মায়ার টানে নন্দীগ্রাম আঁকড়ে ডাক্তারবাবু
কতলা কোয়ার্টারের এক দিকে অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা ধানখেত। অন্য দিকে স্বাস্থ্যকেন্দ্র।
চাকরির প্রথম দিন। কোয়ার্টারে ফিরে থিতু হয়ে বসতে বসতেই সন্ধে নেমে গিয়েছিল। খোলা জানলা দিয়ে ধানখেতের উপরে জমাট বাঁধা অন্ধকার দেখতে খারাপ লাগছিল না পবিত্রর। পবিত্র হালদার। নীলরতন কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করে, টানা কয়েক বছর স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে গ্রামে গ্রামে ঘোরার পর তাঁর প্রথম চাকরি।
সে দিন দু’কামরার কোয়ার্টারের নোনা-ধরা দেওয়ালগুলোকে ভাল করে দেখে ওঠার আগেই, সন্ধে আরও একটু গাঢ় হতেই শুনতে পেলেন ফট্-ফট্ করে একটা শব্দ। প্রথমে বুঝতে পারেননি। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সহযোগী চিকিৎসককে ফোন করতেই তিনি বলেন, “স্যার, জানলা বন্ধ করে দিন। গুলি চলছে।” ধক্ করে উঠেছিল বুকের ভেতরটা। তবে কি নন্দীগ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বিএমওএইচ (ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক)-এর চাকরি নেওয়াটা ভুল হয়ে গেল? তা হলে কি এই কারণেই চুক্তিপত্রে সই করার শেষ মূহূর্তে কলকাতায় স্বাস্থ্য দফতরের অফিসারেরা বারবার করে জিজ্ঞাসা করছিলেন, “ভেবে দেখুন! যাবেন তো! থাকতে পারবেন তো নন্দীগ্রামে? চাইলে অন্য কোথাও যেতে পারেন!” ঘাড় নেড়ে বলেছিলেন, “না! সরকার প্রথমে যেখানে যেতে বলেছে সেখানেই যাব।”
স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কাজে ব্যস্ত পবিত্রবাবু। ছবি: পার্থপ্রতিম দাস।
সেটা ২০০৮ সালের ১৭ জুলাই। সবে মাত্র শেষ হয়েছে পঞ্চায়েত ভোট। নিয়মিত চলছে লড়াই। এলাকা দখলের লড়াই। রাজ্যে বাম শাসন। কিন্তু তার মধ্যেই পূর্ব মেদিনীপুরের এই একটি ব্লকে চলছে এক অন্য আন্দোলন। সমস্ত নিয়ম-কানুন ছিঁড়েখুঁড়ে দিয়েছে যে আন্দোলন। নন্দীগ্রাম দখল করলে হাতে আরও বড় ক্ষমতা চলে আসবে এটা আঁচ করে একটা দল আন্দোলন জিইয়ে রাখতে মরিয়া। আর নন্দীগ্রাম হাতছাড়া হলে বড় বিপর্যয় হবে বুঝতে পেরে অন্য দল গ্রাম পুনরুদ্ধারে মরিয়া। ফলে, সন্ধের পরে গুলি-বোমার শব্দে অভ্যস্ত হয়ে উঠছিলেন সাধারণ মানুষ। প্রায় প্রতিদিনই হাসপাতালের রেজিস্টারে কোনও না কোনও গুলিবিদ্ধের নাম লেখা হয়ে যাচ্ছিল। এমনই এক সময়ে নন্দীগ্রামে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ৩১ বছরের যুবক পবিত্র।
বাড়িতে আপত্তি করেনি?
দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুলপির বাড়িতে বসে বাবা-মা বলেছিলেন, “তোমার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।” দু’বছরের ছেলে সায়নকে বুকে জড়িয়ে ধরে শুধু চোখ তুলে দেখেছিলেন স্ত্রী সুজাতা। পবিত্রর কথায়, “দেখি না কী হয়, এই ভেবে আমি বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে রওনা হয়ে গিয়েছিলাম।” সন্ধের পরে একটানা গুলির কথা ঘূণাক্ষরেও বলেননি বাবা-মা-সুজাতাকে। মাস দুয়েক একা কোয়ার্টারে কাটানোর পরে স্থানীয় এক যুবককে অনুরোধ করেছিলেন সঙ্গে থাকার জন্য। মাস সাতেক পর আস্তে আস্তে থেমে এসেছিল গুলি-বোমার আওয়াজ। কমে এসেছিল হাসপাতালে আহতদের ভিড়। এখন সন্ধের পরে কোয়ার্টারের পিছনে ধানখেতের দিকে চেয়ার টেনে বসতে পারেন ডাক্তারবাবু।
বুধবার নন্দীগ্রাম হাসপাতালে পাঁচ বছর পূর্ণ হচ্ছে পবিত্রর। ইতিমধ্যে তাঁর চোখের সামনে বদলি হয়ে গিয়েছেন অন্তত ৬ জন বিডিও। বদলি হয়েছেন নন্দীগ্রাম থানার জনা আষ্টেক ওসি। কিন্তু মাটি কামড়ে পড়ে রয়েছেন তিনি। বছরখানেক আগে বীরভূমে বদলির প্রস্তাব এসেছিল। কিন্তু নন্দীগ্রাম ছাড়তে চাননি। কেন? ডাক্তারবাবুর কথায়, “প্রথমত, তত দিনে শান্ত হয়ে এসেছে নন্দীগ্রাম। দুই, আমার বাড়ি থেকে নন্দীগ্রামের দূরত্ব বীরভূমের চেয়ে কম। তিন, নন্দীগ্রাম হাসপাতালে অনেক কিছু উন্নয়নের কাজ চলছে। চার, আমার এখানে কাজ করতে ভাল লাগছে। মায়া পড়ে গিয়েছে।”
গত দু’বছরে হাসপাতালে বসেছে এক্স-রে, ইউএসজি যন্ত্র। তৈরি হয়েছে রক্ত পরীক্ষা কেন্দ্র। এই বছরেই চালু হবে ডায়ালিসিস যন্ত্র। আগে ৫ জনকে ভর্তি রেখে চিকিৎসা করা যেত। এখন ৪০ জনকে ভর্তি করা যায়। আগে মাসে ৩০-৩৫টি প্রসব হত। এখন ১০০টির উপরে হয়। এ সবের পিছনে স্থানীয় তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীর ভূমিকার কথা উল্লেখ করে পবিত্র বললেন, “শুধু আমি নই, আমার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রবিশঙ্কর শাসমল, মৌতৃষা বেরা, অন্য চিকিৎসকেরা কাজ করে চলেছেন। এ সকলের মিলিত প্রচেষ্টার সুফল।”
তবু এ বার হয়তো সত্যিই এখান থেকে বদলি হয়ে যাবেন পবিত্র। এক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাঁচ বছর কাটানোর পর সরকারি চাকরির স্বাভাবিক নিয়মেই সেই সম্ভাবনা রয়েছে। যে ছেলেটি তাঁর নিত্যদিনের সঙ্গী, নন্দীগ্রামের সেই যুবক জাহির আব্বাস নিচু গলায় বললেন, “রাতের অন্ধকারে চুপিচুপি চলে যেতে হবে স্যারকে। নয়তো নন্দীগ্রামের মানুষ যেতে দিবে না।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.