ঊনত্রিশ বছর আগে খুনের অভিযোগ করেছিলেন যাঁরা, সেই পরিবারের সদস্যেরাই এখন খুনে অভিযুক্ত!
১৯৮২ সালের ১১ অগস্ট বর্ধমানের দেওয়ানদিঘির ডিভিসি খালের লাগোয়া ভোতার পাড়ে পিটিয়ে, থেঁতলে খুন করা হয়েছিল কংগ্রেস বিধায়ক কাশীনাথ তা-কে। প্রাক্তন সেই বিধায়কের হত্যায় অন্যতম অভিযুক্ত ছিলেন বুধবার নিহত প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক প্রদীপ তা। যদিও আদালতে তিনি বেকসুর খালাস পান। কাশীনাথবাবুরই জামাই তাপস গুপ্ত এবং তাঁর ছেলে সন্দীপ আবার প্রদীপ তা খুনে অন্যতম অভিযুক্ত। ওই সিপিএম নেতার ভাই প্রবীরবাবু বুধবার বর্ধমান থানায় যে অভিযোগ দায়ের করেছেন তাতে অভিযুক্ত ২২ জনের তালিকায় রয়েছেন বাবা ও ছেলে।
কাশীনাথবাবুর মেয়ে তথা সন্দীপের মা কাকলি গুপ্তর দাবি, “বুধবার আমার স্বামী বা ছেলে, কেউই ঘটনাস্থলের ধারেকাছে ছিলেন না।” তাঁর বক্তব্য, পশুপালন দফতরের কর্মী তাপসবাবু ভাতারে গিয়েছিলেন দফতরের কাজে। আর, সন্দীপ একটি বেসরকারি সংস্থায় কলকাতায় কর্মরত। বছর ষাটের বৃদ্ধার প্রশ্ন, “কী করে ওই দু’জনের নাম অভিযুক্তদের তালিকায় উঠল?” বৃহস্পতিবার ওই দু’জন কোথায় তা অবশ্য বলেননি বৃৃদ্ধা। তবে এ দিন সকালে বর্ধমানের পুলিশ সুপার সৈয়দ মহম্মদ হোসেন মির্জার সঙ্গে দেখা করেন তিনি। আবেদন ছিল, স্বামী এবং ছেলের নামটা যেন অভিযুক্তের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। পুলিশ সুপার অবশ্য বলেন, “ওঁর আবেদন খতিয়ে দেখা হবে। তদন্ত না করে তো কিছু করতে পারব না।” |
১৯৮২-র সেই দিনটা এখনও স্পষ্ট মনে আছে কাকলিদেবীর। তাঁর স্মৃতিচারণ, “সন্দীপের তখন মাস দশেক বয়স। তাকে কোলে নিয়েই বেড়াতে বেরিয়ে খুন হয়েছিলেন বাবা। শুধু তাই নয়, বাবাকে খুন করে ওরা ছেলেকেও লোপাট করে দিয়েছিল প্রায়। সিপিএমের পার্টি অফিসে আটকে রাখা ছেলেকে আমার হাতে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সিপিএমের এক প্রবীণ নেতা।” কাকলিদেবীর দাবি, প্রদীপ তা-ই তাঁর বাবা, কাশীনাথবাবুর গলায় হাঁসুয়ার কোপ মেরে ছিলেন। কিন্তু আদালতে তা হলে সে কথা জানাননি কেন? কাকলিদেবীর জবাব, “সিপিএমের চাপে আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দিতে পারিনি।” বৃদ্ধার দাবি, তাঁর বাবার সঙ্গে সে দিন ছিলেন তৎকালীন কংগ্রেস নেতা গোলাম জার্জিস। তাঁকেও খুন করার চেষ্টা হয়। বৃ্দ্ধার কথায়, “আমি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে দাবি জানাব, কাশীনাথ তা হত্যাকাণ্ডের মামলা নতুন করে শুরু হোক। তা হলেই সে দিনের অভিযুক্তেরা সাজা পাবেন।”
কাকলিদেবীর কথা সমর্থন করেছেন বর্তমানে তৃণমূলের বর্ধমান জেলা কমিটির অন্যতম সম্পাদক গোলাম জার্জিস। তিনি বলেন, “আজও চোখ বুজলেই কাশীদার খুনটা দেখতে পাই। সে দিন ওঁর বাড়িতে গিয়েছিলাম ১৫ অগস্টের অনুষ্ঠান নিয়ে আলোচনা করতে। পরে নাতিকে কোলে নিয়ে আমার সঙ্গে দেওয়ানদিঘির মোড়ের দিকে যাচ্ছিলেন উনি। হঠাৎ রাস্তায় সিপিএমের লোকজন আমাকে মারধর শুরু করে।”
আহত জার্জিসকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিলেন কাশীবাবু। জার্জিস বলেন, “আমাকে একটা ভ্যানরিকশায় তুলে বর্ধমান শহরের দিকে রওনা হয়েছিলেন কাশীদা। ভোতার পাড়ের কাছে আসতেই সিপিএমের লোকজন সাইকেলে চেপে এসে ঘিরে ধরল আমাদের। তাদের মধ্যে প্রদীপবাবু ছিলেন। কাশীবাবুকে ওঁরা টেনে সেচ খালের দিকে নিয়ে যান। কাশীদা বললেন, ‘জার্জিস পালা’। প্রদীপ তা সেই সময়ে চেঁচিয়ে বলেছিলেন, ‘এ বার ছোকরাটাকে নিয়ে আয়’। আমি কোনও মতে সিপিএমের লোকেদের হাত ছাড়িয়ে পালাই।”
সিপিএমের বর্ধমান জেলা কমিটির সম্পাদক অমল হালদার অবশ্য বলেছেন, “প্রদীপকে জোর করে ওই হত্যাকাণ্ডে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরে আদালতের রায়ে তিনি খালাস পান।” দলের বধর্মান জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য গণেশ চৌধুরীর দাবি, “কাশীনাথ তা-র জামাই এবং নাতি এলাকায় তৃণমূল কর্মী হিসেবে পরিচিত। প্রদীপ হত্যায় ওঁরা জড়িত। পুলিশের তদন্তে তা প্রমাণও হবে।” |