|
|
|
|
ভোটের নন্দীগ্রামেও জীবন সেই নিস্তরঙ্গ |
সুনন্দ ঘোষ • নন্দীগ্রাম |
ভাঙাবেড়া সেতুর গায়ে এখনও ক্ষতচিহ্ন।
সোনাচূড়া বাজারের রাস্তায়, পিচের আস্তরণের তলায় লুকোনো দগদগে রক্তের দাগ।
তেখালি সেতুতে উপুড় হয়ে কান পাতলে এখনও শোনা যায় ভারী বুটের শব্দ।
সাময়িক প্রলেপ দিয়ে সেই সব ক্ষতচিহ্ন আড়াল করা হলেও, সামান্য খোঁচা খেলে আজও চকচক করে ওঠে পুত্রহারা মায়ের চোখের কোণ। চার পাশে ঝকঝকে রাস্তা, আলো, জল। সুযোগ-সুবিধা গত পাঁচ বছরে ভরা বর্ষার জলের মতো ঝরে পড়েছে নন্দীগ্রামের উপরে। সে সেব তো প্রচুর হয়েছে। তবু অপ্রাপ্তির দীর্ঘশ্বাস এখনও কেন যেন আটকে রয়েছে নন্দীগ্রামের বুকের ভিতরে।
চক্রবেড়িয়া, সোনাচূড়া হয়ে যে পিচ রাস্তাটা ভাঙাবেড়া সেতুতে গিয়ে উঠেছে, সেই পথটাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হাত ধরে তুলে এনেছে মহাকরণে। রাতারাতি নোটিস লটকে সাধারণ মানুষের জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল নন্দীগ্রাম। সেই সংগ্রামই কার্যত সিপিএমকে নিশ্চিহ্ন করে তখতে বসিয়েছে তৃণমূল নেত্রীকে। মমতাও প্রতিশ্রুতি রেখেছেন। জল, বিদ্যুৎ, রাস্তা। ‘দিদি’র সেনাপতি শুভেন্দু অধিকারী হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদের টাকাও ঢেলেছেন নন্দীগ্রামে। এখনও ঢেলে যাচ্ছেন। কলকাতার শহিদ মিনারের ধাঁচে বিশাল উঁচু শহিদ স্তম্ভ তৈরি করছেন নন্দীগ্রামে। |
|
নেই উত্তেজনা। রবিবার ভাঙাবেড়া সেতুতে। ছবি: পার্থপ্রতিম দাস |
কেন মুখ ভার? আজ ভোট। আগের দিন নন্দীগ্রাম যেন ঝিমিয়ে। রবিবার নন্দীগ্রাম ঘুরে মনে হল খেটে খাওয়া মানুষ এখনও অভিমানে দগ্ধ। বুকে লুকিয়ে রাখতে চান এমন সব কথা, যা প্রকাশ্যে এলে রাতের অন্ধকারে দরজায় টোকা পড়তে পারে! শাসকদলের কিছু নেতার বিরুদ্ধে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার অভিযোগ কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে।
তেখালির পথে ২৮ বছরের যুবক শেখ আকসারের পথ আটকালে তিনি বলেন, “রাস্তা, বিদ্যুৎ তো হল। কিন্তু, মানুষ বাঁচবে কী করে? ১০ টাকা রোজগার করলে যদি ১৫ টাকা খরচ হয়ে যায়, তা হলে চলবে কী করে?” দর্জির কাজ করেন আকসার। বলেন, “ও ভাবে রাতারাতি নোটিস লটকে যেমন ‘জমি দিয়ে যাও’ বলাটা অনুচিত ছিল, তেমনই শিল্প করব না বলে মুখ ফিরিয়ে রাখাটাও মনে হয় ভাল হচ্ছে না। বছরে এক বার ফসল তুলে কতটা উন্নয়ন সম্ভব নন্দীগ্রামের?”
কিন্তু উন্নয়ন তো হচ্ছে?
সোনাচূড়ার বাড়িতে বসে স্থানীয় তৃণমূল নেতা অভিমান করে বললেন, “রাস্তাঘাট হচ্ছে। পরিকাঠামো বাড়ছে। কিন্তু, ক্ষমতা চলে যাচ্ছে মুষ্টিমেয় লোকের হাতে। তাঁরা আরও ক্ষমতাবান হচ্ছেন। আর সাধারণ মানুষ তিমিরেই রয়ে যাচ্ছেন।” ৫০ বছরের সুকুমার জানা শরীর এখনও চাবুকের মতো শক্ত। কিন্তু ভিতরে ভিতরে মনটা একেবারে ভেঙেচুরে শেষ হয়ে গিয়েছে। ২০০৭ সালের ১৪ মার্চ ভাঙাবেড়া সেতুর কাছে উদ্ভ্রান্ত হয়ে ছুটতে থাকা জনতার মধ্যে একটা অচেনা লোক চ্যাংদোলা করে ৩৭ বছরের সহধর্মিনী সুপ্রিয়ার দেহটা নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিল পায়ের কাছে। অনেক পথ পেরিয়ে এসে আজ তাঁর মনে হচ্ছে, এক সময় আন্দোলনের সামনে থাকা মুখগুলো এখন যেন অচেনা লাগছে। সুকুমারের কথায়, “ক্ষতিপূরণ পেয়েছি। ছেলের চাকরি হয়েছে। তবু কেন যেন মনে হচ্ছে ‘দিদি’ যেমনটা চেয়েছিলেন, এরা সব হতে দিচ্ছে না।”
এরা কারা? জবাব মিলল না। কিন্তু, এলাকায় ঘুরে বোঝা গেল, পরিবর্তনের আঁতুড়ঘরেও তৃণমূলের ভিতরে তৈরি হচ্ছে অসন্তোষ। বিরোধী শূন্য করে রেখে উন্নয়ন করলে যে গণতন্ত্রের স্বাস্থ্যরক্ষা হবে না,তা-ও উপলব্ধি করতে শুরু করছে নন্দীগ্রাম। ‘বদলা নয়, বদল চাই’স্লোগান দিয়ে যে সরকার ক্ষমতায় এসেছিল, তারা আজ বামেদের পথেই হাঁটছে বলে মনে করছেন এখানকার বড় অংশের মানুষ। এক সময় কেশপুর-গড়বেতা-খেজুরি-নন্দীগ্রামে যেমন বিরোধী-শূন্য নির্বাচন হয়েছে, আজ নন্দীগ্রামে যেন তারই প্রতিফলন। এ বার নন্দীগ্রাম ১ ব্লকে গ্রাম পঞ্চায়েতের ১৪০টি আসনের মধ্যে স্রেফ ৯টিতে বামেদের প্রতীকে প্রার্থী রয়েছে। সিপিএমের জেলা নেতা অশোক গুড়িয়া বলেন, “নির্দল ও প্রতীক মিলিয়ে ২৮টি আসনে প্রার্থী দিয়েছি। ওরা মনোনয়ন পত্র তুলতে দেয়নি। তুললে জমা দিতে দেয়নি। গায়ের জোরে প্রত্যাহার করিয়েছে।”
খচখচানি তবু থেকেই যাচ্ছে। দলের ভিতরেই যে শুরু হয়েছে বিরোধিতা! অধিকাংশ জায়গায় সিপিএম নেই। শুধু কংগ্রেসের সঙ্গে সরাসরি লড়াই হলে জয় ছিল কার্যত নিশ্চিত। কিন্তু কোথাও আম, কোথাও জোড়াপাতা, কোথাও লাঙল চিহ্নে নির্দল হিসেবে লড়ছেন তৃণমূল নেতারাই। বিক্ষুব্ধদের জন্য ভোট ভাগাভাগি হবেই। জমি আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া শেখ সুফিয়ানরা তাই খানিকটা অস্বস্তিতে। পাঁচ বছর আগে বাম জামানায় নন্দীগ্রাম ১ ও ২ ব্লক মিলিয়ে ১৭টি গ্রাম পঞ্চায়েত নিজেদের দখলে রেখেছিল তৃণমূল। তাঁদের জমানায় সেই ক্ষমতা কি অটুট থাকবে, সংশয়ে খোদ সুফিয়ান। বদলের নন্দীগ্রামে এ-ও বাস্তব! |
|
|
|
|
|