উলুবেড়িয়ায় গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে দীর্ণ তৃণমূলের
ঘরে সিঁধ কাটতে তত্পর বিরোধীপক্ষ |
অভীক বন্দ্যোপাধ্যায় • কলকাতা |
দলের শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশ যাই থাকুক না কেন, আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ছায়া তাড়া করছে তৃণমূলকে। তারই প্রমাণ পাওয়া গেল উলুবেড়িয়া-১ ব্লকের কুলগাছিয়ার চণ্ডীপুর গ্রাম পঞ্চায়েতে। দলের নির্দেশ রয়েছে, সমস্ত দ্বন্দ্ব ভুলে দলীয় প্রার্থীর জন্য একজোট হয়ে লড়াইয়ের। কিন্তু তা নির্দেশের আকারেই থেকে গিয়েছে। মনের মতো আসনে টিকিট না পেয়ে অন্য প্রতীকে লড়াই করার প্রবণতা ঠেকানো যাচ্ছে না কিছুতেই। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে একই আসনে দলের দুই প্রার্থীর লড়াইয়ে কাকে ছেড়ে কাকে সমর্থন করবেন, তা নিয়ে দোটানায় পড়েছেন নিচুতলার বহু কর্মী-সমর্থক।
২০১১ বিধানসভা নির্বাচনে উলুবেড়িয়া (দক্ষিণ) কেন্দ্রে ফরওয়ার্ড ব্লকের কুতুবউদ্দিন আহমেদকে পরাজিত করেন তৃণমূলের পুলক রায়। তৃণমূলের দাবি, সেই প্রভাব অক্ষুণ্ণ থাকবে পঞ্চায়েত নির্বাচনেও। তৃণমূল নেতারা এ কথা বললেও এই বিধানসভা কেন্দ্রের অধীন চণ্ডীপুর গ্রাম পঞ্চায়েতে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সাফল্যের পথে কাঁটা হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা দলের একাংশের। এই পঞ্চায়েতে মোট আসন ২২টি। তার মধ্যে তিনটি আসনে তৃণমূলের দলীয় ঐক্য প্রকৃতই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। তিনটি আসনের প্রতিটিতে দাঁড়িয়েছেন তৃণমূলের দু’জন করে প্রার্থী। একজন পেয়েছেন দলের প্রতীক জোড়াফুল। অন্যজন লড়াই করছেন পাখা চিহ্নে জাতীয়তাবাদী প্রার্থী হিসাবে।
চণ্ডীপুর পঞ্চায়েতের ১১ নম্বর বুথ মানিকপুরে তৃণমূলের জোড়াফুল চিহ্নে দাঁড়িয়েছেন রিনা ঘোষ। অন্যদিকে, জাতীয়তাবাদী প্রার্থী হিসাবে ওই কেন্দ্রে দাঁড়িয়েছেন করবী ঘোষ। ১২ নম্বর বুথে কুলগাছিতে তৃণমূলের ‘অফিসিয়াল’ প্রার্থী তুহিন মণ্ডল, তাঁর বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী প্রার্থী রাধাকান্ত ঘোষ। ১৭ নম্বর রামপুর বুথেও ছবিটা একই রকম। তৃণমূলের জোড়াফুল চিহ্নে লড়ছেন অমর মান্না, অন্যদিকে পাখা চিহ্নে দাঁড়িয়েছেন বিপ্লব ঘোষ।
এতদিন দলে কোনও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নেই বলে তৃণমূলের জেলা নেতৃত্ব যে দাবি করে আসছিলেন, কেন ভোট আসতেই পাল্টে গেল সেই ছবি? |
জোর টক্কর। উলুবেড়িয়ায় তোলা নিজস্ব চিত্র। |
সরাসরি মুখ খুলতে না চাইলেও জাতীয়তাবাদী প্রার্থীদের প্রত্যেকেরই দাবি, এই তিনটি আসনে (মানিকপুর, কুলগাছি ও ১৭ নম্বর রামপুর) যাঁরা দাঁড়িয়েছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই তৃণমূলের উলুবেড়িয়া (দক্ষিণ) কেন্দ্রের সভাপতি দুলাল করের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। নিয়মানুযায়ী তাঁরা প্রতিটি বুথ থেকে প্রার্থীর নাম ঠিক করে কার্যকরী সভাপতি বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়ের কাছে জমা দিলেও দলীয় প্রার্থী হিসাবে তাঁদের নাম বিবেচিত হয়নি। তাই এই পৃথক ভাবে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত। কুলগাছি কেন্দ্রের জাতীয়তাবাদী প্রার্থী রাধাকান্ত ঘোষ বলেন, “সারা বছর এলাকায় থেকে দল করি। কিন্তু ভোটের সময়ে টিকিট পেলাম না। প্রতিবাদ জানাতেই এ ভাবে ভোটে লড়ছি। স্থানীয় মানুষ আমাদের সঙ্গে আছেন। দলের শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি আমার কোনও ক্ষোভ নেই। আমার ক্ষোভ স্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে।” মানিকপুরের জাতীয়তাবাদী প্রার্থী করবী ঘোষের কথায়, “স্থানীয় মানুষের দাবিতেই ভোটে দাঁড়িয়েছি। এলাকার মানুষের সমর্থন আমি পাবই।”
টিকিট না দেওয়ার জন্য যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন এঁরা, সেই দুলালবাবু বলেন, “তিনজনের মধ্যে দু’জনের সঙ্গে আমাদের দলের কোনও সম্পর্ক নেই। অন্য একটি ছেলে আমাদের পঞ্চায়েত সদস্যাকে উন্নয়নের বিষয়ে বিপথে চালিত করেছে, এমনকী ওর বিরুদ্ধেও প্রচুর দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। তাই জেনেবুঝেই আমরা তাঁকে প্রার্থী করিনি। স্থানীয় মানুষের সমর্থনেই এই কাজ করা হয়েছে।”
অন্যদিকে, দলের এ হেন গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব পোস্টার, ব্যানার এবং দেওয়াল লিখনের মাধ্যমে প্রকাশ্যে চলে আসায় ক্ষুব্ধ দলের বহু নেতা-কর্মী। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক তৃণমূল কর্মীর কথায়, “ভোটের আগে এ সব কী হচ্ছে বলুন তো? মানুষ তো আমাদের নিয়ে হাসাহাসি করছে। শাসক দলের এই অবস্থায় মানুষের কাছে কখনই ঠিক বার্তা যাবে না।”
জেলায় তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের এমন ছবি কি আশার আলো দেখিয়েছে সিপিএমকে?
উলুবেড়িয়া ৪ নম্বর জোনাল কমিটির সম্পাদক সুফল বাগ বলেন, “ওই গ্রাম পঞ্চায়েতে ১৯৯৮, ২০০৩ সালে কংগ্রেস-তৃণমূল জোট না থাকায় আমরা জিতেছিলাম। তাই আমাদের শক্তি ক্ষীণ এটা বোধহয় বলা যাবে না। তবে এ বার ওই সমস্ত আসনে জোট না থাকা এবং তার উপর গোঁজ প্রার্থী দাঁড়ানোয় কিছুটা সুবিধা তো হবেই। ভাল ফলেরই আশা করছি এ বার।”
একই আশা করছে কংগ্রেসও। উলুবেড়িয়া (দক্ষিণ) কেন্দ্রের যুব কংগ্রেস সভাপতি রেজাউল হক বলেন, “গত পাঁচ বছরে এই পঞ্চায়েতে মূল ভূমিকা ছিল আমাদেরই। কিন্তু জোট থাকায় সুনাম কুড়িয়েছে ওরা। এ বার জোট নেই। তা ছাড়া ওরা নিজেরাও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জেরবার। আমার ধারণা মানুষ অনেক বেশি সচেতন। সার্বিক ভাবেই ভাল ফলেরই আশা করছি।”
এখন দেখার তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের সুফল কংগ্রেস, সিপিএম কতটা তুলতে পারে।
|