কারও হাতে বঁটি, কারও কাটারি। কারও লাঠিই সম্বল। কেউ হাতের সামনে পাওয়া চেলা কাঠের টুকরোটা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন। আঁচল গোঁজা কোমরে, উস্কোখুস্কো চুল। আলুথালু শাড়ি।
সোমবার পঞ্চায়েত ভোটে মহিলাদের এই রুদ্রমূর্তিতেই দেখল আরামবাগের সালেপুর। সকলেই সিপিআই কর্মী-সমর্থক পরিবারের। সিপিআই এজেন্টদের উপরে তৃণমূলের ‘হামলা’র প্রতিবাদে এ দিন সিপিআইয়ের পুরুষ কর্মী-সমর্থকদের সামনে দেখা যায়নি। ‘ধর ধর’ করে তেড়ে গিয়েছেন গ্রামের মেয়ে-বউরাই। কেন্দ্রীয় বাহিনী, পুলিশের লাঠির সামনেও তাঁরাই রুখে দাঁড়িয়েছেন। লাঠির ঘা খেয়ে যন্ত্রণায় মুখ বেঁকিয়েও কেউ সেই লাঠিটাই চেপে ধরেছেন।
আরামবাগের এই একটি মাত্র পঞ্চায়েত (সালেপুর ১) দীর্ঘ দিন ধরে সিপিআইয়ের দখলে। সকাল পৌনে ৭টা নাগাদ রামনগর অবিনাশ হাইস্কুলের বুথে ঢুকতে যান সিপিএআই প্রার্থীদের এজেন্ট গোলকপতি পাড়ুই। অভিযোগ, তাঁকে মারধর করে বুথে ঢুকতে বাধা দেয় তৃণমূলের লোকজন। খবর শুনেই আশপাশের বেশ কিছু সিপিআই কর্মী-সমর্থক পরিবারের মহিলারা বেরিয়ে পড়েন। বঁটি-লাঠি নিয়ে প্রতিরোধের সামনে তখনকার মতো পিছু হঠে হামলাকারীরা। |
ফের উত্তেজনা ছড়ায় সকাল ১০টা নাগাদ। অভিযোগ, গোলকপতিকে বুথের ভিতরে ঢুকেই মারতে মারতে তুলে নিয়ে যায় তৃণমূলের কিছু লোক। খবর ছড়াতেই ফের ধেয়ে যায় প্রমীলা বাহিনী। কেন প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে না, সেই প্রশ্ন তুলে খেপে ওঠেন মহিলারা। শেষ পর্যন্ত ভোটদানে বাধা, বুথে হামলা, পুলিশকে হেনস্থার অভিযোগে গ্রেফতার হন গোলকের দিদি কল্পনা পাল, নমিতা দলুই-সহ ৪ জন। কল্পনাদেবী পরে বলেন, “বাড়ির পুরুষমানুষরা কেউ বেরোতে সাহস পাচ্ছে না। তাই আমরা জনা কুড়ি মেয়েই রাস্তায় নেমে পড়েছিলাম।”
মহিলাদের এমন রণংদেহি মূর্তি অন্যত্র দেখা না গেলেও সামগ্রিক ভাবে এ বার পঞ্চায়েত ভোটে মহিলাদের সক্রিয়তা চোখে পড়ার মতো। ৫০ শতাংশ আসন সংরক্ষণের জন্য এমনিতেই মহিলা প্রার্থীর সংখ্যা অন্য বারের তুলনায় বেশি। সেই কারণে মহিলা ভোটারের সংখ্যাও বেশি বলে মনে করছেন অনেকে। মহিলা ভোটাররাও সে কথা মানছেন। যেমন গোঘাটের রঘুবাটি পঞ্চায়েতের ভোটার কল্পনা রায় বলেন, “ঘরকন্না সামলে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়েছি ভোট দিতে। গত দু’বার ভোট দিতে আসতে পারিনি। এ বার মনে হল সব দলের প্রার্থীই তো আশেপাশের বাড়ির মেয়ে। ভোটটা না দিলে চলবে কেমন করে?” বর্ধমানের রায়নার বেলসরের আলমা বিবি বলেন, “গ্রামের উন্নয়নের কাজটা মহিলারা ভালই পারবেন। তাই ভোটের দিন সব ফেলে বুথে লাইন দিয়েছি।” মেদিনীপুর সদর ব্লকের বাসিন্দা যমুনা মাহাতো, শ্যামলী করের মতো ভোটারদের মতে, “এ বার প্রচুর মহিলা প্রার্থী। মহিলাদের কাজ করার সুযোগ বাড়বে।” |
হিসেব বলছে, পঞ্চায়েত ভোটের প্রথম দফায় পশ্চিম মেদিনীপুরে ভোটদানে মহিলারাই এগিয়ে। জেলায় ভোট পড়েছে সব মিলিয়ে ৮৫.৯০%। এর মধ্যে পুরুষ ভোটদানের হার ৮৪.৮৫%। মহিলাদের ভোটদানের হার ৮৭.০১%। সব থেকে বেশি মহিলা ভোট দিয়েছেন কেশিয়াড়িতে, ৯১.৭৮%। সব থেকে কম মহিলা ভোট দিয়েছেন পিংলায়, ৮১.৩৪%। জেলার নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দীপক ঘোষও মানছেন, “মহিলারা দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ভোট দিয়েছেন। এটা ভাল দিক।” বাঁকুড়ায় ভোটদানের হার ছিল প্রায় ৮৬ শতাংশ। সেখানেও মেয়েদের ভোটদানের হার পুরুষদের কাছাকাছি। আরামবাগেও মহিলাদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। চাঁদিফাটা গরমে অনেকে দীর্ঘ ক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন ভোটের লাইনে। সমাজকর্মী শাশ্বতী ঘোষ মনে করেন, ৫০ শতাংশ আসন সংরক্ষণের প্রভাব তো আছেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিও মহিলাদের সামনে এগিয়ে আসার আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে।
|