বছর ঘুরলেই লোকসভা নির্বাচন। তার আগে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে সংস্কারের একটা ঝোড়ো ইনিংস খেলতে চাইছেন মনমোহন সিংহ। সে জন্য আজ এ দেশে বিদেশি লগ্নির দরজাটা আরও একটু খুলে দিলেন তিনি।
বিদেশি লগ্নির পরিমাণ কোন ক্ষেত্রের কতটা বাড়ানো হবে, তা নিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার মধ্যে মতভেদ ছিল বলে কংগ্রেস সূত্রের খবর। সমালোচনায় মুখর হয়েছেন বিরোধীও। যেমন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তা ছাড়া অর্থনীতির এখন যা পরিস্থিতি, তাতে এই দাওয়াই কতটা কাজে দেবে, তা নিয়ে সন্দিহান অনেক অর্থনীতিবিদই। যদিও চলতি খাতে বাণিজ্য লেনদেনের ঘাটতি আর টাকার দামের পতন রোখার জন্য সরকারের সামনে এ ছাড়া আর পথই বা কী ছিল, বলছেন বিশেষজ্ঞদের অনেকে।
মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার দীর্ঘ বৈঠকের পর যে ঘোষণা করা হয় তাতে টেলি-যোগাযোগ ক্ষেত্রে বিদেশি লগ্নির ঊর্ধ্বসীমা ১০০% (ছিল ৭৪%) করার কথা যেমন রয়েছে, তেমনই আছে বিমায় বিদেশি সংস্থার পা-রাখার সুযোগ আরও বাড়ানোর প্রস্তুতি। বিমায় লগ্নির ঊর্ধ্বসীমা ৪৯ শতাংশ রাখা হলেও আগাম অনুমোদনের ঝক্কি সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। দেশের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে বিদেশি পুঁজির ঊর্ধ্বসীমা এখনই বাড়ানো হয়নি ঠিকই। কিন্তু অত্যাধুনিক প্রযুক্তি হাতে আসার সুযোগ থাকলে, ক্ষেত্র বিশেষে ওই সর্বোচ্চ সীমা শিথিল করার রাস্তা খুলে রেখেছে কেন্দ্র। তবে বিমান পরিবহণ, বহু ব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসা, সংবাদমাধ্যমের মতো বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে অবশ্য লগ্নির ঊর্ধ্বসীমা বাড়ানো নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি।
অনেকেই মনে করছেন, এ দিন লগ্নির ঊর্ধ্বসীমা বাড়ানোয় যতটা মন দিয়েছেন মনমোহন, তার থেকেও বেশি জোর দিয়েছেন লাল ফিতের ফাঁস আলগা করার উপর। যে কারণে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিদেশি লগ্নি পর্ষদের অনুমোদন ছাড়াই একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত লগ্নি করতে পারা যাবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সংস্কারের এই ঘোষণায় স্বাভাবিক ভাবেই খুশি শিল্পমহল। তেমনই প্রত্যাশিত ভাবেই তা তুফান তুলেছে রাজনীতিতে। যেমন এ দিন রাতেই এ নিয়ে ফেসবুকে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। টেলিকম থেকে প্রতিরক্ষা সব ক্ষেত্রেই বিদেশি লগ্নির দরজা এমন হাট করে খোলার তীব্র বিরোধিতা করেছেন তিনি। তাঁর মতে, এর ফলে এক দিকে যেমন সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বাড়বে, তেমনই বিপন্ন হবে দেশের নিরাপত্তা। |
লগ্নি আসবে কি না, কী করে বলব? আপনারা বোধ হয় আমার পদবি দেখে ভুল করছেন! আমার পদবি শর্মা হলেও আমি জ্যোতিষী নই!
আনন্দ শর্মা, কেন্দ্রীয় বাণিজ্যমন্ত্রী |
দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের সিদ্ধান্তগুলো গরিব মানুষের জীবন এবং সব চেয়ে বড় কথা দেশের নিরাপত্তাকে গভীর বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মুখ্যমন্ত্রী |
|
অন্য দিকে, মনমোহিনী দাওয়াই নিয়ে সন্দেহের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিশেষজ্ঞরা মনে করাচ্ছেন, এর আগে শরিক (তৃণমূল) খোয়ানোর বোঝা বয়েও বহু ব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির ঊর্ধ্বসীমা বাড়িয়েছিল কেন্দ্র। কিন্তু তার পরেও ওয়ালমার্ট, টেস্কোর মতো রিটেল বহুজাতিক এ দেশে টাকা ঢালায় তেমন আগ্রহ দেখায়নি। বিমান পরিবহণেও এখনও ঝুলে রয়েছে জেট-এতিহাদ চুক্তি। এর আগে একগুচ্ছ ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগের পথ প্রশস্ত করা হলেও বড় মাপের লগ্নি বলতে শুধু এয়ার-এশিয়া।
অর্থনীতিবিদদের মতে, শুধু লগ্নির ঊর্ধ্বসীমা বাড়ালেই লগ্নি আসবে না। আগে বোজাতে হবে অর্থনীতির ফাঁকফোকর। দ্রুত বদলাতে হবে কর-কাঠামো। জোর দিতে হবে পরিকাঠামোয়। সামঞ্জস্য আনতে হবে বিভিন্ন মন্ত্রকের নীতির মধ্যে। ব্যবস্থা করতে হবে প্রকল্পে দ্রুত ছাড়পত্র দেওয়ার। সব মিলিয়ে, তৈরি করতে হবে লগ্নি-সহায়ক পরিবেশ।
বস্তুত, দেশের অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদেশি সংস্থাগুলি এখানে টাকা ঢালতে কতটা স্বচ্ছন্দ বোধ করবে, এই প্রশ্নের উত্তরে বাণিজ্যমন্ত্রী আনন্দ শর্মাও বলেছেন, “লগ্নি আসবে কিনা কী করে বলব! আপনারা বোধহয় আমার পদবি দেখে ভুল করছেন। শর্মা হলেও আমি জ্যোতিষী নই!” যদিও টেলিকম মন্ত্রী কপিল সিব্বলের দাবি, শুধু টেলিকম ক্ষেত্রেই আগামী কয়েক বছরে ৫-৬ লক্ষ কোটি টাকা বিদেশি বিনিয়োগ আসতে পারে।
আসলে বিদেশি লগ্নির জন্য দরজাটা কতটা খোলা হবে, তা নিয়ে সরকারের অন্দরেই মতবিরোধ ছিল। এ ব্যাপারে অর্থ বিষয়ক সচিব অরবিন্দ মায়ারামের নেতৃত্বে যে কমিটি গঠন করা হয়েছিল, তারা নাটকীয় পরিবর্তনের সুপারিশ করে। প্রধানমন্ত্রী নিজে লগ্নি বাড়ানোর পক্ষে সায় দিলেও আপত্তি তোলে অনেক মন্ত্রক। টেলিকমের মতো ক্ষেত্রে বিদেশি সংস্থাকে আসতে দেওয়া নিয়ে উদ্বেগ জানায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনির মত ছিল, প্রতিটা লগ্নি প্রস্তাব আলাদা ভাবে বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক। সমাজতন্ত্র বনাম পুঁজিবাদ কংগ্রেসের অন্দরের সেই চিরাচরিত তাত্ত্বিক লড়াইটা ফের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
শেষ পর্যন্ত ঐকমত্য গড়ে তোলার কাজে নামেন মনমোহন নিজেই। এক ডজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসেন তিনি। প্রথামাফিক মন্ত্রিসভার বৈঠক না-ডেকে শীর্ষ মন্ত্রীদের আলাদা ভাবে বৈঠকে ডাকা হয়। কিন্তু তাতেও অবশ্য সব মতবিরোধ মেটানো যায়নি। অজিত সিংহের আপত্তিতে বিমান ক্ষেত্রে লগ্নির ঊর্ধ্বসীমা বাড়ানো যায়নি। অ্যান্টনির আপত্তিতে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রেও ঊর্ধ্বসীমা ২৬ শতাংশই রাখা হয়েছে। তবে উন্নত প্রযুক্তি আনার প্রতিশ্রুতি দিলে এর থেকে বেশি লগ্নিকে ছাড়পত্র দেওয়ার বিষয়টি মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে বলা হয়েছে। লগ্নির সীমা বাড়ানো যায়নি সংবাদমাধ্যম এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রেও।
|
বিদেশি লগ্নির নয়া ঊর্ধ্বসীমা |
টেলি-যোগাযোগ: ১০০%। ৪৯% পর্যন্ত অনুমোদন লাগবে না
প্রতিরক্ষা: ২৬%-ই থাকছে। তবে বেশি লগ্নির প্রস্তাব এলে খতিয়ে দেখা হবে
বিমা: ৪৯%। তবে সংসদের অনুমোদন সাপেক্ষ
এক ব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসা: ৪৯% পর্যন্ত অনুমোদন লাগবে না
তৈল শোধনাগার: ৪৯%-ই থাকছে। তবে আর অনুমোদন লাগবে না
স্টক এক্সচেঞ্জ: ৪৯%। আমানতকারীদের সরাসরি লগ্নির অনুমতি
ক্যুরিয়র পরিষেবা: ১০০% পর্যন্ত সরাসরি লগ্নি
চা বাগিচা: ১০০%। ৪৯% পর্যন্ত অনুমোদন লাগবে না |
|