রবণতা কাজ করতে থাকে। রৌশেনারার ক্ষেত্রেও এমনটাই শুরু হয়েছিল। চিকিৎসক অরিন্দম সরকার বললেন, “হতাশা আর অবসাদ এমনই তীব্র ছিল যে সামান্য হাঁটাচলা কিংবা হাত-পা নাড়ানোর চেষ্টাটুকুও ও করত না। আমরা ওকে উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা করেছি। বলেছি, ‘তোমার মতো মেয়ে ভেঙে পড়লে অন্যরা সাহস পাবে কোথা থেকে?’ আস্তে আস্তে আমাদের কথায় কাজ হয়েছে।” রৌশেনারার ফ্রি বেডে চিকিৎসা হলেও পোড়ার ক্ষত সারাতে এখনও যথেষ্ট টাকার প্রয়োজন। রৌশেনারার স্কুলশিক্ষক এবং সহপাঠীদের অনেকে এগিয়ে এসেছেন তাকে সাহায্য করতে। পাশে দাঁড়িয়েছে কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও।
লেখাপড়ার চেয়েও তার ঝলসানো চেহারাটা কী ভাবে সারবে, তাই নিয়ে এখন বেশি চিন্তা করছেন প্রতিবেশীরা। এক জনের কথায়, “এখন না-হয় ও বিয়ে করতে চায় না, কিন্তু আর কয়েক বছর পরে তো বিয়ের কথাটা ভাবতে হবে। তার জন্য ওর চেহারাটা তো খানিকটা সারাতে হবে।”
এ সব প্রসঙ্গ উঠলে কঠিন হয়ে যায় ১৫ বছরের মেয়েটির মুখ। বার্ন ওয়ার্ডের আধো অন্ধকার ঘরে, কোনওমতে ক্ষতের ব্যান্ডেজ সামলে রৌশেনারা নিজের হাত দুটো সামনে মেলে ধরে। তার পরে বলে, “শুধু এই হাত দু’টো যদি ঠিক থাকে, আমি লড়তে পারব। কয়েকটা মাস নষ্ট হল। পরের বছর মাধ্যমিক। আপাতত সেটাই লক্ষ্য।”
|