|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
বাঙালি বড় রাজনীতিতে ফেল, খুচরোয় চ্যাম্পিয়ন
আসল রাজনীতি, বড় রাজনীতির ময়দানে তাই বাঙালির ঘোর অনটন। রাজনীতি চর্চার
রোমাঞ্চ
আমরা অর্জন করতে চাই ক্ষুদ্রতর নানা পরিসরে। রকমারি সংগঠনের, প্রতিষ্ঠানের
প্রাঙ্গণে
এক বার ঢুকে পড়লে আমিই রাজা। আমিই রাষ্ট্রপতি। আমিই প্রধানমন্ত্রী।
সুগত মারজিৎ |
রাজনীতিতে বাঙালির হাল অনেকটা ফুটবলের মতো। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে যতই নৃত্য করি না কেন, আসল ফুটবলের প্রতিযোগিতার ধারেকাছে আমরা পৌঁছতে পারি না। পাড়ায় খেলি, বড়জোর নিজের শহরে বা দেশের বড় শহরে, আমাদের দৌড় ওই পর্যন্ত। ঠিক তেমনই, জাতীয় স্তরের সংবাদমাধ্যমগুলোতে, জাতীয় রাজনীতির বিভিন্ন আসরে যাঁদের নাম শোনা যায়, দেশের বিভিন্ন অংশে এ চত্বরের রাজনীতি নিয়ে যাঁদের ঘিরে উৎসাহ, সেখানেও বাঙালি এক আঙুলে গোনা যায়। কেন আমাদের এমন হাল? আমি বলার চেষ্টা করব যে, শাসনক্ষমতা দখলের রাজনীতি রূঢ় বাস্তব দিয়ে ঘেরা। সে রাজনীতির চর্চায় খুব কষ্ট, ঝুঁকিও বড় বেশি, মারধর খাওয়ার সম্ভাবনা প্রভূত তাতে গড় বাঙালির অনীহা। আসল রাজনীতি, বড় রাজনীতির ময়দানে তাই বাঙালির ঘোর অনটন। অর্থনীতির ভাষায় বললে, একসেস ডিমান্ড। কিন্তু অন্য দিকে, রাজনীতি চর্চার রোমাঞ্চ আমরা অর্জন করতে চাই ক্ষুদ্রতর নানা পরিসরে। বাঙালির রাজ্যে সেই সব পরিসরেই যত রাজনীতিকদের ভিড়। এক্সেস সাপ্লাই।
পাড়ার পুজো, কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় কমিটি, কোনও সংগঠনের নিয়ামক বোর্ড, ক্লাবের, স্কুলের পরিচালন সমিতি, ছোট ছোট বিভিন্ন ধরনের সংগঠন সব জায়গায় রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজির বাড়বাড়ন্ত দেখে তাজ্জব হতে হয়। সব জায়গায় শাসক-বিরোধী সমারোহ, জটিল-কুটিল পদ্ধতি প্রক্রিয়ার সাহায্যে অমুককে ল্যাং মেরে তমুক গোষ্ঠীকে বিপাকে ফেলে, আজেন্ডার দশ নম্বর প্রস্তাবকে হিমঘরে পাঠিয়ে মাস্ল ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াই আমরা। গত শতাব্দীর সাংগঠনিক মিটিংয়ে অধুনা-বিগত কোন সদস্য কী বলেছিলেন এবং তা নথিবদ্ধ ছিল কি না, তাই নিয়ে দু’চারটে লেনিন-স্ট্যালিন-গাঁধী সাবাড় হয়ে যাওয়াটা কিছু আশ্চর্যের নয়। ফর্মুলাটা একই: ক্ষমতা কুক্ষিগত করা। দাদাগিরি। সংগঠনের, প্রতিষ্ঠানের প্রাঙ্গণে এক বার ঢুকে পড়লে আমিই রাজা। আমিই রাষ্ট্রপতি। আমিই প্রধানমন্ত্রী। |
|
এককালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সর্বকনিষ্ঠ অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করার পর একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে এক জন আমায় বললেন, ‘ও, আপনি ওখানে পড়ান? তমুককে চেনেন?’ আমি চিনতাম না। তিনি বললেন, ‘সে কী! চেনেন না? উনি তো কোর্টের সদস্য।’ আমার বাবা কোর্টে কাজ করতেন, কিন্তু মাস্টারমশাইরা কোর্টের সদস্য কী ভাবে হন তা জেনেছি পরে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রক সংসদের সভ্যরা রাজা-উজির গড়বেন ও মারবেন, এটাই নিয়ম। আবার, ওই এক সমস্যা রাজনীতি করতেই হবে। প্রত্যক্ষ রাজনীতি চর্চায় বিপদ, তাই সব উৎসাহ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ো, কোথাও না কোথাও সিংহাসন পাবেই।
যত ছোট প্রতিষ্ঠান, তত বড় লাফঝাঁপ। প্রতিষ্ঠানকে আঁকড়ে ধরে একেবারে ফরাসি বিপ্লব থেকে শুরু করে পেরেস্ত্রৈকার প্র্যাকটিস করা। কত কত মুখ্যমন্ত্রী আর প্রধানমন্ত্রী, কত কত বিরোধী নেতা-নেত্রী যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই।
যে বিপ্লব, আহা, বাইরে করা গেল না, বেচারা প্রতিষ্ঠানটিকেই তার ঠেলা সামলাতে হয়। আমরা বিভিন্ন কাগজে ‘আমরা-ওরা’ নিয়ে প্রচুর খবর পড়েছি। সেই ‘আমরা-ওরা’ আমাদের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে জড়িয়ে রয়েছে। আপনি মার্ক্সকে পুজো করেন, আমি গাঁধীকে। আপনি লাল, আমি গোলাপি। আমি ঠাকুর-দেবতার ভক্ত, আপনি নাস্তিক। নিজেদের সব চারিত্রিক সম্পত্তি নিয়ে বসলাম বোর্ডের বা কাউন্সিলের মিটিংয়ে। তার মধ্যে আবার কে কত শিক্ষিত, তা নিয়ে তীব্র গাত্রদাহ। কে কত পাত্তা পায়, কত বার বিদেশ যায়, আমি নিজেকে কত বড় আমির-ওমরাহ হোমরাচোমরা ভাবি, সব মিলিয়ে সে এক ভয়ংকর অবস্থা। দেওয়ালটা কীসের হবে, টিনের না কাঠের, তা নিয়ে তুলকালাম হওয়ার পর যিনি জিতলেন, তিনি প্রধানমন্ত্রীসুলভ হেসে বেরোলেন।
সংগঠন করা আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার, সত্যি কথা। কিন্তু আমি জানি, অনেকে শুধু সংগঠনই করেছেন বা এখনও করছেন, কাজ করেন না। রাজনীতি করে প্রতিষ্ঠানকে কী ভাবে ঘায়েল করা যায় অফিস, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ধারিত কাজের চেয়ে তা অনেক বেশি রোমাঞ্চকর। মাইনে নিয়ে শুধু মিছিল করেন এমন লোকও আমি দেখেছি। তাঁকে ঘাঁটায় কার সাধ্যি।
সবাই নিশ্চয়ই এমন নয়। অনেকেই আছেন, যাঁরা কখনও কোনও দিন কোথাও রাজনীতির সাহায্যে ক্ষমতাবান হতে চাননি। তাঁরাও এক অর্থে রাজনীতির বাইরে নন, কারণ আমাদের ব্যবহারিক জীবনে রাজনীতিকে এড়ানো শক্ত, কিন্তু তাঁরা পাড়ার মুখ্যমন্ত্রী হতে চান না। তবে এখানে বলে রাখি, এক বার মার্কিন মুলুকে ভয়ানক উচ্চশিক্ষিত উচ্চবর্গীয় অনাবাসী বাঙালিদের একটি ক্লাব সংক্রান্ত নির্বাচনের সাক্ষী হয়েছিলাম। সেখানে তাঁদের হাবভাব দেখে মনে হয়েছিল, এ বার বোধহয় যুদ্ধ বাধবে। কে সাংস্কৃতিক সচিব হবেন, তাই নিয়ে যে পরিমাণ নেপথ্য স্ট্র্যাটেজি করা হচ্ছিল মনে হল ক্লাব নয়, কোনও দেশের সাধারণ নির্বাচন দেখছি। আসলে, চরম পেশাদারি সাফল্যও তাঁদের রাজনৈতিক ক্ষমতা দেয়নি, যে ক্ষমতাবলে তাঁরা তাঁদের পাড়ার মাথা হবেন। তাঁরা কি কেউ কোনও দিন পশ্চিমবঙ্গে ফিরে আসল রাজনীতি করবেন? ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে নেমে রাজ্যের, দেশের ভার নেবেন? মনে হয় না।
রাজনীতি চর্চার একটি বৌদ্ধিক এবং মানসিক দিক আছে, আর অন্য দিকে রয়েছে রাজনীতির কায়িক চেহারা, যেখানে ‘দাপুটে’ নেতার রমরমা। এই দুইয়ের দ্বন্দ্বে তথাকথিত ভদ্রলোক রাজনীতির লোকেরা শুধু নিজেদের সামাজিক পরিসরে ক্ষমতাদখলের খেলায় মেতে ওঠেন প্রত্যক্ষ রাজনীতির বাইরে যে আখড়া, সেখানে ভিড় বাড়তে থাকে। রাজনীতিচর্চা হয়ে দাঁড়ায় মুদ্রাদোষের মতো। না করে থাকতে পারেন না।
কেউ বলতে পারেন, প্রত্যক্ষ রাজনীতি মানেও তো দুর্নীতি। তার জন্যই তো যত সমস্যা। কিন্তু এখানে সেটা প্রশ্ন নয়। পাড়ার ক্লাবের পুজোকে কব্জা না করে বা নিজেরই সহকর্মীকে বিভাগ থেকে না তাড়িয়ে, যদি সেই কূটবুদ্ধি সহকারে বৃহত্তর রাজনীতি করতেন, ভাল হত না কি?
ক্ষুদ্র পরিসরে পরোক্ষ রাজনীতির কোনও সুফল নেই, এমন কথাও বলছি না। হাজার হোক, রাজনীতির সাহায্যেই তো অশুভ শক্তিকে ঠেকানো যায়, অন্তত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সেটাই শিক্ষা। কিন্তু অত্যধিক রাজনীতির সমস্যা বিস্তর। যেমন, নামী-দামি অধ্যাপকের পরিচয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম হওয়া উচিত। সেই নাম ও দাম তাঁর কাজের প্রতিফলনে হবে, এটাই বাঞ্ছনীয়; কে সেনেট-সিন্ডিকেট-কোর্ট-কাছারির সদস্য হবেন, তা নিয়ে নয়। এই কথাটাই আমরা অনেক দিন ধরে ভুলতে বসেছিলাম।
পরিশেষে একটা সর্বগ্রাসী সর্বব্যাপ্ত রাজনীতির কথা না বলে পারছি না। ‘আমরা সবাই মিলে ঠিক করেছি’র রাজনীতি যেখানে কয়েক জন বলে, আর সবাই চুপ করে থাকে। অশান্তি নেই, প্রতিবাদ নেই, মিছিল নেই, মশাল নেই। যেন স্বেচ্ছায় স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়েছে সবাই কোনও এক অমোঘ, নিরঙ্কুশ, সদাসত্য রাজনৈতিক দর্শনের তাড়নায়। বিতর্ক নেই, তাই সংঘাতও নেই। দিনের পর দিন হাড়-হিম-করা শৃঙ্খলে আবদ্ধ সে ব্যবস্থা, যেখানে কাতারে কাতারে যোগ্য পদপ্রার্থীরা বঞ্চিত বা বিতাড়িত। শান্ত রাজনীতিই সর্বদা কাম্য, এমনটা হয়তো নয়।
|
কলকাতার সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশাল সায়েন্সেস-এ অর্থনীতির শিক্ষক |
|
|
|
|
|