|
|
|
|
ধৃতদের পাশে তৃণমূল নেতারা, পুলিশের ভূমিকায় নয়া বিতর্ক |
রানা সেনগুপ্ত • বর্ধমান |
মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন ‘সিপিএমের অন্তর্দ্বন্দ্ব’, তাঁর মন্ত্রীরা বলেছিলেন ‘স্বতঃস্ফূর্ত জনরোষের শিকার’। ফলে বুধবার দুই সিপিএম নেতাকে পিটিয়ে খুনের ঘটনায় যে চার জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, তাঁদের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে ‘সংশয়’ ছিল। কিন্তু বৃহস্পতিবার ওই চার অভিযুক্তের
হয়ে জামিনের আবেদন জানাতে আদালতে হাজির হলেন তৃণমূলের আইনজীবী সেলের তাবড় নেতারা। আদালত চত্বরে ছিলেন এমনকী তৃণমূল বিধায়কও। পাশাপাশি, ধৃতেরা খুনের ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে বলে জানিয়ে দিলেন ওই মামলার সরকারি আইনজীবী। একই কথা বললেন বর্ধমানের
পুলিশ সুপারও।
আর এই ‘কবুলের’ জেরে ধৃতদের পুলিশ হেফাজতে নেওয়ার দাবিই জানাল না সরকার পক্ষ। যা জন্ম দিল নতুন বিতর্কের।
ধৃত ভূপাল গোস্বামী, ছোটন চক্রবর্তী, পতিতপাবন তা এবং তাঁর ছেলে সুরজিৎ তা-কে এ দিন ১৪ দিনের জেল হাজতের নির্দেশ দেন বর্ধমানের ভারপ্রাপ্ত সিজেএম ভাস্কর মজুমদার। খুনের অভিযুক্তদের পুলিশ হেফাজত কেন হল না, তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সরকারি আইনজীবী সৈয়দ এ রহমান বলেন, “পুলিশ হয়তো ওদের হেফাজতে নেওয়ার দরকার মনে করেনি। তা ছাড়া, পুলিশ যে রিপোর্ট আদালতে পেশ করেছে, তাতে বলা হয়েছে ওই চার জন এই হত্যাকাণ্ডে নিজেদের জড়িত থাকার কথা কবুল করেছেন। এমন হয়ে থাকলে ওঁদের তো পুলিশ হেফাজতে নেওয়ার দরকার নেই!” |
|
আদালতের পথে ধৃতরা। বৃহস্পতিবার। ছবি: উদিত সিংহ |
বর্ধমান জেলা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি সুব্রত হাটিরও মন্তব্য, ‘‘৩০২ ধারার মামলা হলেই যে পুলিশকে অভিযুক্তদের নিজেদের হেফাজতে নিতে হবে, তার কী মানে আছে? এ ব্যাপারে পুলিশ যা ভাল মনে করবে, আদালতের কাছে তা-ই জানাবে। সরকারি আইনজীবী তো আর অভিযুক্তদের পুলিশ হেফাজতে নেওয়ার কথা বিচারককে বলতে পারেন না!”
বর্ধমানের পুলিশ সুপার সৈয়দ মহম্মদ হোসেন মির্জার দাবি, “খুনের ঘটনার কিছু ক্ষণ পরেই ওই চার জনকে ধরা হয়। তার পর গত ২৪ ঘণ্টায় ওঁদের টানা জেরা করা হয়েছে এবং খুনের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা তাঁরা কবুলও করে নিয়েছেন। তা ছাড়া, দরকার হলে ওঁদের ফের জেরা করতে পারে পুলিশ। তাই এ দিন আর ধৃতদের পুলিশি হেফাজতে নিতে চাওয়া হয়নি।”
সরকার পক্ষের এই যুক্তি অবশ্য মানতে চায়নি সিপিএম। দলের জেলা সম্পাদক অমল হালদার বলেন, “এই তো ওদের প্রশাসনের নিরপেক্ষতার নমুনা! অভিযুক্তেরা আমাদের দলের নেতা বা কর্মী হলে নির্ঘাত তাঁদের অন্তত ১০ দিনের পুলিশি হেফাজতে নেওয়া হত। অথচ এত নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পরে অভিযুক্তদের জেরা করতে নিজেদের হাতে পর্যন্ত নিল না পুলিশ! এর থেকেই স্পষ্ট, দলতন্ত্র কী করে সমস্ত কিছু গ্রাস করে নিচ্ছে। এই প্রশাসনের থেকে কোনও মতেই নিরপেক্ষতা আশা করা যায় না।” উদাহরণ দিয়ে অমলবাবু জানান, সম্প্রতি পূর্বস্থলীতে একটি খুনের মামলায় অভিযুক্ত তাঁদের স্থানীয় জোনাল নেতা প্রদীপ সাহাকে পুলিশি হেফাজতেই নেওয়া হয়েছিল।
আইনজীবী মহল অবশ্য বিষয়টি নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত। কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী শুভাশিস রায় বলেন, “খুনের মামলায় ঘটনাস্থল থেকেই ধরা হয়েছে বলে ফরোয়ার্ডিং রিপোর্টে যেখানে উল্লেখ করছে পুলিশ, সে ক্ষেত্রে ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিজেদের হেফাজতে চাইবে তদন্তকারী সংস্থা, এটাই স্বাভাবিক। তা না করার অর্থ, ধৃতদের জেরা করায় অনীহা রয়েছে পুলিশের।”
পুলিশ জানিয়েছিল, ঘটনাস্থল থেকে লাঠিসোটা নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময়ই ওই চার জন ধরা পড়েন। নিহত প্রদীপবাবুর ভাই প্রবীর তা বুধবার বিকেলে যে এফআইআর করেছিলেন, তার ১৩ থেকে ১৬ নম্বরে ছিল ওই চার জনের নাম। ধৃতদের বিরুদ্ধে খুনের পাশাপাশি ভয় দেখানো, অপরাধমূলক উদ্দেশ্যে জড়ো হওয়া, কারও বাড়িতে জোর করে ঢোকা-সহ একাধিক ধারায় মামলা রুজু করেছে পুলিশ। প্রসঙ্গত, এফআইআরে মোট ২২ জনের নাম আছে। |
|
বর্ধমান জেলা পার্টি অফিসে নিহত দুই নেতাকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন নিরুপম সেন। ছবি: উদিত সিংহ |
এ দিন বেলা ১১টা নাগাদ বর্ধমান থানা থেকে কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে ধৃতদের আদালতে হাজির করায় পুলিশ। জেলায় বন্ধ উপেক্ষা করে ভারপ্রাপ্ত সিজেএমের এজলাসে হাজির হয়ে ধৃতদের জামিনের আবেদন করেন জেলা তৃণমূল নেতা তথা দলের আইনজীবী সেলের নেতা সদন তা। সওয়ালের সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন আইনজীবী সেলের পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, অরূপ দাস, কমল তা, গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। ধৃত চার জনকে ‘দলের লোক’ বলেই মেনে নিয়েছেন আইনজীবী সেলের সদস্যরা।
এর পরেও এ দিন মহাকরণে পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র দাবি করেন, “সিপিএমের বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠী ওই ঘটনা ঘটিয়েছে। যাঁরা ধরা পড়েছেন, তাঁদের মধ্যে প্রদীপ তা-র ঘনিষ্ঠ আত্মীয় রয়েছেন।” যদিও সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য গণেশ চৌধুরী ওই দাবি উড়িয়ে দিয়েছেন।
পরে সদনবাবু বলেন, ‘‘এ দিন জেলায় বন্ধ ডেকেছিল সিপিএম। এই আদালতের অলিখিত নিয়ম হল, যে দলই বন্ধ ডাকুক না কেন, কোনও পক্ষের আইনজীবীই অভিযুক্তের হয়ে সওয়াল করতে যান না। কিন্তু সেই প্রথা ভেঙে এ দিন চার অভিযুক্তের হয়ে জামিনের আবেদন করেছি। কারণ, আমরা সওয়াল না করলে প্রমাণ হত, হত্যায় অভিযুক্ত দলের কর্মীদের পাশে কেউই দাঁড়াচ্ছেন না আদালতে।” ওই আইনজীবীদের পাশাপাশি আদালত চত্বরে উপস্থিত ছিলেন প্রদেশ তৃণমূল নেতা তথা বর্ধমান জেলার পর্যবেক্ষক অলোক দাস, জামালপুরের দলীয় বিধায়ক উজ্জ্বল প্রামাণিক, জেলার অন্যতম সাধারণ সম্পাদক গোলাম জার্জিস ও বামদেব মণ্ডল। |
প্রদীপ তা-র স্ত্রী চিত্রলেখা তা |
মেয়ে পৃথা। |
—নিজস্ব চিত্র |
|
তৃণমূল নেতা অলোকবাবুর অভিযোগ, “সিপিএম বেছে বেছে আমাদের দলের লোকেদেরই এই হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত করেছে। আমি মোট ২০-২২ জনের নামের তালিকা পেয়েছি। খোঁজ নিচ্ছি, ঘটনার সময় এঁদের কে কোথায় ছিলেন।’’ এই হত্যাকাণ্ড ‘সিপিএমের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ফল’ বলে মুখ্যমন্ত্রী দাবি করলেও কেন তাঁরা আদালতে এসেছেন, সে প্রশ্নের জবাবে অলোকবাবু বলেন, “যে কোনও মৃত্যুই দুঃখের। তবে ধৃতেরা যাতে সুবিচার পান, সেটা দেখার কাজ তো আমাদেরও! ওঁরা আমাদের দলের লোক হোন বা না-ই হোন।”
অভিযুক্ত পক্ষের অন্যতম আইনজীবী বিশ্বজিৎ দাসের দাবি, পুলিশি রিপোর্ট ও এফআইআরের বয়ানে অনেক ‘অসঙ্গতি’ আছে। যা থেকে স্পষ্ট মামলাটি ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’। তাঁর বক্তব্য, “দুই সিপিএমের নেতার খুনের ঘটনায় যে এফআইআর হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে খুুনিরা টাঙ্গি, হাঁসুয়া, রড, বোল্ডার ইত্যাদি দিয়ে ওই দু’জনকে পিটিয়ে মেরেছে। কিন্তু পুলিশ যে ফরোয়ার্ডিং রিপোর্ট জমা দিয়েছে আদালতে, তাতে টাঙ্গি বা হাঁসুয়ার মতো অস্ত্রের কথা নেই। শুধু রড আর লাঠির কথা বলা হয়েছে। ঘটনাস্থলে থেকে একটি বাঁশের লাঠি ও গাছের ডাল বাজেয়াপ্ত করার কথা বলা হয়েছে পুলিশের রিপোর্টে।”
আগামী ৭ মার্চ ধৃতদের আবার আদালতে হাজির করানোর কথা। |
|
|
|
|
|