বুট বিজ্ঞান
কারও বুটে ফাইবারগ্লাস। কারও জুতোয় ওয়েদার কন্ট্রোল।
মেসি-নেইমারদের বুট রহস্য ফাঁস করলেন সোহম দে |
|
কাট ওয়ান
সকালের ঝলমলে রোদ্দুর। টেনিস কোর্টে জল ছিটোনো চলছে। একটু পর ম্যাচ হবে। দুই মহাযোদ্ধা কে?
রাফায়েল নাদাল এবং ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো!
একজন ক্লে কোর্টে সম্রাট। অন্য জন, ফুটবল মাঠে ডিফেন্ডারদের নাস্তানাবুদ করতে বিশেষ পছন্দ করেন। কিন্তু তাতে থোড়াই কেয়ার। র্যাকেটের শটে রিটার্ন হচ্ছে বুট দিয়ে! নাদালের ভয়াবহ ‘এসের’ উত্তরে ঝলসে উঠছে সিআর সেভেনের নাইকি মারকুউরিয়াল ভেপর। গল্পের সারমর্ম একটাই রোনাল্ডোর বুট পরলে ফুটবল মাঠটা উসেইন বোল্টের গতিতেই কভার করা যাবে!
কাট টু
ফরাসি কিংবদন্তি জিনেদিন জিদানের হাতে রেসিং কারের স্টিয়ারিং। গোঁ গোঁ গর্জন তুলে ভয়াবহ গতিতে তা ছুটছে। আর খালি পায়ে ওই ভয়ঙ্কর গতির সঙ্গে পাল্লা টানছেন কে? না, লিওনেল মেসি! ভুল হল, খালি পায়ে নয়, মেসির পায়ে আডিডাসের বুট। যা পরলে রেসিং কার কেন, আলোর গতির সঙ্গেও নাকি পাল্লা টানা অসম্ভব নয়।
|
বিজ্ঞাপনের দুনিয়ায় ফুটবলারদের জুতো-চর্চা মোটামুটি এই পর্যায়েই গিয়েছে হালফিলে। যেখানে স্পাইক বুট দিয়ে অনায়াসে দেওয়া যাচ্ছে টেনিস র্যাকেটের জবাব। অত্যাধুনিক স্পোর্টস কারে বসেও রেসে জিতবেন কি না জানা নেই, মেসি স্পোর্টস শু পরে ধরে ফেলতেও পারেন আপনাকে! ইউটিউবে এই বিভিন্ন অ্যাডের ভাবনা-চিন্তাগুলো আজগুবি ঠেকতে পারে, কিন্তু আধুনিক ফুটবলের পৃথিবীতে ঠিক যতটা জরুরি নিশ্ছিদ্র ট্যাকটিক্স, বিপক্ষকে জমি ধরানোর জন্য ঠিক যতটা প্রয়োজন ভিডিও অ্যানালিসিস, ঠিক ততটাই দরকারি এই ব্যাপারটাও।
বুট-বিজ্ঞান!
যুগে যুগে যেমন ফুটবল খেলার ধরন পাল্টেছে, ডাইরেক্ট ফুটবল থেকে তিকিতাকা হয়ে আবার নেইমারের ব্রাজিলের হাত ধরে ফুটবল-বিজ্ঞান পৌঁছাচ্ছে ডাইরেক্ট ফুটবলে, তেমনই বদলেছে ফুটবলারদের সরঞ্জাম। কিন্তু ফুটবল মাঠে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস কী? সবার মাথায় প্রথমে খেলার বলটাই আসবে। যদিও বেকহ্যামের বিশ্ববিখ্যাত ফ্রি কিক বা ইব্রাহিমোভিচের বিখ্যাত ‘জ্লাতান ফ্লিকের’ পিছনে তাঁদের মূল অস্ত্র একটাই খেলার বুট। ফুটবল গবেষকদের মতে বুটের জন্যই আজ এত অবিশ্বাস্য গোলের নজির দেখতে পারছে গোটা ফুটবল বিশ্ব। পেলের সময়ের কাঠের বুটের পরে এসেছে রোনাল্ডোর চেঞ্জার স্পাইক। বদলেছে বুটের নকশা, বুটের ওজন। কিন্তু আজও এই একটাই সরঞ্জাম মেসি, রোনাল্ডো, নেইমারদের সাহায্য করে যাচ্ছে মাঠে নিজেদের দাপট বজায় রাখতে। এ রকমই নতুন যুগের কয়েকটা অস্ত্র নীচে তুলে দেওয়া হল। |
নাইকি মারকুউরিয়াল
ভেপর ৯
(ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো) |
|
রোনাল্ডো |
বিশ্বের প্রসিদ্ধ স্পোর্টস ব্র্যান্ড নাইকির সবচেয়ে জনপ্রিয় বুট ব্র্যান্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে নাইকি মারকিউরিয়াল ভেপর। তেজিন লেদার দিয়ে তৈরি করা এই বুট মারকিউরিয়াল ভেপর-৮-এর থেকে অনেক বেশি হালকা। বুটের মধ্যে ‘স্পিড কন্ট্রোল লেয়ার’ আছে যা দু’টো ফাইবারগ্লাসে ভাগ করা। কিন্তু ‘নাইকির অল কন্ডিশন কন্ট্রোল’ থাকায় যে কোনও পরিবেশেই সমান গ্রিপ রাখা যাবে ফুটবলের ওপর। কোনও ফুটবল ম্যাচ শেষ হওয়ার দিকে ভেপরগুলো দুটো পা শক্ত হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতে পারে। ফলে কোনও ফুটবল ম্যাচের অন্তিম লগ্নেও সমান গতি পাওয়া যায়। সমস্যা একটাই, এক-দু’বার ট্রেনিং করার পরে পায়ে ‘ব্লিস্টার্স’ (ছড়ে যাওয়া) হতে পারে। সাম্প্রতিক কালে এই বুট পরে মাঠে দাপট দেখিয়েছেন রিয়াল মাদ্রিদ ও পর্তুগালের পোস্টার বয় রোনাল্ডো। |
|
|
আডিডাস আদিজিরো
এফ ফিফটি টি আর এক্স
(লিওনেল মেসি) |
মেসি |
রোনাল্ডোর বুট যতই প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে বিশ্বমানের হোক, মেসির অস্ত্র কোনও অংশে কম নয়। লাল আর সাদা রঙের কোলাজে এমনিতেই বুটের নকশা বিশ্বমানের। স্পিড-বুট পায়ের জন্য কখনই আরামদায়ক হয় না। কিন্তু এই ক্ষেত্রে অ্যাডিডাসের মেসি স্পেশ্যাল বুটকে ভিন্ন প্রকৃতির বুট বলা যায়। প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে সবচেয়ে বড় জিনিস হচ্ছে, মেসির বুটে আছে ‘স্প্রিন্টস্কিন ডুয়ালম্যাক্স আপার’। যার সাহায্যে বল ভাল চিপ করা যায়। সঙ্গে মাইক্রোফাইবার লেদার ফিনিশ থাকায় আরও জোরে ফ্রি কিক মারা যায়। অন্যান্য আডিডাস আদিজিরো বুটগুলোর থেকে বৃষ্টির মধ্যে বলের ওপর কন্ট্রোল রাখতে সাহায্য করে মেসির এই অত্যাধুনিক বুট। এ ছাড়াও এই বুটে শটের জোরও মারাত্মক হয়। |
নাইকি হাইপারভেনম
ফ্যান্টম
(নেইমার ও রুনি) |
|
|
নেইমার |
|
কনফেডারেশন কাপ মাতানোর পরে এখন ফুটবলবিশ্বের ম্যাপে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র নেইমার। অন্য দিকে সাম্প্রতিক কালে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠেছেন ওয়েন রুনি। যাঁদের বুট এখন রীতিমতো গবেষণার বিষয়। মারকিউরিয়াল ভেপর ছাড়া এখন নাইকির সবচেয়ে বড় ব্র্যান্ড হচ্ছে ‘হাইপারভেনম ফ্যান্টম’। হাইপারভেনম ফুটবলারদের গতি বাড়ানো ছাড়াও স্প্রিন্ট করতে সাহায্য করে। নেইমারই সেটা জানিয়েছেন। হাইপারভেনম তৈরি হয়েছে বিখ্যাত ‘নাইকি স্কিন’ দিয়ে। তা ছাড়া বুটে আছে পলিইউরেথান ফিল্ম সহ ‘নাইকি অল কন্ডিশন কন্ট্রোল’। যার সাহায্যে রোদ হোক বা বৃষ্টি, বুটের পারফরম্যান্স একই থাকবে। এ ছাড়াও বুটে আছে নাইলন যার সাহায্যে প্রচণ্ড জোরে শট মারতে সুবিধা হয়। বিশ্বের হালকা বুটের মধ্যে এটা অন্যতম। |
নাইকি সিটিআর
৩৬০ মায়েস্ট্রি
(আন্দ্রে ইনিয়েস্তা) |
এই বুট দিয়েই ইনিয়েস্তা দক্ষিণ আফ্রিকার বিশ্বকাপ জিতিয়েছিলেন স্পেনকে। প্রযুক্তিগত ভাবে নাইকি অল কন্ডিশন কন্ট্রোল ইন্ডিকেটর আছে যার সৌজন্যে খেলার পরে বুটের হিলে তার কন্ডিশন চেক করা যায়। মায়েস্ট্রি রেঞ্জের আগের বুটগুলোর থেকে সোলপ্লেট খুব পাতলা যার ফলে শটের জোর বেশি হয়। এ ছাড়াও বুটে নাইকি ক্যাঙ্গালাইট লেদার ব্যবহার করেছে যা দিয়ে সমান বল কন্ট্রোল থাকে ফুটবলারদের। কনিকাল সোলপ্লেটের জন্য ভাল গ্রিপ থাকে। যে কারণে এই বুটে চোটের সম্ভাবনা অনেক কম থাকে।
ফুটবলের আধুনিক এই বুট-অস্ত্রের সাহায্যে খেলা যে অনেকটা পাল্টেছে, মনে করছেন সত্তর দশকের প্রবাদপ্রতিম গোলকিপার ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়। “আমাদের সময় পেরেকের স্পাইক দিয়ে বুট তৈরি করা হত। বৃষ্টির সময় ভারী হয়ে যাওয়ায় খেলতে খুব কষ্ট হত। তখন ব্র্যান্ড বলে কিছু ছিল না। কিন্ত এখন দেখি আর ভাবি, কত পাল্টে গেছে বুট! কী সব বিশ্বমানের বুট পায়ে মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সবাই। অবশ্যই এখনকার বুট পরলে অনেক সুবিধে হত। মুভমেন্টও আরও ভাল হত। এখনকার বুট অনেক বেশি হালকা,” বলেন ভাস্কর। পাশাপাশি আধুনিক বুটে খেলা এক নতুন অনুভব সেই কথাই মনে করছেন ইস্টবেঙ্গল তারকা মেহতাব হোসেন। “যখন খেলা শুরু করি, তার চেয়ে এখন বুট অনেক পাল্টেছে। আধুনিক বুটগুলো খুব হালকা। শট মারতেও সুবিধা হয়। আরামদায়ক। তবুও বিদেশের সব বুট এখনও ভারতে পাওয়া যায় না। যার ফলে অনেক বুট ইন্টারনেটে দেখে পছন্দ হলেও কেনার কোনও উপায় নেই।” ময়দান চত্বরে ঢুঁ মেরে জানা গেল, ব্র্যান্ডেড বুটের চাহিদাও কম, তাই আসেও না বেশি। অর্থাৎ, বুট-বিশ্বায়ন এখনও ঢুকে পড়েনি ভারতের ফুটবলমক্কা কলকাতায়।
ঢুকে পড়লে ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে ১৪৬ নম্বরে বসে থাকতে হত কি না কে জানে! |
|