রাত পোহালে হাইকোর্টের কাছে জবাবদিহি করতে হবে প্রচারে বাইক-বাহিনীর অবাধ ব্যবহার নিয়ে। জানাতে হবে, উচ্চ আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও কেন এই বাহিনীর রমরমা বন্ধ করা যায়নি। তার মধ্যেই রবিবার প্রচারে আরও এক বার বাইক-বাহিনীর দাপট দেখল দুই জেলা, হাওড়া এবং মুর্শিদাবাদ। দু’টি জায়গাতেই অভিযোগের আঙুল শাসক দল তৃণমূলের দিকে।
বাইক-বাহিনী বন্ধ করা নিয়ে রাজ্য কেন তাঁর নির্দেশ অমান্য করেছে, তা মুখ্যসচিব এবং স্বরাষ্ট্রসচিবকে আজ, সোমবার বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের এজলাসে হলফনামা দিয়ে জানাতে হবে। এই অবস্থায় রবিবারেও হাওড়ায় এবং মুর্শিদাবাদে তৃণমূলের দুই সাংসদের নির্বাচনী সভায় বাইক-বাহিনী বার হওয়ার খবর মহাকরণে পৌঁছনোয় রাজ্য প্রশাসনের কর্তারা উদ্বিগ্ন। হাওড়ার উলুবেড়িয়ায় সভা ছিল তৃণমূলের সাংসদ তাপস পালের। আর মুর্শিদাবাদে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের। দু’টি জনসভাতেই বাইকের মিছিল নিয়ে গিয়েছিলেন তৃণমূলের সমর্থকেরা। উত্তরবঙ্গের বীরপাড়া-মাদারিহাট ব্লকের খয়েরবাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা থেকেও তৃণমূলের বাইক-মিছিলের খবর পৌঁছেছে পুলিশ-প্রশাসনে। যদিও বীরপাড়া থানার ওসি বলেন, “অনুমতি নিয়ে মিছিল হয়েছে। |
রবিবার উলুবেড়িয়ায় তৃণমূলের মোটরবাইক মিছিল। ছবি: সুব্রত জানা |
প্রচারের কাজে এ ধরনের মিছিল করা যায় বলে ব্লক প্রশাসন থেকে জানানো হয়েছে।” বাইক-বাহিনী নিষিদ্ধ করা নিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশন গত ৭ জুলাই প্রতিটি জেলার জেলাশাসককে নির্দেশিকা পাঠিয়েছিল। তা কার্যকর করা হয়নি। ১০ জুলাই কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্য সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, কমিশনের নির্দেশ যেন অবশ্যই পালিত হয়। তাতেও বাইক-বাহিনী নিষিদ্ধ হয়নি রাজ্যে। ১২ জুলাই বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের আদালতে এমন প্রশ্নও ওঠে যে, রাজ্য সরকার হাইকোর্টের নির্দেশ আদৌ মানতে চায় কি? রাজ্যের মুখ্যসচিব ও স্বরাষ্ট্রসচিবের কাছে হলফনামা তলব করে বিচারপতি জানতে চান, কেন রাজ্য সরকার হাইকোর্টের নির্দেশ কার্যকর করেনি? সোমবার রাজ্য প্রশাসনের দুই শীর্ষ কর্তা তাঁদের রিপোর্ট কলকাতা হাইকোর্টে জমা দেবেন।
মুখ্যসচিব এবং স্বরাষ্ট্রসচিবের ব্যাখ্যা যদি তাঁকে সন্তুষ্ট করতে না পারে, তা হলে তিনি কড়া পদক্ষেপ করতে পারেন বলে শুক্রবারই জানিয়ে দিয়েছিলেন বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায়।
এই পরিস্থিতিতে শাসকদলের প্রচারে মোটরবাইকের মিছিল নিয়ে নতুন করে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে প্রশাসনে। হাইকোর্টের নির্দেশ সত্ত্বেও কেন বাইক-বাহিনী বন্ধ হল না, এই প্রশ্নের জবাবে মন্তব্য করতে চাননি রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “যা জানানোর তা হাইকোর্টকেই বলব।” হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করে শনিবার এবং রবিবারও কী ভাবে রাজ্যে নির্বাচনী প্রচারে বাইক-বাহিনী নামানো হল, তা সোমবার তথ্য দিয়ে আদালতকে জানাবেন ওই মামলার আবেদনকারী প্রদেশ কংগ্রেসের আইনজীবী। হাইকোর্টে চাইলে রাজ্য নির্বাচন কমিশন এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় তথ্য দেবে বলে কমিশন সূত্রে জানানো হয়েছে। বাইক-বাহিনীর দাপট যে কমেনি, তা এ দিন কমিশনকে জানিয়ে এসেছে সিপিএম। দলের নেতা রবীন দেব এ দিন বলেন, “শুক্রবার হাইকোর্টের নির্দেশের পরে দু’দিন বাইক-বাহিনী কিছুটা নিয়ন্ত্রণে ছিল। রবিবার সকাল থেকে তা ফের শুরু হয়েছে। রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে আমরা বিষয়টা জানিয়ে এসেছি।” |
গ্রামাঞ্চলে বাইকই সম্বল। তাই সব দলের
প্রচারই
বাইকে হয়।
বাইকে চড়া
মানেই অপরাধ নয়।
সুব্রত মুখোপাধ্যায় | পঞ্চায়েতমন্ত্রী |
সবার তো চার চাকা নেই। এখন যদি চারটে
বাইক আমার সঙ্গে যায়, তা হলে
তারা হয়ে যায় বাইক-বাহিনী।
মদন মিত্র | পরিবহণমন্ত্রী |
সভায় বাহন নিয়ে যাবে না তো কী! তবে বাইক নিয়ে
মিছিল করলে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন ছিল।
হুমায়ুন কবীর | এসপি, মুর্শিদাবাদ |
|
রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডে অবশ্য বলেন, “কিছু জেলা থেকে বাইক মিছিলের অভিযোগ এসেছিল। সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিতে বলেছি। ব্যবস্থা নেওয়াও হয়েছে।”
হাইকোর্ট সূত্রের খবর, যে ভাবে কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশ লঙ্ঘিত হয়েছে, তাতে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার নোটিসও দিতে পারে আদালত। তবে সব কিছুই নির্ভর করছে মুখ্যসচিব এবং স্বরাষ্ট্রসচিব কী ভাবে রাজ্য সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন, তার উপরে।
চার দিক থেকে এমন চাপের মধ্যে এ দিন বাইক-বাহিনীর প্রচার নিয়ে পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় এবং পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। সুব্রতবাবু বলেন, “বাইক-বাহিনী কুখ্যাত হয়েছে বাম আমলের হার্মাদ বাহিনীর জন্য। তখন নন্দীগ্রাম,
জঙ্গলমহল এলাকায় বাইকে চড়ে সিপিএমের বাহিনী গিয়ে সন্ত্রাস চালাত। কিন্তু প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে অনেক ক্ষেত্রে যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে বাইকই সম্বল। সেখানে সব দলেরই প্রচার বাইকের মাধ্যমে হয়। তার মানেই সন্ত্রাস নয়। বাইকে চড়া মানেই অপরাধ নয়।”
ভাঙড়ের বামনঘাটা বাজারে এক নির্বাচনী সভায় রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র বলেন, “সিপিএম আমলে বাইক-বাহিনী ব্যাপক ভাবে দেখা যেত। সেটা তো বাইক-বাহিনী ছিল না, ছিল বন্দুক-বাহিনী। ওই বাহিনীর কাঁধে থাকত বন্দুক, কোমরে রিভলভার। পুলিশ তখন আমাদের ওই রাস্তায় যেতে বারণ করত। ওটা বন্দুক-বাহিনী আর আমাদেরটা বাইক-বাহিনী।” এর পরে মদনের মন্তব্য, “সবার তো আর চারচাকা নেই। এখন যদি চারটে বাইক আমার সঙ্গে যায়, তা হলে তারা হয়ে যায় বাইক-বাহিনী।” |
শালতোড়ায় পুনর্নির্বাচনে পাহারা। রবিবার। —নিজস্ব চিত্র |
মুর্শিদাবাদে মুকুল রায়ের সভায় বাইক মিছিল নিয়ে তৃণমূল সমর্থকেরা যে গিয়েছিলেন, তা তাঁর জানা নেই বলে মন্তব্য করেছেন জেলা পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর। তবে তাঁর ব্যাখ্যা, “মোটরবাইক নিয়ে জনসভায় যাওয়ার ক্ষেত্রে কোনও বিধি-নিষেধ নেই। মোটরবাইক তো একটা বাহন। বাহন নিয়ে যাবে না তো কী নিয়ে যাবে? তবে মোটরবাইক নিয়ে মিছিল করলে অবশ্যই পুলিশ প্রশাসনের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখছি।”
এ ব্যাপারে তৃণমূল নেতা মুকুল রায়ের দাবি, “আমার কোনও সভাতেই বাইকের মিছিল বা বাইক বাহিনী আমি দেখিনি। অন্য কোথাও হয়ে থাকলে আমার জানা নেই। তবে প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে মিছিলে বাইকের ব্যবহারে তো কোনও আপত্তি আছে বলে শুনিনি।”
যদিও তৃণমূলের জেলা সভাপতি মহম্মদ আলি জানিয়েছেন, “বাইক নিয়ে মিছিল হয়েছে বলে আমার অন্তত জানা নেই। তবে তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকরা মোটরবাইক নিয়ে জনসভায় এসেছেন। মোটরবাইক নিয়ে জনসভায় আসার জন্য পুলিশ প্রশাসনের অনুমতি নেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। তাই পুলিশের অনুমতিও নেওয়া হয়নি।”
|