বাড়ির একতলায় শোয়ার ঘরে ঢুকে শিউরে উঠেছিলেন প্রতিবেশীরা। মেঝেতে শোয়ানো রয়েছে দু’টি মৃতদেহ। এক জনের বয়স ৭০। অন্য জনের ৬৫। দু’জনেরই গলায় ধারালো অস্ত্রের একাধিক আঘাতের চিহ্ন। হাত-পা দড়ি ও কাপড় দিয়ে বাঁধা। প্রতিবেশীদের হাতে ততক্ষণে ধরা পড়ে গিয়েছে ওই বৃদ্ধ দম্পতির বছর তিরিশের ছেলে। অভিযোগ, মা-বাবাকে খুন করে মৃতদেহ পুঁতে ফেলার জন্য বাড়ির পাশেই গর্ত খোঁড়াচ্ছিল সে। পরে পুলিশ এসে গ্রেফতার করে শোভন সরকার নামের ওই যুবককে।
ঘটনাটি ঘটেছে মঙ্গলবার সকালে ঠাকুরপুকুর থানার তালপুকুর রোডে। প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশ জানায়, সোমবার রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ খুন দু’টি হয়েছে। জেরায় শোভন পুলিশকে জানিয়েছে, তার মা ঊষা সরকার চিলেকোঠার ঘরে পুজো করছিলেন। তখন একটি ধারালো কাটারি দিয়ে সে পিছন থেকে মায়ের গলায় কোপ মারতে থাকে। ছেলেকে বাধা দেওয়ার সুযোগ পাননি ঊষাদেবী। তিন বার কোপ মারার পরে মৃত্যু হয় তাঁর। এর পরে রক্তাক্ত কাটারি হাতে একতলার শোয়ার ঘরে যায় শোভন। বাবা পরেশ সরকারকে ওই কাটারি দিয়েই আক্রমণ করে সে। পরেশবাবু বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন বলে পুলিশকে জানিয়েছে শোভন। ঘটনাস্থলে ধস্তাধস্তির চিহ্ন পেয়েছেন তদন্তকারীরা। কিন্তু উন্মত্ত শোভনের সঙ্গে বেশি ক্ষণ যুঝতে পারেননি অসুস্থ ও অশক্ত পরেশবাবু। সামনে থেকে তাঁর গলায় কাটারি চালায় শোভন। বৃদ্ধ মাটিতে পড়ে যাওয়ার পরেও তাঁর গলায় বেশ কয়েক বার কোপ মারে সে। |
পুলিশ জানিয়েছে, মা-বাবার মৃত্যু হয়েছে নিশ্চিত হওয়ার পরে ঠান্ডা মাথায় মেঝে থেকে রক্ত সাফ করে শোভন। চিলেকোঠা থেকে মায়ের দেহ নামিয়ে শোয়ার ঘরে নিয়ে যায়। পরে দেহ দু’টির হাত-পা দড়ি ও ছেঁড়া শাড়ি দিয়ে বাঁধে। নিজের রক্ত মাখা পোশাকও পাল্টে ফেলে।
তদন্তকারীদের শোভন জানিয়েছে, ভোর হতেই এলাকার দুই মজুরকে ডেকে আনে সে। বাড়ির ফাঁকা জায়গায় একটি চৌবাচ্চা করা হবে বলে তাঁদের গভীর করে মাটি কাটতে বলে। সেই মতো মাটি কাটার কাজও শুরু করেন দুই মজুর। এর মধ্যে ওই বাড়িতে আসেন ঊষাদেবীর বান্ধবী মিলন দত্ত। তদন্তকারীদের মিলনদেবী জানিয়েছেন, রোজই ভোরে উঠে তাঁরা দু’জন বাড়ির সামনে একটু পায়চারি করতেন। পুজোর ফুল তুলতেন। এ দিন ঊষাদেবীকে দেখতে না পেয়ে শোভনকে তাঁর কথা জিজ্ঞাসা করেন তিনি। শোভন তাঁকে জানায়, বাবা-মা উত্তরবঙ্গে চলে গিয়েছেন। শোভনের কথায় সন্দেহ হয় মিলনদেবীর। তিনি অন্য প্রতিবেশীদেরও বিষয়টি জানান। এর মধ্যে শোভনদের বাড়িতে আসেন তার খুড়তুতো ভাই সুব্রত। পেশায় অটোচালক সুব্রতবাবুর অটোটি শোভনদের বাড়িতেই থাকত। সুব্রতবাবু এ দিন বলেন, “অন্য দিন ভোরে এসে জেঠিমাকে দেখতে পেতাম। এ দিন দেখি, ঘরের দরজা-জানলা সব বন্ধ। বাইরে দু’জন গর্ত খুঁড়ছে।” শোভনের কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে তাঁকেও মা-বাবার উত্তরবঙ্গ যাওয়ার কথা বলে সে। বাইরে থেকে সুব্রত দেখতে পান, ঘরের এক পাশে রক্ত মাখা চুল পড়ে রয়েছে। এতে সন্দেহ হওয়ায় সুব্রতবাবু প্রতিবেশীদের খবর দেন। পরে সবাই মিলে চেপে ধরেন শোভনকে। তাঁদের প্রশ্নের মুখে পড়ে নানা রকম কথা বলতে থাকে শোভন। পরে সে জানায়, মা-বাবাকে খুন করে ঘরে রেখে দিয়েছে সে। এর পরে তাকে ঘরে আটকে প্রতিবেশীরা বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দেন। খবর দেওয়া হয় পুলিশকে। পুলিশ এসে শোয়ার ঘরে ঢুকে মৃতদেহ দু’টি উদ্ধার করে। ঘটনাস্থলে পুলিশ-কুকুর নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রেফতার করা হয় শোভনকে। শোভনের ঘরে খাটের তলা থেকে উদ্ধার হয় কাটারিটি। |
কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (দক্ষিণ-পশ্চিম) সুব্রত মিত্র বলেন, “মৃতদেহ দু’টি গায়েব করার পরিকল্পনা করেছিল শোভন। তাই বাড়ির পাশে গর্ত খোঁড়াচ্ছিল।” পুলিশ জানিয়েছে, পরেশবাবু কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টের অবসরপ্রাপ্ত কর্মী। তাঁর দুই ছেলে ও এক মেয়ে। শোভন ছোট। বড় ছেলে প্রদীপ পেশায় কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। দিল্লিতে চাকরি করেন। মেয়ে অণিমার বিয়ে হয়েছে ঠাকুরপুকুরেরই সরকারহাটে।
কিন্তু মা-বাবাকে কেন খুন করল শোভন?
প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশ জানিয়েছে, বছরখানেক আগেও শোভন এক বার মা-বাবাকে খুন করার চেষ্টা করে। তখন তাকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল। কিছুটা সুস্থ হলে তাকে একটি অটো কিনে দিয়েছিলেন পরেশবাবু। মাঝেমধ্যে সে অটো চালাত। প্রতিবেশী বিশ্বজিৎ সরকার বলেন, “নিয়মিত অটো না চালানোয় মা-বাবার সঙ্গে প্রায়ই বিবাদ হত শোভনের। বাবার কাছে মাঝেমধ্যেই টাকা চাইত সে। টাকা না-পেলে গোলমাল করত।” প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, কিছু দিন আগে নিজের একটি সম্পত্তি বিক্রি করেছিলেন পরেশবাবু। সেই টাকার ভাগ চেয়েছিল শোভন। তা নিয়েও মা-বাবার সঙ্গে শোভনের বিরোধ ছিল বলে প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন।
গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, পরিবারে বিশেষ গুরুত্ব ছিল না শোভনের। পুলিশের দাবি, শোভন তাঁদের বলেছে, সে মা-বাবাকে ঘৃণা করত। দাদার সঙ্গে তুলনা টেনে পরিবারের সকলে তাকে নানা ভাবে ছোট করতেন। এতে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল শোভন।
|