ছেলে ভোটে দাঁড়িয়েছে নির্দল প্রার্থী হয়ে। প্রতিদ্বন্দ্বী তৃণমূল কংগ্রেস। নিজের তলপেটে দু’-দু’টো গুলির ক্ষত নিয়ে সেই লড়াইয়ের মাসুল গুনছেন সাগরচন্দ্র ঘোষ। গুলি লেগেছে হাতেও। রবিবার রাতে নিজের বাড়িতে দুষ্কৃতীদের বন্দুকের গুলি লেগে লুটিয়ে পড়েন সাগরবাবু। সোমবার বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করেও পেটের গুলি বার করা যায়নি। মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন ওই বৃদ্ধ। |
এখানেই গুলিবিদ্ধ হন সাগরচন্দ্র ঘোষ। |
বাঁধনবগ্রামের বাসিন্দা সাগরবাবুর ছেলে হৃদয় ঘোষ নির্দল প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন পাড়ুইয়ের কসবা থেকে। ওই এলাকা ক’দিন ধরেই উত্তপ্ত। বিক্ষুব্ধ নির্দল প্রার্থীদের প্রতি তৃণমূলের বিদ্বেষ ক্রমশ তীব্র হয়েছে। খোদ বীরভূম জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল ক’দিন আগেই ওই এলাকায় জনসভা করে দলীয় কর্মীদের বলেছিলেন, কোনও নির্দল প্রার্থী হুমকি দিলে তাঁদের বাড়ি চড়াও হতে। এমনকী, পুলিশ সেই নির্দল প্রার্থীকে সমর্থন করলে তাদের বোমা মারার নির্দেশও দেন তিনি। তাঁর সেই বক্তৃতার পর ওই এলাকায় নির্দল প্রার্থীদের বাড়িতে পরপর আক্রমণ ঘটেছে।
সোমবার, ভোটের দিন সকালে সাগরবাবুর গুলিবিদ্ধ হওয়ার কথা জানাজানি হতেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন এলাকাবাসীর বড় অংশ। তাঁদের বক্তব্য, অনুব্রতবাবুর উস্কানিমূলক মন্তব্যের পর থেকেই হিংসার বিরাম নেই কসবা এলাকায়। নির্দল প্রার্থীদের (প্রায় সকলেই বিক্ষুব্ধ তৃণমূল) নানা ভাবে ভয় দেখানো হচ্ছে। অনুব্রতবাবুর হুমকির কয়েক ঘণ্টা পরেই হামলা হয়েছিল নির্দল প্রার্থী রবিলাল সরেনের বাড়িতে। শনিবার রাতেও নির্দল প্রার্থী অনিল কোঁড়ার বাড়িতে বোমাবাজি ও আগুন লাগানো হয়। দু’টি ক্ষেত্রেই অভিযোগ তৃণমূলের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে।
অনুব্রত-গোষ্ঠীর হুমকিতে মনোনয়ন জমা দেওয়ার পর থেকেই হৃদয়বাবু এলাকাছাড়া। এ দিন তিনি ভোটও দিতে পারেননি। হৃদয়বাবু এ দিন ফোনে বলেন, “ওরা আসলে আমাকেই খুন করতে এসেছিল। আমাকে না পেয়ে বাবাকে গুলি করে।” পুলিশেরও ধারণা, অন্ধকারে ঠাহর করতে না-পেরে সাগরবাবুকে গুলি করা হয়েছে। স্থানীয় উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত কর্মী সাগরচন্দ্র ঘোষের বাঁ হাতে একটি ও তলপেটে দু’টি গুলি লেগেছে।
এর আগে তৃণমূলের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী দাবি করেছিল, বিক্ষুব্ধরা নিজেরাই নিজেদের বাড়িতে আগুন লাগিয়েছেন, বোমাবাজি করেছেন। সাগরবাবুর গুলিবিদ্ধ হওয়ারও তেমনই ব্যাখ্যা মিলেছে। বোলপুরে তৃণমূলের কার্যালয়ে বসে এ দিন অনুব্রতবাবু বলেন, “এটা পারিবারিক বিবাদ। বাবা-ছেলের বনিবনা হতো না। হৃদয়ই ওর বাবাকে মারতে চেয়েছিল বলে শুনেছি! পুলিশ সব তদন্ত করে দেখুক।” যা শুনে বেজায় চটেছেন কসবা অঞ্চলের তৃণমূল সভাপতি নিখিল পাল এবং চেয়ারম্যান নারায়ণ ভাণ্ডারি। তাঁরা দু’জনেই অবশ্য এখন নির্দলদেরই সমর্থন করছেন। এই দুই নেতার দাবি, “মিথ্যা বলছেন অনুব্রত। বহিরাগত দুষ্কৃতী দিয়ে হৃদয় ঘোষকেই খুন করার ছক কষেছিল জেলা সভাপতির গোষ্ঠী!” |
নিজের বাড়িতে অনুব্রত মণ্ডল। সোমবার। |
গ্রামের পাকা রাস্তার কাছেই হৃদয়দের দোতলা পাকা বাড়ি। এ দিন সকালে গিয়ে দেখা গেল, বাড়ির দোরে মোতায়েন রাজ্য সশস্ত্র পুলিশ। হৃদয়ের মা সরস্বতী ঘোষ ও স্ত্রী শিবানীর মুখেচোখে তখনও আতঙ্ক। সরস্বতীদেবী বললেন, “আমরা বরাবরই তৃণমূল। আমার ছেলে এ বার তৃণমূলের টিকিটেই দাঁড়াতে চেয়েছিল। দলেরও সম্মতিও ছিল। হঠাৎ বোলপুরের নেতাদের কোপে ও বাদ গেল। তাই নির্দল হয়েই লড়ছিল। সেই আক্রোশেই হামলা হল!”
কী হয়েছিল রবিবার রাতে?
সরস্বতীদেবী জানান, রাত সওয়া ১১টা নাগাদ হঠাৎই দরজায় খটখট। ভিতরের বারান্দায় গ্রিলের গেটে তালা ছিল। কে ডাকছে দেখতে বারান্দায় গুলি নির্দল প্রার্থীর বাবাকে বেরিয়ে আসেন সাগরবাবু। পাঁচিল টপকে দুষ্কৃতীরা ভিতরে লুকিয়ে ছিল। গেটের কাছে আসতেই সাগরবাবুর পেটে গুলি করা হয়। সাগরবাবু কোনও মতে পাশের রান্নাঘরে ঢুকে পড়েন। সরস্বতীদেবীর কথায়, “কে যেন বলে ওঠে, ‘জানলা দিয়ে গুলি কর।’ এ বার গুলি আমার স্বামীর হাতে লাগে। উনি লুটিয়ে পড়েন। দেখি, কয়েক জন উঠোনে রাখা মই বেয়ে পাঁচিল টপকে পালাল।”
সাগরবাবুকে প্রথমে বোলপুর সিয়ান হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে বর্ধমান মেডিক্যাল। সেখানে অস্ত্রোপচারের পরে হাতের গুলি বের করা গেলেও পেটের গুলি বের করা সম্ভব হয়নি। হাসপাতাল সূত্রে বলা হয়েছে, সাগরবাবুর অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাঁর চিকিৎসার জন্য মেডিক্যাল বোর্ড বসানো হয়েছে। আপতত, তাঁকে আইসিসিইউতে রাখা হয়েছে। হৃদয় ও তাঁর ছেলে সুমন সাগরবাবুর সঙ্গেই রয়েছেন। সুমন বলেন, “বাবা লড়াই থেকে সরে না-দাঁড়ানোয় আমাদের মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। রবিবার রাতে হামলাকারীদের অনেকের গায়েই ছিল পুলিশের পোশাক।” পাড়ুই থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন সরস্বতীদেবী। পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ জনকে আটক করেছে।
সাগরবাবুর বাড়ির কাছেই ভোটকেন্দ্র। রবিবার রাতের হামলার আঁচ পড়েছে কসবা গ্রাম পঞ্চায়েতের সব বুথেই। ১২টি আসনের প্রতিটিতেই নির্দল বনাম অনুব্রতপন্থী তৃণমূলের লড়াই। এ দিন ভোটের সময়ে একাধিকবার এই কেন্দ্রে ঘুরেছেন জেলার নির্বাচনী পর্যবেক্ষক। টহল দিয়েছে কেন্দ্রীয় বাহিনী। কসবার ৩ নম্বর বুথের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন নির্দল প্রার্থী মঞ্জিলা বিবির দেওর আজাদ আলি শেখ। চোখে পড়ল, তৃণমূলের পতাকা ও ফেস্টুনে ছয়লাপ নির্দলদের কার্যালয়। কেন? আজাদের বক্তব্য, “আমরাই তো এখানে বরাবর তৃণমূল করেছি। নিজের ক্ষমতা দেখিয়ে বোলপুরের কেষ্টদা (অনুব্রত) আমাদের নাম কেটে নিজের পছন্দের লোক ঢুকিয়েছেন। জিতেই দেখাব কারা আসল তৃণমূল!” এলাকার এক নির্দল প্রার্থী বললেন, “আমরাই আসল তৃণমূল। আমাদের ভোট দিলেই তৃণমূলকে ভোট দেওয়া হবে।”
স্থানীয় তৃণমূল কর্মী ব্রজরুল খানের ক্ষোভ, “নানুরের বিধায়ক গদাধর হাজরা (অনুব্রত-বিরোধী হিসেবে পরিচিত) আর মন্ত্রী মলয় ঘটকের (বীরভূম জেলায় তৃণমূলের দায়িত্বে) সিদ্ধান্তেই ১৩ জন প্রার্থী ঠিক করা হয়েছিল। চিঠিও দেওয়া হয়েছিল তাঁদের। অথচ কেষ্টদা কলকাঠি নেড়ে গ্রামের একতা নষ্ট করে দিল!”
অনুব্রতবাবুর অবশ্য বক্তব্য, “প্রতীক তো আমার নয়! দলের। দল যাকে দিতে বলেছে, তাকেই দিয়েছি।” |
ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী
সহ প্রতিবেদন: রানা সেনগুপ্ত |