বিয়েতে নারাজ, তাই মেয়ের গায়ে আগুন
ত কম বয়সে বিয়ে করব না, পড়ব। আগুনে পুড়েই পড়তে চাওয়ার এই আগুনে-জেদের মাসুল দিল ১৫ বছরের মেয়েটি।
এর আগে বাড়ির অমতে বিয়ে করার জন্য সন্তানের উপরে নেমে এসেছে পরিবারের কোপ। বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়িতে বউয়ের গায়ে আগুন দেওয়া হয়েছে বারবার। এ বার বিয়ে করতে না চাওয়ার জন্য নিজের মেয়ের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে বাবা-র বিরুদ্ধেই। সঙ্গে অভিযুক্ত সৎমা এবং সৎদিদিমাও।
রৌশনারা খাতুন
পুরুলিয়ার বীণা কালিন্দি, সঙ্গীতা বাউরি, আফসানা খাতুন বা দক্ষিণ ২৪ পরগনার হাবিবা খাতুন যে লড়াইটা লড়ে সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে এসেছে, সেই একই লড়াই ছিল ১৫ বছরের রৌশনারা খাতুনের। বৃহস্পতিবার ভোরে খানাকুলের কাঁটাপুকুর গ্রামে ঘুমন্ত রৌশনারাকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করল তারই পরিবার। ৯০ শতাংশ দগ্ধ অবস্থায় আরামবাগ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে মেয়েটি। অভিযুক্তদের গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
পুরুলিয়ার বীণা কালিন্দি বা সঙ্গীতা বাউরি পাশে পেয়েছিল শিক্ষক-সহপাঠী-প্রশাসনকে। বন্ধ করা গিয়েছিল তাদের বিয়ে। গত বছর দক্ষিণ ২৪ পরগনার হাবিবা খাতুন সরাসরি থানায় চলে গিয়েছিল। তারও বিয়ে বন্ধ হয়। কিন্তু রৌশনারা পুলিশ-প্রশাসন অবধি পৌঁছতে পারেনি। স্কুল কর্তৃপক্ষও জানতেন না তার বিয়ের চেষ্টা হচ্ছিল। রৌশনারার স্কুল, পাতুল গণেশবাজার উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গৌতম যশ বলেন, “এর আগে এক বার আমাদের নবম শ্রেণির এক ছাত্রীর বিয়ে ঠিক হয়েছিল। জানতে পেরে প্রতিবাদ করেছিলাম। এ বার কিছুই জানতে পারিনি। রৌশনারার পড়াশোনায় খুব আগ্রহ রয়েছে।”
রৌশনারার সহপাঠী নেহা খাতুনও একই কথা জানিয়েছে। সে বলেছে, “রৌশনারা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর কথা খুব বলত। বলত, সৎমা আর বাবা জোর করে ওর বিয়ে দিচ্ছে। ওর এই অবস্থা মেনে নিতে পারছি না।” ঘটনাটা শুনে বীণা আর সঙ্গীতা দু’জনেই বলছে, “কিছুতেই মানতে পারছি না। রৌশনারা যখন পড়াশোনা করতে চাইছিল, ওকে সেই সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল। ও কখন বিয়ে করবে, সে ব্যাপারে ওর মতামতই চূড়ান্ত।” পড়তে চেয়ে রৌশনারা নিজের পরিবারের হাতে যে ভাবে নির্যাতিত হল, সেটা একটা ভয়াবহ দৃষ্টান্ত বলে মনে করছেন নারী আন্দোলনের কর্মী শাশ্বতী ঘোষ।
রৌশনারার বাবা পেশায় কৃষক, শেখ রফিকুল ইসলাম নিজে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। রৌশনারা এখন দশম শ্রেণিতে পড়ছিল। দিন দশেক আগে আরামবাগের ধামসা গ্রামে তার বিয়ে ঠিক হয়। আজ, শুক্রবার ছিল ‘লগন’ (আশীর্বাদ)। বিয়ে হওয়ার কথা ছিল আগামী রবিবার। এ দিন ভোর ৫টা নাগাদ রৌশনারার চিৎকার শুনে জ্যাঠা-কাকা-প্রতিবেশীরা গিয়ে দেখেন গায়ে আগুন জ্বলছে, রৌশনারা ঘরে ছোটাছুটি করছে। আগুন নিভিয়ে রৌশনারাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতাল সূত্রে খবর, তার শরীরের ৯০ শতাংশ পুড়ে গিয়েছে।
রৌশনারার জ্যাঠা শেখ সালাউদ্দিন ইসলাম পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগে জানিয়েছেন, বিয়েতে আপত্তি করাতেই সৎ মা দুলেহারা বেগম, সৎদিদিমা আসিয়া বেগম এবং রৌশনারার বাবা শেখ রফিকুল কেরোসিন ঢেলে মেয়েটিকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করেন। এ দিন ঘটনার পরে প্রতিবেশীরাই দুলেহারাকে পুলিশের হাতে তুলে দেন। আরামবাগ হাসপাতাল চত্বর থেকে বাকি দু’জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। রফিকুল অবশ্য তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ মানেননি। তাঁর দাবি, “মেয়ে প্রথমে বিয়েতে রাজি না হলেও পরে রাজি হয়েছিল। ওকে কেন পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করব? মানসিক অবসাদে ও আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল।”
কিন্তু রৌশনারার কাকিমা সাবিনা বেগম জানাচ্ছেন, বুধবার রাত অবধি জেগে পড়াশোনাই করছিল রৌশনারা। অবসাদের কোনও লক্ষণ ছিল না। সাবিনা বলেন, “মেয়েটা বুধবার রাতে আমার ঘরে শুয়েছিল। ভোরে আমি পুকুরে বাসন ধুতে চলে যাই। রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করছিল বলে ওকে ঘুম থেকে ডাকিনি। ফিরে দেখি ওই কাণ্ড!” রৌশনারার দাদা আর জ্যাঠা পুলিশকে জানিয়েছেন, বেশ কিছু দিন ধরেই বিয়ে করবে না বলে প্রতিবাদ জানাচ্ছিল রৌশনারা। শেখ সালাউদ্দিনের কথায়, “মেয়েটা মাধ্যমিকের জন্য তৈরি হচ্ছিল। বিয়েতে আপত্তি জানানোয় সৎ মা ওকে মারধর করত।” রৌশনারার বড়দা মিরাজুলেরও অভিযোগ, “সৎ মায়ের জন্যই বোনের এই অবস্থা। বাড়ির অত্যাচারের জন্য আমিও অষ্টম শ্রেণির বেশি পড়তে পারিনি।” সৎ মা-র অত্যাচারের কথা রৌশনারার বন্ধুরাও জানত। নেহা বলেছে, “পরীক্ষার সময়ে বই লুকিয়ে রাখত ওর সৎ মা। মারত। খেতে দিত না।”
রৌশনারার জ্যাঠার এখন একটাই আক্ষেপ। “মেয়েটার উপরে অত্যাচার দেখে কয়েক দিন আগে ঠিক করেছিলাম, প্রতিবেশীদের নিয়ে থানায় যাব। পরে মনে হল, বিয়ে হলে মেয়েটা সৎমা-র হাত থেকে মুক্তি পাবে। এখন নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে।” একই ভাবে হা-হুতাশ করছেন আবু নাসের, শেখ কাজল, শেখ নয়ন-রা। ওঁরা সকলেই রৌশনারার প্রতিবেশী। পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাওয়া পাশের বাড়ির মেয়েটার জন্য এই ভয়ঙ্কর পরিণতি অপেক্ষা করছে, ভাবতে পারেননি ওঁরা।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.