চাপের মুখে বয়ান, বলছে পরিবার
বৃদ্ধের মৃত্যু, অনুব্রতর সঙ্গে কাঠগড়ায় পুলিশও
লপেটে দু’টো গুলি নিয়ে রবিবার রাত থেকে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে মঙ্গলবার ভোরে হার মারলেন সাগরচন্দ্র ঘোষ। বাঁধনবগ্রামের বাসিন্দা বিক্ষুব্ধ তৃণমূল নেতা হৃদয় ঘোষের বাবা।
এই ঘটনায় এ দিন একাদশ শ্রেণির এক ছাত্র-সহ চার জনকে ধরেছে পুলিশ। একাদশ শ্রেণির ছাত্রটি হৃদয়বাবুর ভাগ্নে। অন্যরা তাঁর মেয়ের গৃহশিক্ষক মানস রায়, মানসবাবুর বাবা নেপাল রায় ও তাঁর ভাই নবকৃষ্ণ রায়। সিউড়ি আদালতে তোলা হলে ধৃতদের ১৪ দিন জেল হেফাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।
হৃদয়বাবুর অবশ্য অভিযোগ, ধৃতেরা কেউই তাঁর বাবার খুনের সঙ্গে জড়িত নন। সাজানো মামলায় পুলিশ তাঁদের ধরেছে। কিন্তু তাঁর বাড়ির লোকেরা তো এই ক’জনের বিরুদ্ধেই পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন! হৃদয়বাবুর স্ত্রী শিবানী ঘোষের দাবি, “বলে দেওয়া বয়ান অনুযায়ী অভিযোগ না-লিখলে পুলিশ শ্বশুরমশাইকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে দেবে না বলেছিল। পাড়ুইয়ের আইসি দৃজরাজ সাহানা নিজে আমাদের উপর চাপ দেন। যাদের নামে অভিযোগ লেখানো হয়, তারা ঘটনায় জড়িত নয়। কিন্তু চাপের মুখে ওই নামগুলো লেখা ছাড়া উপায় ছিল না।”
সাগরবাবুর মৃতদেহ ঘিরে শোকার্ত পরিবার। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী।
আর সাগরবাবুর স্ত্রী সরস্বতী ঘোষ বলেন, “সোমবার সকালে কয়েক জন পড়শি মহিলাকে নিয়ে পাড়ুই থানায় নতুন করে লিখিত অভিযোগ জানাতে যাই। কিন্তু দৃজরাজ সাহানা অভিযোগ জমা না-নিয়ে আমাদের তাড়িয়ে দেন।” দৃজরাজবাবুকে এই অভিযোগ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি কোনও মন্তব্য করতে চাননি। কিছু বলতে চাননি পুলিশ সুপার মুরলীধর শর্মাও।
হৃদয়বাবুর পরিবারের অভিযোগের তির বীরভূমের তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের দিকে। এ দিন বাবার দেহ নিয়ে বর্ধমান থেকে বাড়িতে ফেরার পরে হৃদয়বাবু বলেন, “খুনের ঘটনায় অনুব্রত মণ্ডলের সরাসরি মদত আছে। তাই পুলিশ আসল লোককে ধরছে না।”
অনুব্রতবাবু সোমবার বলেছিলেন, “এটা পারিবারিক বিবাদ। বাবা-ছেলের বনিবনা হতো না। হৃদয়ই ওর বাবাকে মারতে চেয়েছিল বলে শুনেছি!” এ দিন তিনি বলেন, “পুলিশ যাদের ধরেছে, তারা সাগর ঘোষ খুনে জড়িত নয়। আমি বা তৃণমূলের কেউও জড়িত নয়।” তৃণমূল নেতা মুকুল রায়েরও বক্তব্য, “নির্বাচন বা রাজনীতির সঙ্গে এই মৃত্যুর যোগ নেই। সম্পূর্ণ অন্য কারণে উনি মারা গিয়েছেন। অনুব্রতর সঙ্গীরা এ কাজ করেছে, সাগরবাবুর ছেলে এমন দাবি করছেন না।”
তৃণমূলের কসবা অঞ্চল সভাপতি (যেখান থেকে ভোটে দাঁড়িয়েছেন হৃদয়বাবু) নিখিল পাল, চেয়ারম্যান নারায়ণ ভাণ্ডারী-সহ স্থানীয় নেতৃত্বের একটা বড় অংশ কিন্তু অনুব্রতবাবুর দিকেই অভিযোগের আঙুল তুলছেন। এঁরা সকলেই নানুরের তৃণমূল বিধায়ক গদাধর হাজরা-গোষ্ঠীর অনুগত, অনুব্রত-গোষ্ঠীর বিরোধী বলে পরিচিত।
কসবা এলাকায় নির্দল প্রার্থীদের (যাঁদের অধিকাংশই বিক্ষুব্ধ তৃণমূল) উপরে হামলার সূত্রপাত ক’দিন আগে অনুব্রতবাবুর বক্তৃতার পর থেকেই। সে দিন দলীয় কর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন, কোনও নির্দল প্রার্থী হুমকি দিলে তাঁর বাড়ি চড়াও হতে। পুলিশ কোনও নির্দল প্রার্থীকে সমর্থন করলে তাদের উপরেও বোমা মারার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি।
এর পরেই ওই এলাকায় একের পর এক নির্দল প্রার্থীর বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে। যা চূড়ান্ত আকার নেয় রবিবার রাতে। হৃদয়বাবুর বাড়িতে চড়াও হয়ে সাগরবাবুর পেটে দু’টি এবং হাতে একটি গুলি করে দুষ্কৃতীরা। নিখিলবাবুরা বলছেন, “এলাকায় জনসমর্থন হারিয়ে অনুব্রত-গোষ্ঠী জোর করে ভোট করতে চাইছিল। এলাকার দখল নিতেই জেলা সভাপতি সে দিন প্রকাশ্যে তাঁর অনুগামীদের বিরোধীদের উপরে চড়াও হওয়ার নির্দেশ দেন। আমরা মনে করি, তার জেরেই এই খুন।” অঞ্চল কমিটির অফিসে অর্ধনমিত দলীয় পতাকার তলায় ‘আদি তৃণমূলী’দের উপরে হামলার বিরুদ্ধে একজোট হওয়ার শপথ নিয়েছেন এই বিক্ষুব্ধদের অনেকে। দাবি তুলেছেন অনুব্রত মণ্ডলকে গ্রেফতার করার। বলেছেন, তেমন বুঝলে হৃদয়বাবুর নেতৃত্বে মুখ্যমন্ত্রী, এমনকী কামদুনির মতো রাষ্ট্রপতির কাছেও যাবেন।
ছেলে হৃদয় ঘোষ। ছবি: উদিত সিংহ।
অনুব্রতবাবুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন? মঙ্গলবার এই প্রশ্নের জবাবে এসপি বলেন, “কোথা থেকে ব্যবস্থা নেব! কেউ কোনও অভিযোগ করেননি। এমনকী, রাজ্য নির্বাচন কমিশনও নয়। উনি (অনুব্রত) রামপুরহাটে উস্কানিমূলক মন্তব্য করায় কমিশন অভিযোগ করেছিল। ওই ঘটনায় অনুব্রতবাবুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।”
যদিও ওই ঘটনাতেও ঠিক কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা খোলসা করেননি এসপি। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের কাছেও মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনও খবর নেই বলে জানিয়ছেন কমিশনের সচিব তাপস রায়। তিনি জানান, অনুব্রতবাবুর বিরুদ্ধে কসবার নির্বাচনী জনসভায় প্ররোচনামূলক বক্তব্য পেশ করার জন্য পাড়ুই থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন বীরভূমের জেলাশাসক। তবে ওই বক্তৃতার পরে এলাকায় ঘটে যাওয়া হিংসাত্মক ঘটনার উল্লেখ জেলা প্রশাসনের দায়ের করা অভিযোগে নেই। কমিশনের নির্দেশ জেলা প্রশাসন সময়মতো পালন না-করলেও কমিশন কেন নিজে থেকে অনুব্রতবাবুর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাচ্ছে না, সে বিষয়টি স্পষ্ট করেননি তাপসবাবু।
বীরভূমের জেলাশাসক জগদীশপ্রসাদ মিনা ফোন ধরেননি। তবে জেলা প্রশাসনের এক শীর্ষ কর্তার ক্ষোভ, “প্রকাশ্যে অমন হুমকি দেওয়ার পরেও যে নেতা সাবলীল ভাবে নির্বাচনী প্রচারে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গে থেকেছেন, এমনকী, যে নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতরকেও দু’বার ভাবতে হচ্ছে, তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে আমরা কি বলির বকরা হব!”
অনুব্রতবাবুর বিরুদ্ধে প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তায় ক্ষুব্ধ বিরোধীরা। অনুব্রতবাবু এবং কংগ্রেস নেতাকে খুনের হুমকি দেওয়া লাভপুরের তৃণমূল বিধায়ক মনিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল দাবি করে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু বলেন, “এঁদের বিরুদ্ধে যদি ব্যবস্থা নেওয়া হতো, তা হলে তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীদের মধ্যে এই ধরনের কথা বলার প্রতিযোগিতা স্তিমিত হতো।”
মুখ্যমন্ত্রী এখনও অনুব্রতবাবুর বিরুদ্ধে কোনও কথা বলেননি। তৃণমূল নেতাদের অনেকের মতে, জেলা রাজনীতিতে অনুব্রতবাবুর মতো সংগঠক তৃণমূলের হাতে আর নেই। সেই কারণেই তাঁর ব্যাপারে রক্ষণাত্মক তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব। মুকুলবাবু এ দিন বলেন, “জ্যোতি বসু টি এন শেষনকে কুকুর বলেও মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। বিমান বসুু বিচারপতি অমিতাভ লালাকে ‘লালা, বাংলা ছেড়ে পালা’ বলেও দলের দায়িত্বে থেকেছেন। ফলে, এ সব ব্যাপারে রাজনৈতিক অঙ্ক আছে। সব দেখেশুনে তার পরে কথা বলব।” শীর্ষ নেতৃত্বের এই মনোভাবের জেরে অনুব্রতবাবুর বিরুদ্ধে পুরোদস্তুর মুখ খোলার সাহস পাচ্ছে না জেলা রাজনীতিতে তাঁর বিরোধী গোষ্ঠীও। সাংসদ শতাব্দী রায় যেমন বলেছেন, “কে, কোথায়, কী বলছে, আমার তাকে গুরুত্ব দেওয়াটা ঠিক হবে না।”
কিন্তু সাগরবাবুর স্ত্রী সরস্বতীদেবীর প্রশ্ন, “অনুব্রত মণ্ডলের হুমকির পরেই এই কাণ্ড হল। এর পরেও জেলা সভাপতি তাঁর অপরাধকে কি কোনও ভাবে আড়াল করতে পারেন?”
‘পারেন’, বলছেন এলাকাবাসীরই একাংশ। তাঁদের সংযোজন, “পুলিশ-প্রশাসন কী করবে। সব সুতো তো এক জায়গাতেই বাঁধা।”

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.