সাগরের জমিতেই তৃণমূলের অফিস
কামদুনির মতোই আন্দোলন করতে চায় বাঁধনবগ্রাম
তাঁর দেওয়া জমিতেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল শাসক দলের পার্টি অফিস। মঙ্গলবার বিকেলে সেই অফিসেই নিহত সাগরচন্দ্র ঘোষের মরদেহের এনে মাথা নিচু করে দাঁড়ালেন এলাকার হাজার মানুষ। দলের বিক্ষুব্ধ অংশ একযোগে শপথ নিলেন, নিজেদের আন্দোলন জিইয়ে রাখার। কামদুনি, খোরজুনার মতো বোলপুরের কসবাতেও ধীরে ধীরে দানা বাঁধছে স্থানীয় মানুষের আন্দোলন। যার কেন্দ্রে রয়েছে এক নিরীহ বৃদ্ধের খুন হওয়া।
কসবায় পার্টি অফিস উদ্বোধনের ফলক।
কসবা গ্রাম পঞ্চায়েতের নির্দল প্রার্থী (বিক্ষুব্ধ তৃণমূল) হৃদয় ঘোষের বাবা সাগরবাবুর দান করা জমিতেই কসবায় তৈরি হয়েছিল তৃণমূলের পার্টি অফিস। গত বছর ২৪ জুন বীরভূম জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল ও তাঁর ঘনিষ্ঠ, রাজ্যের মৎস্যমন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহের উপস্থিতিতে সেই কসবা অঞ্চল অফিস উদ্বোধন করেছিলেন শিল্পমন্ত্রী তথা তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়। অথচ, আজ সাগরবাবুকে সেই পার্টি অফিসে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আসা ভিড়ে ছিলেন না কোনও পুরনো মুখই। রাজ্য স্তর তো দূর, ছিলেন না জেলা স্তরের কোনও শীর্ষ তৃণমূল নেতাই। বড় মাপের নেতা বলতে বোলপুর ব্লক তৃণমূল সভাপতি সমীর রায় এবং দলের জেলা সহ-সভাপতি নিবিড় বন্দ্যোপাধ্যায়। আর ছিলেন তৃণমূলের কসবা অঞ্চল কমিটির সভাপতি নিখিল পাল, চেয়ারম্যান নারায়ণ ভাণ্ডারী। এঁরা প্রত্যেকেই অনুব্রত-বিরোধী হিসাবে পরিচিত।
দলের এ হেন নির্লিপ্ততা, নিষ্পৃহতায় তাই ক্ষোভে ফুটছে পাড়ুই থানার বাঁধনবগ্রাম। এলাকার নির্বিবাদী মানুষ সাগর ঘোষকে রবিবার রাতে দুষ্কৃতীরা বাড়িতে ঢুকে গুলি করে মেরেছে তাঁকে। অভিযোগের তির, অনুব্রত-গোষ্ঠীর লোকজনের দিকে। বছর খানেক আগেই মাটির বাড়ি ছেড়ে বাঁধনবগ্রামের নতুন পাকা দোতলা বাড়িতে উঠেছিলেন স্থানীয় গাঁধী বিদ্যাপীঠের অবসরপ্রাপ্ত চতুর্থ শ্রেণির কর্মী সাগরবাবু। হাঁপানি থাকায় খুব একটা বাড়ির বাইরে বেরতেন না। তবে, পরিচিত-অপরিচিত হোক, কেউ মারা গিয়েছে শুনলেই শেষকৃত্যে সামিল হতেন। এমন এক জন মানুষ খুন হয়েছেন, এই খবরটাই মেনে নিতে পারছেন না গ্রামের মানুষ।
পাড়ুইয়ের কসবায় কেন্দ্রীয় বাহিনীর টহল।
হাতে একটি, তলপেটে দু’টি গুলি লেগেছিল সাগরবাবুর। মঙ্গলবার ভোরে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যান ওই বৃদ্ধ। সেই খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা গ্রামে। সাগরবাবুর বাড়িতে সকাল থেকেই ভিড় জমছিল। কসবা পঞ্চায়েতের অধীনে থাকা গোটা তিরিশেক গ্রামের লোকজন তো বটেই, এমনকী কাছের বোলপুর শহর থেকে প্রচুর মানুষ এসেছিলেন বাঁধনবগ্রামে। তাঁদের অনেকেই সাগরবাবুকে খুব কাছ থেকে চিনতেন। কেউ কেউ এসেছিলেন কৌতূহলেই। কিন্তু, পুলিশ-প্রশাসনের প্রতি সর্বগ্রাসী ক্ষোভ সবাইকে একসূত্রে গেঁথেছে। স্থানীয় মালা গ্রামের শমিত ঘোষ বলেই ফেললেন, “এমন কিছু হতে পারে, একটা আশঙ্কা তো ছিলই। তার পরেও আটকানো গেল না! কী করছিল পুলিশ!”
সেই ক্ষোভের আঁচ করেই অশান্তির আশঙ্কায় এ দিন গ্রামে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের মোতায়েন করা হয়েছিল। কোনও রকমে ভিড় ঠেলে গ্রিলের দরজা দিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢোকা গেল। রবিবার রাতে এই গ্রিলের দরজা খুলে বের হতেই দুষ্কৃতীরা সাগরবাবুকে গুলি করেছিল। ঘরের এককোণে পাথরের মতো বসে আছেন সাগরবাবুর স্ত্রী সরস্বতী ঘোষ। অনুব্রত-গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রার্থী হওয়ার পর থেকেই ছেলে হৃদয় ঘোষ ঘরছাড়া। স্বামীর মৃত্যু, ছেলেও কাছে নেইসব মিলিয়ে দিশাহারা সরস্বতীদেবী। জানলা দিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন হৃদয়ের স্ত্রী শিবানী। চোখে জল সাগরবাবুর দশ বছরের নাতনির মিনিরও।
কসবা তৃণমূল কার্যালয়ের সামনে গুলিতে নিহত সাগরচন্দ্র ঘোষকে
শেষ শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন স্থানীয় লোকজন ও বিক্ষুব্ধ তৃণমূলের কর্মী-নেতারা।
বিকেল তিনটের দিকে বর্ধমান থেকে অ্যাম্বুল্যান্সটা ঢুকতেই বাইরে ভিড় আছড়ে পড়ল ঘরে। সেখান থেকে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় তৃণমূলের কসবা অঞ্চল অফিসে। সেখানে অর্ধনমিত দলীয় পতাকার তলায় ‘আদি তৃণমূলী’দের উপরে হামলার বিরুদ্ধে একজোট হওয়ার শপথ নিলেন হৃদয়বাবুরা। সোচ্চার দাবি উঠল অনুব্রত মণ্ডলকে গ্রেফতার করার। এখানেই শেষ নয়। তৃণমূল নেতা নিবিড়বাবু বলেন, “কামদুনির মানুষ যে ভাবে আন্দোলন করেছেন, যে ভাবে মুখ্যমন্ত্রী-রাষ্ট্রপতির কাছে গিয়েছেন, আমরাও সেই পথে আমাদের আন্দোলন জিইয়ে রাখব।” তৃণমূলের জেলা কমিটির সদস্য বিদ্যুৎ চট্টোপাধ্যায়, ব্লক সভাপতি সমীরবাবুদের বক্তব্য, “ধাপার মাঠপুকুরে তৃণমূল কর্মী অধীর মাইতিকে খুনের ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছেন আমাদের দলেরই নেতা শম্ভুনাথ কাও। সাগরবাবুর খুনের ঘটনাতেও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে যুক্ত জেলা তৃণমূল সভাপতির অনুগামীরা। তাদের কেন পুলিশ আড়াল করছে? পুলিশ প্রকৃত দোষীদের না ধরলে আমাদের আন্দোলন চলবে।” আর কান্নায় ভেঙে পড়ে নিহতের ছেলে, নির্দল প্রার্থী হৃদয় বললেন, “আমি শুরু থেকেই তৃণমূল করছি। আজ সেই দল করার খেসারত আমাকে দিতে হল নিজের বাবাকে হারিয়ে!”
সন্ধ্যায় লাল সুরকির রাস্তা ধরে এলাকার মানুষ মিছিল করে সাগরবাবুর মরদেহ নিয়ে গেলেন শ্মশানে। লড়াই জিইয়ে রাখার শপথকে সামনে রেখে।

ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.