অভিযোগ অসৌজন্য নিয়েও, সূর্যকান্তরা রাজভবনে
র্ধমানে দুই সিপিএম নেতার নিহত হওয়ার ঘটনার পর দিন রাজ্য রাজনীতি আলোড়িত হল জোড়া বিতর্কে। নিহত প্রাক্তন বিধায়ক প্রদীপ তা-র মরদেহে শ্রদ্ধা জানানোর অনুষ্ঠানে বিধানসভার ভিতরে ‘চূড়ান্ত অব্যবস্থা’ ছিল বলে অভিযোগ করলেন বিরোধীরা। স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, মন্ত্রী ও শাসক শিবিরের কোনও বিধায়ক প্রদীপবাবুর মরদেহে মালা দিতে উপস্থিত না-থাকার প্রতিবাদে বিধানসভা ভবনের বাইরে রাস্তায় শেষ শ্রদ্ধা জানালেন বিরোধী দলনেতা-সহ বামফ্রন্টের বর্তমান ও প্রাক্তন বিধায়কেরা।
এরই পাশাপাশি, বর্ধমানে দুই নেতার হত্যার ঘটনায় ধৃত চার জনকে পুলিশি হেফাজতে নেওয়ার জন্য বৃহস্পতিবার রাজ্য সরকারের তরফে আদালতে আবেদনই করা হয়নি। সরকারের এই ‘আচরণে’ প্রকৃত তদন্ত ‘ক্ষতিগ্রস্ত এবং প্রভাবিত’ হতে পারে বলে অভিযোগ জানাতে এ দিনই সন্ধ্যায় রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনের দ্বারস্থ হয়েছিল বিরোধী বামফ্রন্টের পরিষদীয় দল। তাদের অভিযোগ, পার্ক স্ট্রিটের মতোই বর্ধমানের ঘটনাতেও গোড়া থেকেই তদন্তের গতি ‘প্রভাবিত’ করার চেষ্টা হচ্ছে সরকারি তরফে।
বিধানসভায় প্রদীপ তা-কে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রর।
দুই ঘটনার মধ্যে বিধানসভার বিতর্কে চাপানউতোর তুঙ্গে। বিধানসভার বিগত শীতকালীন অধিবেশনেই সরকার ও বিরোধী পক্ষের মধ্যে ‘সৌর্হাদ্যে’র পরিবেশ ধাক্কা খেয়েছিল। প্রদীপবাবুর মরদেহ ঘিরে এ দিনের ঘটনায় তা আরও তলানিতে। বিরোধীদের অভিযোগ, নিহত প্রাক্তন বিধায়কের প্রতি ‘চরম অসৌজন্য’ দেখানো হয়েছে। অভিযোগ খারিজ করে স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘যথাযথ ব্যবস্থা’ই রাখা হয়েছিল। বিরোধীরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে ‘মৃতদেহ নিয়ে রাজনীতি’ করছে বলে পাল্টা অভিযোগ তুলেছে শাসক শিবির।
বস্তুত, সিপিএমের বক্তব্য, প্রাক্তন বিধায়ক বলেই প্রদীপবাবুর দেহ আনা হয়েছিল কলকাতায়। বৌবাজারের শব সংরক্ষণাগার থেকে বার করে সিপিএম, ডিওয়াইএফআই এবং সিটুর রাজ্য দফতর ঘুরে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় বিধানসভা ভবনে। বামফ্রন্টের বর্তমান ও প্রাক্তন বিধায়কেরা সেখানে আগেই হাজির ছিলেন। তাঁদের দাবি, মরদেহ রাখার জন্য প্রথামাফিক টেবিলে সাদা চাদর পেতে রাখাও হয়েছিল। শবদেহবাহী গাড়িটিকে বিধানসভায় ঢোকানোর জন্য তাঁরা ফটকের সামনে যান। ফিরে এসে দেখেন টেবিল নেই! সরকারি তরফে কোনও জনপ্রতিনিধিও উপস্থিত নেই। বিধানসভার সচিব যাদবলাল চক্রবর্তী এবং মার্শাল অবশ্য মরদেহে মালা দেন। স্পিকার-সহ সরকারি পক্ষের কেউ শ্রদ্ধা জানাতে না-আসায় ‘ক্ষুব্ধ’ বিরোধীরা প্রদীপবাবুর দেহ বিধানভার ফটকের বাইরে নিয়ে গিয়ে শববাহী গাড়িতেই মালা দেন।
দৃশ্যতই ক্ষুব্ধ বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র অভিযোগ করেন, “মৃত্যুর পরেও দলতন্ত্র! নিহত প্রাক্তন বিধায়কের প্রতি চরম অসৌজন্য দেখানো হল!” মরদেহে শ্রদ্ধা অর্পণ করে বিধানসভার প্রাক্তন স্পিকার হাসিম আব্দুল হালিম বলেন, “এমন ঘটনা আগে ঘটেনি, ঘটা উচিতও নয়।” সিপিআই সাংসদ গুরুদাস দাশগুপ্তের মন্তব্য, “আমানবিক, অসাংস্কৃতিক এবং পশ্চিমবঙ্গের পরম্পরা-বিরোধী। মৃত্যুর পরেও এ ভাবে অসম্মান করতে হবে?”
যাবতীয় অভিযোগই অবশ্য খারিজ করে দিয়েছেন স্পিকার বিমানবাবু। তাঁর বক্তব্য, “সচিবালয় থেকে বুধবার খবর পেয়েছিলাম, বৃহস্পতিবার মরদেহ নিয়ে আসা হতে পারে। এ দিন সকালে সচিবের কাছেই জানতে পারি, সকাল ১০টা নাগাদ মরদেহ আনা হচ্ছে। আমার পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি ছিল। আগে জানলে হয়তো সেটা বাতিল করে আসতে পারতাম। কিন্তু মার্শালকে বলেছিলাম, সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যে বিধানসভার সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্মীরা যেন থাকেন। সেইমতোই সব ব্যবস্থা হয়েছিল। কোনও অসুবিধা হয়নি।”
টেবিল-বিতর্ক? স্পিকারের জবাব, “আমি দায়িত্ব নেওয়ার পরে দুই প্রয়াত প্রাক্তন বিধায়কের দেহ (সত্য বাপুলি ও শিশির সেন) এসেছিল এখানে। কোনও ক্ষেত্রেই টেবিল রাখা হয়নি। গাড়িতেই মালা দেওয়া হয়েছিল।” কিন্তু প্রয়াত
প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের সময় তো রবিবার বিধানসভা খুলে টেবিল পেতে সব ব্যবস্থা হয়েছিল? স্পিকার বলেন, “আমি শুধু আমার দায়িত্ব নেওয়ার পরের সময়ের কথা বলছি।”
‘সময়ে’ খবর পাননি বলে যে অভিযোগ স্পিকার করেছেন, তার পুনরাবৃত্তি শোনা গিয়েছে তৃণমূল ও কংগ্রেস বিধায়কদের মুখেও। প্রবীণ কংগ্রেস বিধায়ক জ্ঞানসিংহ সোহনপাল (চাচা) এ দিন সকাল থেকেই বিধানসভায় ছিলেন। কিন্তু ‘খবর’ পাননি বলে তিনি শ্রদ্ধা জানাতে যেতে পারেননি। যদিও বিধানসভার সচিব জানিয়েছেন, কোনও বারই এমন ক্ষেত্রে আলাদা করে কাউকে ‘খবর’ দেওয়া হয় না। পরিষদীয় সূত্রেই বিধায়কেরা জেনে যান। ‘সময়’ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও বিধানসভার কর্মীরা কিন্তু মরদেহ আসা মাত্রই বেরিয়ে এসে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। মরদেহ নিয়ে গাড়ি বেরিয়ে যাওয়ার অল্প ক্ষণ পরেই বিধানসভায় ঢোকেন স্পিকার।
বিধানসভা ভবনে আনা হল নিহত প্রাক্তন বিধায়কের দেহ। বৃহস্পতিবার।
এর সঙ্গেই যোগ হয় ছবি তোলা নিয়ে বিতর্ক। বিধানসভার ভিতরে ক্যামেরা নিয়ে ঢোকার উপরে নিষেধাজ্ঞা আছে। তবে কোনও প্রয়াত জনপ্রতিনিধির মরদেহ এলে সচরাচর ওই নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকে না। কিন্তু এ দিন প্রদীপবাবুর মরদেহ বিধানসভায় এসে পৌঁছলে চিত্র সাংবাদিকদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। স্পিকারও সেখানে নেই দেখে তাঁকে ফোন করেন সিপিএম বিধায়ক আনিসুর রহমান। তাঁর বক্তব্য, স্পিকার তাঁকে জানান, তিনি ‘অপারগ’। পরে স্পিকার নিজেও বলেন, ক্যামেরা নিয়ে ঢোকা এবং মিডিয়া সেন্টার ব্যবহার নিয়ে যে হেতু একটি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে এবং তা এখনও পুনর্বিবেচনা করা হয়নি, তা-ই এই নিয়ে তাঁর কিছু করার ছিল না। প্রসঙ্গত, আজ, শুক্রবার বিধানসভা ভবনে প্রাক্তন ডেপুটি স্পিকার হরিদাস মৈত্রের তৈলচিত্র উদ্বোধন করতে যাওয়ার কথা মুখ্যমন্ত্রীর। হরিদাসবাবু রাজ্যের বর্তমান অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের বাবা। প্রদীপবাবুর দেহ নিয়ে বিতর্কের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর ওই অনুষ্ঠানে ছবি তোলার অনুমতি দেওয়া হয় কি না, সে দিকে নজর রাখছে বিরোধী শিবির।
সন্ধ্যায় রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে বিরোধী দলনেতা সূর্যবাবু বলেন, “ওঁকে সর্বশেষ পরিস্থিতি অবহিত করেছি। উনি অনেকটাই জানেন। খুব বিশদে বলতে হয়নি। তবে বর্ধমানে এত বড় একটি ঘটনায় ধৃতদের যে ভাবে পুলিশি হেফজাতে নেওয়ার আবেদন জানানোই হয়নি, সেই বিষয়ে অবহিত করেছি। ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম বুধবার। ৭ জন পুলিশ উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও যে ভাবে ঘটনা ঘটেছে, তার পরেও যে ভাবে রাজনৈতিক চাপ দেওয়া হচ্ছে, সবই বলেছি।” প্রসঙ্গত, বিরোধীরা যাওয়ার আগেই এ দিন এক অনুষ্ঠানের অবসরে বর্ধমান ও পার্ক স্ট্রিটের ঘটনা নিয়ে মুখ খুলেছিলেন রাজ্যপাল। বিরোধী দলনেতার আরও অভিযোগ, “পার্ক স্ট্রিট বা বিষ মদ হোক, বর্ধমান হোক, ধারাবাাহিক ভাবে দায়িত্বজ্ঞানহীন বিবৃতি দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী ও অন্য মন্ত্রীরা। তদন্ত এতে ব্যাহত হতেই পারে। এই সব বিবৃতির মানে বুঝতে কি অসুবিধা হয়?” সূর্যবাবুদের অব্যবহিত আগেই রাজভবনে গিয়ে রাহুল সিংহের নেতৃত্বে বিজেপি-র ১৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল পার্ক স্ট্রিট ও বর্ধমানের ঘটনার কথা তোলে।
এ সবের আগে সকালে আলিমুদ্দিনে প্রদীপবাবুর মরদেহে শ্রদ্ধা জানান প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু, ফরওয়ার্ড ব্লকের সাধারণ সম্পাদক দেবব্রত বিশ্বাস-সহ বাম নেতারা। বিমানবাবু সেখানে বলেন, “নৈরাজ্যের পথেই চলেছে রাজ্য। প্রতিবাদে মুখর হতে হবে। মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যের উপরে কিছু বলব না। তবে এটা বোঝা যাচ্ছে, বর্ধমানের হত্যাকাণ্ড নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী যা বলেছেন, তার সঙ্গে বাস্তবের মিল নেই!” গোটা পরিস্থিতি এবং পরবর্তী কর্মসূচি আলোচনার জন্য আজ, শুক্রবারই বামফ্রন্টের বৈঠক ডেকেছেন বিমানবাবু। আলিমুদ্দিনে এ দিন সন্ধ্যায় সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠকেও গোটা পরিস্থিতির রিপোর্ট দিয়েছেন সূর্যবাবু।

বৃহস্পতিবার অশোক মজুমদারের তোলা ছবি।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.