ছবিটা এ বারেও বদলাল না।
খেজুরি বা খানাকুল, দেওয়ানদিঘি বা কোতুলপুর ৩৪ বছরের শাসনে একতরফা ভাবে ভোটে জেতার যে ‘ঐতিহ্য’ রপ্ত করে ফেলেছিল বামেরা, তৃণমূলও তাতে পারদর্শী, এমনটাই বলছেন গ্রামবাসী। ওই সব এলাকার পঞ্চায়েতের বহু আসনই তৃণমূল ইতিমধ্যে জিতেছে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়।
রাজ্যে পালাবদলের আগে বামেদের বিরুদ্ধে ওই সব এলাকায় সন্ত্রাস চালানোর অভিযোগ তুলত বিরোধীরা। এ বার তৃণমূলের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ তুলেছেন বামেরা।
এক সময়ের ‘লালদুর্গ’ খানাকুলে প্রার্থীদের মারধর, তাঁদের বাড়িতে সাদা থানা পাঠানো, মনোনয়নে বাধা দেওয়া সিপিএম কিছুই বাদ রাখত না বলে অভিযোগ থাকত তৃণমূলের। সিপিএম কার্যত বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতত। ২০০৮ সালের ভোটে খানাকুলের দু’টি ব্লকই ছিল সিপিএমের দখলে। দু’টি পঞ্চায়েতের দু’টি আসনের একটিতে তৃণমূল, অন্যটিতে বিজেপি ক্ষমতায় ছিল।
আর এ বার?
খানাকুলের দু’টি ব্লকের সব পঞ্চায়েত, দু’টি পঞ্চায়েত সমিতি এবং পাঁচটি জেলা পরিষদ আসনে আগেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছে তৃণমূল। সোমবার ভোট হল শুধু জেলা পরিষদের একটি এবং ঘোষপুর পঞ্চায়েতের একটি আসনে। পঞ্চায়েতের ওই আসনে আবার ‘নির্দল’ হিসেবে লড়াই তৃণমূলেরই দুই নেতার। তবে, বহু দিন পরে ভোটের দিন অশান্তি না হওয়ায় খুশি এলাকাবাসী। তাঁরা মনে করছেন, “শান্তিটা জরুরি।” |
|
|
প্রদীপ তা-এর মা ও স্ত্রী। —নিজস্ব চিত্র |
|
আরামবাগের সিপিএম সাংসদ শক্তিমোহন মালিক অবশ্য বলেন, “এখানে যা হল তা একতরফা! তৃণমূলের সন্ত্রাস এবং মিথ্যা মামলার দাপটে দু’বছর ধরে খানাকুল-সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় রাজনৈতিক কাজকর্ম করতে পারছি না। খানাকুলেও এ বার প্রার্থী দিতে পারিনি। আমাদের প্রথম সারির অনেক নেতা ঘরছাড়া। ” কিন্তু ঠিক একই অভিযোগ তো তাঁদের আমলে তাঁদের বিরুদ্ধেও উঠত? সাংসদের জবাব, “তুলনা করে লাভ নেই। সেটা সার্বিক চিত্র ছিল না।”
পক্ষান্তরে খানাকুলের তৃণমূল নেতা শৈলেন সিংহ বলছেন, “পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাওয়ায় সিপিএম এ বার প্রার্থী দিতে পারেনি। সে কথা স্বীকার না করে আমাদের উপরে মিথ্যা অভিযোগ চাপাচ্ছে।”
বর্ধমানের দেওয়ানদিঘির সরাইটিকর পঞ্চায়েতেও এ বার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিততে চলেছে তৃণমূল। সেখানে এ দিন ভোট হল শুধু পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদ স্তরে। সরাইটিকর পঞ্চায়েতে গত বার ২২টি আসনের মধ্যে ১৭টিতেই জিতেছিল সিপিএম। সেই সময়ে এলাকার সিপিএম নেতা প্রদীপ তা’র দাপটে বাঘে-গরুতে একঘাটে জল খেত বলে গ্রামবাসীরা বলতেন। কিন্তু ২০১২-য় প্রদীপবাবু খুনের পরে সিপিএম কোণঠাসা হয়।
সোমবার সেই প্রদীপবাবুর মায়ের হাত থেকেই ব্যালট কেড়ে নিয়ে তাতে ঘাস-ফুলে ছাপ দিয়ে বাক্সে ফেলে দেওয়ার অভিযোগ উঠল তৃণমূল সমর্থকের বিরুদ্ধে। প্রদীপবাবুর মা ছায়ারানিদেবীর অভিযোগ, “টানা দু’ঘণ্টা বোঝানোর চেষ্টা হয়, আমার নাম ওই বুথে ভোটার তালিকায় নেই। অনেক ক্ষণ পরে এক যুবক আমাকে বুথে ঢোকায়। বুথে ঢুকে আমি পঞ্চায়েত সমিতির ব্যালট পেপার আর স্ট্যাম্প নিতেই ওই যুবক সে দু’টো কেড়ে নিয়ে ঘাসফুলে ছাপ মেরে দিল।” শেষে জেলা পরিষদের ভোট দিয়েই বুথ ছাড়েন বৃদ্ধা। প্রিসাইডিং অফিসার, ব্যান্ডেলের বাসিন্দা নির্মাল্য মুখোপাধ্যায় বলেন, “ভেবেছিলাম, এই যুবক বৃদ্ধার সঙ্গী। তাই তাকে ভোট দিতে দিয়েছি।” অন্য দিকে, মোটরবাইক-বাহিনী বাড়ির সামনে ঘোরাফেরা করায় তিনি ভোট দিতে যাওয়ার সাহস পাননি বলে অভিযোগ প্রদীপ তা-র স্ত্রী চিত্রলেখাদেবীর। বর্ধমান ১ ব্লক তৃণমূল সভাপতি তথা স্থানীয় পঞ্চায়েত সমিতির প্রার্থী কাকলি গুপ্তের পাল্টা দাবি, “প্রদীপ তা-র আমলে জনতার ভোটের দিন বাড়ির বাইরে বেরনোর অধিকার ছিল না। এখন মানুষ অবাধে ভোট দিচ্ছেন। মিথ্যা অভিযোগ তুলছে সিপিএম।”
একই ভাবে পাল্টেছে পূর্ব মেদিনীপুরের খেজুরিও।
২০০৮-এ খেজুরির দু’টি পঞ্চায়েত সমিতি, ন’টি পঞ্চায়েত-সহ জেলা পরিষদের চারটি আসনের মধ্যে তিনটি ছিল বামেদের। ‘লেনিন নগরী’ হিসাবে পরিচিত কামারদা পঞ্চায়েতের ১৩টি আসনেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতে সিপিএম। এ বার সেই কামারদা পঞ্চায়েতেই ১২টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছে তৃণমূল। মাত্র একটি আসনে লড়াই হচ্ছেতা-ও ‘বিক্ষুব্ধ’ তৃণমূলের সঙ্গে। খেজুরির দু’টি পঞ্চায়েত সমিতির মধ্যে একটা দখলে পেয়ে গিয়েছে তৃণমূল। আর মোট ১১টা গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ৯টিতে ইতিমধ্যেই সংখ্যাগরিষ্ঠ তারা।
৬৮টি গ্রাম পঞ্চায়েত, ১৭টি পঞ্চায়েত সমিতি আর ৪টি জেলা পরিষদ আসনে এ দিন ভোট হয় খেজুরিতে। দু’-এক জায়গায় বিক্ষিপ্ত ভাবে মারধর, বুথ দখলের অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। ইচ্ছে থাকলেও ভোট দিতে গ্রামে যেতে পারেননি খেজুরির দাপুটে সিপিএম নেতা হিমাংশু দাস। নন্দীগ্রাম নিখোঁজ মামলায় জামিন পেলেও আদালতের নির্দেশে এলাকায় ঢোকা বারণ তাঁর। তাঁর আক্ষেপ, “সন্ত্রাস করে অধিকাংশ আসন ছিনিয়ে নিয়েছে তৃণমূল। এটা গণতন্ত্রের পক্ষে লজ্জার।” অভিযোগ উড়িয়ে স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক রণজিৎ মণ্ডল দাবি করেন, “৩৪ বছর ধরে বামেরা সন্ত্রাস করেছে বলেই এ বার আর প্রার্থী পায়নি। নিজেদের কৃতকর্মের ফলকে চাপা দিতে ওরা সন্ত্রাসের মিথ্যে অভিযোগ করছে।”
তবে এলাকাবাসীর একটা বড় অংশের অভিজ্ঞতা, “পরিবর্তনের পরে অভিযোগকারী আর অভিযুক্তের জায়গাটুকুই যা বদলেছে।
|