|
|
|
|
ভোটের নন্দীগ্রামে নেই উত্তেজনা |
আছে চোরা ক্ষোভ আর আছে লড়াইয়ের শপথ |
সুনন্দ ঘোষ • নন্দীগ্রাম |
সিপিএম ফিরে এসেছে, কল্পনাও করতে পারেন না আনসার মিয়াঁ।
কিন্তু, আজ যাঁরা তৃণমূলের পতাকা বহন করছেন, তাঁদেরও মন থেকে সমর্থন করতে পারছেন না নন্দীগ্রামের এই যুবক। অথচ, জমি আন্দোলন-পর্বে তৃণমূলের মিছিলে পরিচিত মুখ ছিলেন আনসার। পেশায় দর্জি। ঠিকানা সামসাবাদ। এখানে বিদ্যুৎ এসেছে। সেলাই মেশিন চালান বাড়িতে। কাপড় যায় কলকাতায়।
এই পরিবর্তনটা চেয়েছিলেন বলেই তৃণমূলকে সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু গত পাঁচ বছরে চোখের সামনে আরও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আনসারের কথায়, “একজন নেতা লোকের কাছে বিড়ি চেয়ে খেতেন। মাত্র পাঁচ বছরে তাঁর তিনতলা পাকা বাড়ি উঠেছে, দু’টো মোটরবাইক হয়েছে, গোটা পাঁচেক মোবাইল ফোন। দিনে চার প্যাকেট করে দামি সিগারেট ছাড়া তাঁর চলে না।” আনসারের পাশে বসা আর এক যুবক চাঁচাছোলা ভাবে বলে দিলেন, “৩৪ বছর ধরে সিপিএম যতটা দুর্নীতি করেছে, এরা ৫ বছরেই (২০০৮-র পঞ্চায়েত ভোটে পূর্ব মেদিনীপুরে ক্ষমতায় আসে তৃণমূল) সেটাকে ছাপিয়ে যাচ্ছে!” আনসারের প্রশ্ন, এদের সুবিধা করে দিতেই কি তৃণমূলের ক্ষমতায় আসা? ‘প্রিয় দিদি’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অগোচরেই কি এ সব ঘটে চলেছে? |
|
নন্দীগ্রামের গোকুলনগরের বুথে সকাল সকাল মহিলা ভোটারদের ভিড়। ছবি: পার্থপ্রতিম দাস |
আনসারদের এই প্রশ্নই বিরোধী-শূন্য নন্দীগ্রামে তাড়া করে বেড়াচ্ছে তৃণমূল নেতাদের। তাই সোমবার প্রায় শান্তিপূর্ণ ভোটের পরেও সামান্য হলেও চিন্তায় রয়েছেন নন্দীগ্রাম-আন্দোলনের সেনাপতি শুভেন্দু অধিকারী। যিনি বলছেন, “এটা ঠিক যে নন্দীগ্রামে গত বার যতগুলো আসন জিতেছিলাম, এ বার তার থেকে বেশি জিতব। তার মানে এই নয় যে, সব মানুষ আমাদেরই ভোট দেবেন। মহম্মদপুর, সামসাবাদ, গোকুলনগরের মতো এলাকায় কয়েকটি আসনে বিরোধীরাও জিততে পারে।”
আর দলের কিছু নেতার ফুলেফেঁপে ওঠার যে অভিযোগ শোনা যাচ্ছে? “সব মিথ্যা। এগুলো সিপিএমের তৈরি করা।”অভিযোগ ফুৎকারে উড়িয়ে দিচ্ছেন তমলুকের তৃণমূল সাংসদ। তাঁর দাবি, দলের প্রার্থীরা সম্পত্তির হিসাব দাখিল করেই ভোটে লড়ছেন। তাই এই অভিযোগ ভিত্তিহীন। অন্য কথা অধিকারীপাড়ার বাসিন্দা, তৃণমূল নেতা স্বদেশ দাস। তাঁর স্বীকারোক্তি, “যাঁরা ক্ষমতা পেলেন, তাঁদের হালচাল এত দ্রুত না বদলালে মানুষের মনে এতটা ক্ষোভ হত না।” এ তো গেল সাধারণ মানুষের মনের ক্ষোভ। কিন্তু, দলের ভিতরেই যে বিদ্রোহের আঁচ!
বস্তুত, নন্দীগ্রামে সিপিএম নিয়ে তৃণমূল যতটা না চিন্তায়, তার চেয়ে ঢের বেশি উদ্বেগ দলীয় বিক্ষুব্ধের নিয়ে। বেশ কিছু আসনে এলাকার দাপুটে তৃণমূল নেতা শেখ সুফিয়ানের ঘনিষ্ঠরাই দলীয় প্রতীক না পেয়ে নির্দল হিসেবে লড়ছেন। শুভেন্দুর বক্তব্য, “সকলকে তো সন্তুষ্ট করা যায়নি! তাই কেউ কেউ নির্দল হিসেবে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। সিপিএম-ও তো প্রার্থী দিতে না পেরে অনেক জায়গায় নির্দল দাঁড় করিয়েছে।” আনসার কিন্তু হেসে বলছেন, “খুঁজে দেখুন, নন্দীগ্রামে কতগুলো সিপিএম পাবেন!” শুভেন্দু বলছেন, “ওঁরা তো দলীয় প্রার্থী নন। ওঁদের জয় নিয়ে ভাবছি না।” স্বদেশ দাসের যুক্তি, “এঁরা সবাই এক সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আন্দোলন করেছেন। কিন্তু, কয়েক জন ক্ষমতা পাচ্ছেন। ফলে ক্ষোভ বাড়ছে।”
সেই ক্ষোভেরই এক নাম রুকসানা বিবি। সামসাবাদের এই নির্দল প্রার্থী, ২৯ বছরের গৃহবধূ রুকসানা বললেন, “গ্রামের লোক এককাট্টা হয়ে আমাকে অনুরোধ করে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এর আগে যাঁদের ভোট দিয়েছি, তাঁরা অনেক টাকা-বাড়ি-গাড়ি করে নিয়েছে। আমাদের কিছু হয়নি।” কথাবার্তার ফাঁকেই কানে এল চিৎকার। অভিযোগ উঠল, ভোটারদের প্রভাবিত করতে চাইছেন রুকসানা। তাঁর নির্বাচনী এজেন্ট তথা দেওর আমিরুল ইসলাম অবশ্য বললেন, “ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী বুঝছে হেরে যাবে। তাই এত চিৎকার।” রুকসানা একা নন। সোনচূড়া থেকে সাতেঙ্গাবাড়ি, ভাঙাবেড়া থেকে রেয়াপাড়া সব নির্দল প্রার্থীই নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখছেন। সেই সঙ্গে বলছেন, “একটা দলের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে নন্দীগ্রাম। এ বার নিজেদের দলের দুর্নীতিগ্রস্তদের বিরুদ্ধে লড়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে।”
কথার ফাঁকে ফের গণ্ডগোল। বুথের সামনে থাকা দু’তিন-জন সশস্ত্র পুলিশকে কেউ পাত্তা দিচ্ছে না। হঠাৎ হাজির আধাসেনা। সেই জলপাই পোশাক, সেই স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। মুহূর্তে সব চুপচাপ। স্থানীয় যুবক শেখ খুশনবি বললেন, “এখনও নন্দীগ্রামের মানুষ জলপাই রঙের পোশাকটাকে ভয় করে, সম্মান করে।”
এই সমীহ যার সৌজন্যে, তিনি এখন পটনায়। এক সময় ছিলেন সিআরপিএফের ডিআইজি। এখন বিহার পুলিশের আইজি (হোমগার্ড)। ২০০৭-র অক্টোবর থেকে নন্দীগ্রামে ছিলেন। তখন সেখানে নিত্য পুড়ছে বাড়ি। গুলি, বোমা, রক্তপাত ঠেকানো যাচ্ছে না। পুলিশ-প্রশাসনে আস্থা হারিয়েছে নন্দীগ্রাম। যতদিন নন্দীগ্রামে ছিলেন, সামান্যতম দুদর্শার কথা শুনে ছুটে গিয়েছেন। বাহিনী নিয়ে বুক চিতিয়ে আগলেছেন গ্রামবাসীদের।
সেই নন্দীগ্রামে পঞ্চায়েত ভোট শুনে অলোক রাজের প্রতিক্রিয়া, “দারুণ ব্যাপার। কেমন আছে নন্দীগ্রাম?” নন্দীগ্রামের মানুষ কৃতজ্ঞ চিত্তে তাঁকে স্মরণ করে শুনে বললেন, “নন্দীগ্রামের সঙ্গে আত্মীয়তা হয়ে গিয়েছিল। জীবনের ওই কয়েকটা মাস কখনও ভুলব না।” তখন সিপিএম শাসক। আজ বিরোধী। নন্দীগ্রামে সিপিএম লড়াই করছে কি, জানতে চাইলেন। সিপিএম নয়, তৃণমূল বনাম তৃণমূল শুনে তাঁর মন্তব্য, ‘‘দুর্ভাগ্যজনক!’’
|
পুরনো খবর: ভোটের নন্দীগ্রামেও জীবন সেই নিস্তরঙ্গ |
|
|
|
|
|