বর্ধমানে দুই সিপিএম নেতাকে খুনের অভিযোগে ধৃত ৪ জন যে তৃণমূলেরই নেতা-কর্মী, তা নিয়ে ‘সংশয়’ নেই দেওয়ানদিঘির মানুষের। দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীরাও সে কথা মানছেন। বৃহস্পতিবার ধৃতদের হয়ে তৃণমূলের আইনজীবীদের আদালতে হাজির থাকতেও দেখা গিয়েছে। বর্ধমান জেলা পুলিশের কর্তারা অবশ্য এ দিনও ধৃতদের ‘রাজনৈতিক পরিচয়’ নিয়ে মুখ খুলতে চাননি। কিন্তু কোন পরিস্থিতিতে একদা ‘লালদুর্গ’ বর্ধমান শহরের উপকণ্ঠে খুন হতে হল প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক প্রদীপ তা এবং সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য কমল গায়েনকে? ঘটনাস্থল থেকে ধৃতদের সঙ্গে তাঁদের ‘বিরোধের’ সূত্রপাতও বা কোথা থেকে?
পুলিশের একাংশ ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, বুধবার সকালে চারদিকে তৃণমূলের লোকজন জড়ো হচ্ছে দেখে ঘটনাস্থলে উপস্থিত বর্ধমান থানার এক এসআই প্রদীপবাবুকে দেওয়ানদিঘি মোড়ে মিছিল নিয়ে যেতে বারণ করেন। অভিযোগ, প্রদীপবাবু ওই এসআইয়ের সঙ্গে ‘দুর্ব্যবহার’ করেন। তৃণমূলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের একাংশ দাবি করেছেন, প্রদীপবাবুর সঙ্গে ‘সশস্ত্র’ লোকজন ছিল। যা দেখে ‘আতঙ্কে’ পাল্টা হামলা হয়। প্রাক্তন বিধায়কের দেহে সাড় নেই বুঝেও তাঁর দেহের উপর ইট, লাঠি, বোল্ডারের আঘাত করা হয়। কমলবাবু ঘটনাস্থলে পৌঁছলে তাঁকেও এক আততায়ী বাঁশের ঘা বসিয়ে দেয়। কমলবাবু পড়ে যেতেই প্রদীপ তা-কে যারা মারধর করছিল, তারা আবার ওই ব্যক্তিকে গালিগালাজ শুরু করে। জেলা পুলিশের এক কর্তার কথায়, “ওই ঘটনাতেই স্পষ্ট, প্রদীপই ছিলেন হামলাকারীদের মূল লক্ষ্য।” জেলা পুলিশের একটি সূত্র আবার দাবি করেছে, বুধবার প্রদীপবাবুকে ঘিরে ফেলেছিল যারা, তাদের মধ্যে কয়েকজনকে বিধানসভা ভোটের আগেও সিপিএমের সঙ্গেই দেখা যেত। |
এলাকায় প্রদীপ তা ছিলেন সিপিএমের তথা সিটুর ‘দাপুটে নেতা’। তাঁর নেতৃত্বে এলাকার বিভিন্ন ছোট ও মাঝারি শিল্পে চলত শ্রমিক আন্দোলন। তা অনেক সময়ই চেহারা নিত ‘জঙ্গি আন্দোলনে’র। বছরখানেক আগে স্থানীয় তিনটি ফেরো-অ্যালয় কারখানায় হানা দিয়ে আরপিএফের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স বেশ কিছু চোরাই লোহা আটক করে। অভিযোগ, প্রদীপ তা-র নেতৃত্বেই সিপিএমের কর্মীরা ওই টাস্কফোর্সকে রাতভর আটকে রাখে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন রেলমন্ত্রী। এই ঘটনার পরে এলাকায় তৃণমূল-সিপিএমের সঙ্ঘাত ‘অন্য মাত্রা’ পায়। স্থানীয় এক তৃণমূলের নেতার অভিযোগ, “প্রদীপ তা সন্ত্রাসের জন্য কুখ্যাত। শুধু বিরোধী রাজনীতি করায় কত লোককে যে উনি গ্রামছাড়া করেছেন, তার ইয়ত্তা নেই।”
তৃণমূলের স্থানীয় নেতৃত্বের দাবি, শ্রমিকদের পাওনা-গণ্ডা আদায়ের নামে টাকার একটা বড় অংশ ‘আত্মসাৎ’ করতেন প্রদীপ। সেই জন্যই তাঁরই অনুগামীদের একাংশ খেপে ওঠে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই লোকসভা ভোটের পরে এলাকায় সিটুর পায়ের নীচে ‘মাটি সরতে’ শুরু করে। কারখানায় বা শিল্প প্রতিষ্ঠানে শুরু হয় তৃণমূলের সাংগঠনিক শক্তিবৃদ্ধি। তৃণমূলের সেই ‘সাফল্যে’ ভূমিকা ছিল দেওয়ানদিঘি এলাকার দীর্ঘ দিনের নেতা পতিতপাবন তা-র। প্রদীপ হত্যার ঘটনায় ধরা পড়েছেন পতিতপাবনবাবু। অন্য ধৃতদের মধ্যে ছোটন চক্রবর্তী, ভূপাল গোস্বামীরা এলাকায় পতিতপাবনবাবুর অনুগামী বলে পরিচিত। সুরজিৎ পতিতপাবনবাবুর ছেলে। এফআইআরে নাম থাকা বাকি ১৮ জনও অনেক দিন ধরেই এলাকায় তৃণমূলের কর্মী বা সমর্থক বলে পরিচিত।
সিপিএম সূত্রের দাবি, তৃণমূলের ‘বাড়বাড়ন্ত’ রুখতে গিয়ে প্রদীপবাবু আগেও নিগ্ৃহীত হয়েছেন দেওয়ানদিঘি এলাকাতেই। বার দুই তাঁর উপরে ‘হামলার চক্রান্ত’ ব্যর্থ হয়। তেমনই এক হামলার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছিলেন স্থানীয় তৃণমূল নেতা ছোটন ঘোষ। প্রদীপবাবুর হত্যাকাণ্ডের এফআইআরে নাম থাকা বিপদতারণ তা-কেও ওই ‘হামলা’র ঘটনায় আদালতে আত্মসমর্পণ করতে হয়। তৃণমূলের নেতাদের দাবি, এ ধরনের নানা ‘মিথ্যা অভিযোগে’ পুলিশ ‘লেলিয়ে’ এলাকার তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের জীবন ‘অতিষ্ঠ’ করে তুলেছিলেন ওই সিপিএম নেতা।
তবে তৃণমূলের বর্ধমান ১ ব্লক কমিটির সভাপতি দেবনারায়ণ গুহ বলেন, “এই ঘটনাটা ঘটতে দেওয়া উচিত হয়নি আমাদের। যে-ই ওই দু’জনকে খুন করে থাকুক না কেন, আমাদের যে কর্মীরা সেখানে উপস্থিত ছিল, তাদের উচিত ছিল অন্যদের থামানো। তবে প্রদীপবাবু পুলিশের বারণ শুনলে এমন ঘটত না। আমরা চাই, পুলিশ নিরপেক্ষ তদন্ত করুক। যদি আমাদের কেউ এই ঘটনায় জড়িত হয়ে থাকে, তা হলে তাঁকেও গ্রেফতার করুক পুলিশ।” তবে প্রদীপবাবুর বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগই নস্যাৎ করে দিয়েছেন দলের বর্ধমান জেলা কমিটির সম্পাদক অমল হালদার। তিনি বলেন, “ওঁকে পিটিয়ে খুন করে নিজেদের বাঁচাতে এই সব গালগল্প রটাচ্ছে তৃণমূলের লোকেরা। তবে প্রদীপ তা-র নেতৃত্বে ওই এলাকা থেকে প্রচুর লোক বিগ্রেডের সভায় গিয়েছিলেন। তাঁকে এলাকায় মিছিল করতে দেখে তৃণমূলের লোকেদের আতঙ্ক হয় যে সিপিএম প্রদীপবাবুর নেতৃত্বে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। তাই ওরা প্রদীপ তা-কে আক্রমণ করেছিল। এখন যা তা বলে বাঁচার চেষ্টা করছে। মৃত ব্যক্তি তো প্রতিবাদ করবেন না।”
প্রদীপবাবুর ভাই প্রবীর ২২ জনের নামে এফআইআর দায়ের করেছেন। তাতে বলা হয়েছে, ‘পূর্ব প্রতিহিংসাবশত ও পরিকল্পিত ভাবে’ খুন করা হয়েছে তাঁর দাদাকে। একই অভিযোগ নিহতের স্ত্রী চিত্রলেখা দেবীরও। তিনি বলেন, “যে ভাবে আমাদের মা-মেয়েকে বাড়িতে আটকে, ফোনের লাইন কেটে তড়পাচ্ছিল তৃণমূলের লোকেরাপরিকল্পনা ছাড়া এটা হয় না।”
এ দিন আদালত চত্বরে উপস্থিত প্রদেশ
তৃণমূলের নেতা অলোক দাস অবশ্য বলেন, “বেছে-বেছে আমাদের লোকেদের নাম ওই হত্যা-মামলায় ঢোকানো হয়েছে।” |