|
|
|
|
প্রবন্ধ ২... |
উন্নতি হয়েছে, অগ্রগতি নয়
গ্রামের মানুষের হাতে আগের চেয়ে টাকা বেড়েছে। কিন্তু আজকের সমৃদ্ধিকে যথার্থ উন্নততর
ভবিষ্যৎ তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের একটি গ্রামের অভিজ্ঞতার কথা লিখছেন
সন্তোষ রাণা |
পঞ্চায়েত নির্বাচন উপলক্ষে দু’দিন গোপীবল্লভপুর থানার এক গ্রামে ছিলাম। গ্রামে তখন তিন দিনব্যাপী অষ্টমপ্রহর (হরিনাম সংকীর্তন) চলছিল। চল্লিশ বছর আগেও এই অনুষ্ঠান হত, কিন্তু তাতে খরচ ছিল খুব কম। গ্রামের কীর্তন-গায়করাই গাইত বা আশপাশের গ্রাম থেকে দু-একটা দল আসত। এখন লম্বা তিন দিন ধরে অনুষ্ঠান, মণ্ডপসজ্জা এবং দূর-দূরান্ত থেকে কীর্তন গাইয়ের দল। এ বছর খরচ লক্ষাধিক টাকা। এর জন্য কোনও চাঁদা ধরা হয়নি বা রাস্তায় লরি আটক করে আদায় করা হয়নি। গ্রামবাসীরা মণ্ডপে এসে স্বেচ্ছায় অর্থ দিয়ে যাচ্ছেন। যে গ্রামে ২৫০-এর মতো ঘর, সেখানে লক্ষাধিক টাকা আদায় হওয়া থেকে বোঝা যায় যে গ্রামে এখন বেশ কিছু উদ্বৃত্ত হচ্ছে।
চল্লিশ বছর আগেও কিছু উদ্বৃত্ত হত। পরিমাণে কম, তবু হত। গ্রামে যে পাঁচ-সাত ঘর বড় জমির মালিক ছিল, উদ্বৃত্ত হত তাদের। তারা সে টাকায় আরও জমি কিনত, টাকা সুদে খাটাত। দু-এক জন পাকা বাড়িও বানিয়েছিল। কিন্তু, গ্রামের বেশির ভাগ পরিবারের সারা বছর দু’বেলা খাওয়া জুটত না। এখন এ গ্রামে কেউ অভুক্ত থাকে না।
উদ্বৃত্ত বৃদ্ধির একটা কারণ ভূমি-সংস্কার, প্রযুক্তির ব্যবহার ও লাভজনক ফসলের (যেমন বাদাম) চাষ। এ ছাড়া কিছু কৃষি-ভিত্তিক শিল্প হয়েছে এবং রাস্তাঘাটের উন্নতি হওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য বেড়েছে। অটো ও ভ্যান চালানো, গৃহ নির্মাণ, আসবাব তৈরি, ইলেকট্রিক মিস্ত্রির কাজ ইত্যাদি পেশার চলন হওয়ায় অ-কৃষি আয়ও বেড়েছে।
চল্লিশ বছর আগে এই গ্রামে কারও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বা জীবন বিমা ছিল না। এখন বেশির ভাগ লোকেরই আছে। নব্বইয়ের দশক নাগাদ এই ঝোঁকটা শুরু হয়। তবে গত তিন-চার বছরে ব্যাঙ্ক অপেক্ষা ‘চিটফান্ড’-এ টাকা রাখার প্রবল ঝোঁক দেখা গেছে। এখন আবার মানুষ বিমায় ফিরছে।
|
উদ্বৃত্ত আছে, বিনিয়োগ নেই |
ভূমি-সংস্কার ও তিন দশকের পঞ্চায়েত ব্যবস্থার ফলে গ্রামাঞ্চলে যে উদ্বৃত্ত উৎপাদন বেড়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এই উদ্বৃত্ত গ্রামাঞ্চলে উৎপাদনশীল ভাবে বিনিয়োগ হতে পারছে না। যখন উদ্বৃত্ত ব্যাঙ্কে বা জীবন বিমায় জমা হচ্ছে, তখন তার অতি সামান্য অংশই ঋণ আকারে ফিরে আসছে। অন্য দিকে চিটফান্ডগুলো বেশি সুদের লোভ দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করেছে। |
|
সেই দৃশ্য সমানে... মেদিনীপুর, ২০১২। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ |
গ্রামাঞ্চলের উদ্বৃত্ত যে উৎপাদনশীল ভাবে বিনিয়োগ হতে পারছে না, তার কতকগুলো কারণ আছে। ভূমি-সংস্কারের কাজ অর্ধসমাপ্ত। জমির ২৫-৩০ শতাংশ এখনও অ-কৃষক মালিকদের হাতে রয়েছে বলে আমার ধারণা। এরা আর চাষে আগ্রহী নয়।
জোতের খণ্ডকরণ হওয়ার ফলে বড় মাত্রার বিনিয়োগে সমস্যা আছে। ভূমি-সংস্কারের পর কৃষকরা সমবায় তৈরি করলে বড় আকারে বিনিয়োগ করা যেত এবং মাছের চাষ, পোলট্রি, দুধ উৎপাদন ইত্যাদি নানা সহযোগী উৎপাদনের ক্ষেত্র খুলে যেত। রাজ্যে এখন রোজ প্রচুর ডিম বাইরে থেকে আসে। গ্রামাঞ্চলের দোকানেও এখন চালান আসা ডিম বিক্রি হয়। এই অঞ্চলের বহু যুবক কর্নাটক বা তামিলনাড়ুতে গিয়ে পোলট্রি ফার্মে কাজ করছে। অথচ, এখানে সেই ব্যবসা গড়ে ওঠেনি।
গ্রামাঞ্চলে অনেক পুকুর রয়েছে, যেগুলোর মালিকানা বহু শরিকের মধ্যে বিভক্ত থাকার ফলে তা ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহার হয় না। এই গ্রামেই একটি বড় পুকুর আছে, যার আয়তন ১০ একরের বেশি। উৎপাদনশীল ভাবে ব্যবহার হলে তাতে বছরে ১০ লক্ষ টাকা আয় হতে পারে।
চার দশক আগে গ্রামে বেশির ভাগ মানুষ ছিল নিরক্ষর। এখন বেশির ভাগ সাক্ষর। মাধ্যমিক পাশ দু-এক জনের বেশি ছিল না। এখন কয়েকশো ছেলেমেয়ে মাধ্যমিক পাশ। কয়েক জন উচ্চশিক্ষিতও বটে। কিন্তু সরকারি, আধা-সরকারি বা সংগঠিত শিল্পক্ষেত্রে চাকরি জুটেছে সামান্য কয়েক জনের, বাকিরা বেকার বা আধা-বেকার। অন্য দিকে, চাষের কাজের জন্য লোক পাওয়া যায় না। অনেক অ-কৃষক মালিক সে জন্য জমি ফেলে রাখে বা ভাগে-খাজনায় দিয়ে দেয়।
|
রাজনীতির আশ্রয়ে |
এটা একটা ধাঁধা। যেখানে জমি রয়েছে, গ্রামের পাশ দিয়ে সুবর্ণরেখা নদী বয়ে গেছে, পরিশ্রম করার মানুষ আছে এবং সর্বোপরি বিনিয়োগ করার মতো উদ্বৃত্ত আছে সেখানে, সেগুলি উৎপাদনশীলভাবে ব্যবহার হচ্ছে না। ফলে মানুষ থাকছে বেকার। একাংশ কাজের খোঁজে দূর-দূরান্তে যাচ্ছে।
এই সংকট থেকে জন্ম নিচ্ছে আর এক ধরনের সংকট। শিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত যুবকদের একাংশ রাজনীতি করছে মূলত পঞ্চায়েতের ক্ষমতা দখল করার জন্য। কর্তৃত্ব করতে পারলে এবং মানুষকে দাবিয়ে রাখতে পারলে যেমন সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করা যায়, তেমনই গ্রামীণ উদ্বৃত্তেরও একটা অংশ কব্জা করা যায় (যেমন, কম দামে ফসল কেনা, সারের কালোবাজারি করা), আবার জঙ্গলের কাঠ ও পাথর বা নদীর বালি লুঠ করা যায়।
এই প্রবণতা বামফ্রন্ট আমলেই শুরু হয়েছিল। আমার মনে হয়, ২০০৩ সালে বহু জায়গায় এই গোষ্ঠীগুলো পঞ্চায়েত ক্ষমতা দখল করে নিয়েছিল। সত্তরের দশক থেকে যে খেতমজুর ও গরিব কৃষকরা লড়াই করেছিলেন, তাঁরা প্রান্তিক অবস্থানে চলে যাচ্ছিলেন। অনেক নিষ্ঠাবান বামপন্থী কর্মী নিষ্ক্রিয় হয়ে যাচ্ছিলেন। বামফ্রন্টের এই ঘুণ ধরা ব্যবস্থাকে সরিয়ে ২০১১ সালে যাঁরা ক্ষমতায় এলেন, তাঁরা গণতন্ত্র পুণঃপ্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করেছিলেন। কিন্তু গত দু’বছরে তাঁদের কার্যকলাপ প্রমাণ করেছে, গণতন্ত্রে তাঁদের শ্রদ্ধা নেই।
গ্রামীণ অর্থনীতিতে যে সংকট দেখা দিয়েছে, সেটা উপর থেকে কোনও হুকুম দিয়ে সমাধান করা যাবে না। সোভিয়েত ইউনিয়ন গ্রামীণ উদ্বৃত্ত শিল্পের জন্য টেনে নেওয়ার নীতি নিয়েছিল। সেই শিল্প রাষ্ট্রীয় মালিকানায় থাকলেও তার ফল ভাল হয়নি। মাও জে দং এই নীতিটার বদল ঘটাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা সফল হয়নি। ভারত কী ভাবে এই সমস্যার সমাধান করবে, তা তাকেই ঠিক করতে হবে। কোটি কোটি শ্রমজীবীর অংশগ্রহণ, কল্পনাশক্তি ও সৃষ্টিশীলতা ছাড়া এটা সম্ভব নয়। মানুষের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে নতুন সমাজ তৈরি করা যায় না।
আমাদের দেশে পঞ্চায়েতগুলো সীমিত ক্ষমতার মধ্যেও গ্রাম-সংসদ কর্তৃক গ্রাম পরিকল্পনার মাধ্যমে মানুষের সৃষ্টিশীলতার কিছু বিকাশ ঘটাতে পারে। কিন্তু তার জন্য চাই গণতন্ত্রের পরিপূর্ণ বিকাশ। |
|
|
|
|
|