ভরদুপুরে যে বুথে জনাকয়েক দুষ্কৃতী দু’জন সশস্ত্র পুলিশের সামনেই বাক্স ভেঙে ব্যালট পেপার ছিঁড়ে ফেলেছিল, পুনর্নির্বাচনে রবিবার সেই বুথই ঘিরে থাকল বিশাল পুলিশবাহিনী। শালতোড়ার গোসাইডিহি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সেই ৪৩/২ নম্বর বুথে কয়েক ঘণ্টা বসে ভোটের কাজ দেখাশোনা করলেন জেলাশাসক বিজয় ভারতী। গ্রামের মোড়ে মোড়ে ছিল পুলিশের কড়া পাহারা। ধান রোয়ার এই ভরা মরসুমেও বুথে নামল মানুষের ঢল। দিনের শেষে জেলাশাসক জানালেন, ওই বুথে ভোট পড়েছে ৮৬.৩৩ শতাংশ।
শালতোড়ার ঢেকিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের এই বুথে বৃহস্পতিবার দুপুরে ভোট চলাকালীন জনা কুড়ি দুষ্কৃতী ঢুকে ভোটকর্মীদের মারধর করে বাক্স ভেঙে ব্যালট পেপার ছিড়ে দেয়। যাওয়ার সময় ভোটকর্মীদের তালা মেরে যায়। রবিবার তাই বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল এলাকায়। সকাল থেকেই বুথ চত্বরে ঘাঁটি গেড়ে ছিলেন ছিলেন শালতোড়ার বিডিও অরুময় ভট্টাচার্য, সিআই (বাঁকুড়া সদর) উদয় বন্দ্যোপাধ্যায়, শালতোড়ার ওসি পথিকৃত্ চট্টোপাধ্যায়রা। দুপুরে আসেন জেলাশাসক। ভোটগ্রহণ কেন্দ্র থেকে কয়েক কিলোমিটার আগে গ্রামে ঢোকার রাস্তায় দেখা যায় পুলিশের টহল। গ্রামের বাসিন্দারা ছাড়া বহিরাগতদের প্রায় যেতেই দেওয়া হচ্ছিল না। বুথের আশপাশে ছিল বাঁশের ব্যারিকেড। বৈধ কাগজপত্র দেখানোর পরে তবেই ভোটারদের বুথে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছিল। জেলা পুলিশ সূত্রের খবর, এলাকায় এ দিন জনা পঞ্চাশেক পুলিশ কর্মী মোতায়েন ছিল। |
কিন্তু এত কিছুর পরেও ওই ভোট নিয়ে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের কাজিয়া থেমে থাকেনি। সিপিএমের জেলা সম্পাদক অমিয় পাত্র অভিযোগ করেন, “শনিবার রাতে শদুয়েক বহিরাগত তৃণমূল কর্মী গ্রামে ঢুকে দাপিয়ে বেড়িয়েছে। রবিবার সকালেও তারা সিপিএম কর্মীদের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে ভোট না দেওয়ার জন্য হুমকি দেয়।” তাঁর দাবি, দলের তরফে বিষয়টি তাঁরা প্রশাসনকে জানাবার পরে দুপুর থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। তবে শালতোড়ার তৃণমূল বিধায়ক স্বপন বাউরি পাল্টা দাবি করেন, “ওই পঞ্চায়েতে আমরাই ছিলাম। সিপিএম বৃহস্পতিবার বুথ দখল করলেও এ দিন তার সুযোগ না পেয়ে আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা রটাচ্ছে।” প্রশাসন সূত্রের খবর বেলা ১১টায় প্রায় ৩৬ শতাংশ ভোট পড়ে যায়। বিকেল পাঁচটার মধ্যেই শেষ হয় ভোটপর্ব। জেলাশাসক বলেন, “সকালে সিপিএম অভিযোগ জানায়। তবে শান্তিতেই ভোট মিটেছে। নিজেও ওই বুথে গিয়েছিলাম।”
ভোটররা কিন্তু রাজনৈতিক নেতাদের এই দলাদলিতে আগ্রহী নয়। অনেককেই এ দিন ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে পুনর্নির্বাচন নিয়ে ক্ষোভ উগরাতে দেখা গিয়েছে। সুন্দরী হেমব্রম, হোপনি হেমব্রমরা বিড়বিড় করে বলেন, “এই তো বৃহস্পতিবার চাষের কাজ ফেলে ভোট দিয়ে গেলাম। কিছু লোকের গোলমালের জন্য আবার এ দিন চাষের কাজ বন্ধ করে ভোট দিতে হচ্ছে।” আসলে উত্তর বাঁকুড়ার এই এলাকায় এখনও সেচের ব্যবস্থা সেই মান্ধাতার আমলেই আটকে রয়েছে। রুখাশুখা জমিতে বর্ষার জলেই যেটুকু ধান চাষ হয়। যাঁদের জমি নেই, তাঁরা এই সময় পরের জমিতে খেটে দু’টো রোজগার করেন। তাই কাজ ফেলে ভোট দিতে আসায় তাঁদের পেটে টান কিছুটা পড়েছে। অন্য এক ভোটার আরতি বাস্কের কথায়, “বাড়িতে চারা ধান পড়ে রয়েছে। দু’দিন অন্তর ভোট দিতে আসার জন্য বীজ রোয়ার কাজ ব্যাহত হল।”
ক্ষোভের কারণটা শুধু দু’দিনের এই ক্ষতির জন্য তা নয়। শুশুনিয়া, বিহারিনাথ-সহ ছোট বড় টিলায় ঘেরা গোসাইডিহি গ্রামের বাসিন্দাদের মুখ্য জীবিকা কৃষিকাজ। হপন হেমব্রম, হরনাথ হেমব্রম, শিবু হেমব্রম, অনিল হেমব্রমরা বলেন, “গ্রামের অনেক জমি উর্বর। সারা বছরই ধান-সহ নানা সব্জি চাষ করা যায়। কিন্তু এখানে সেচ ব্যবস্থা না থাকায় শুধু বর্ষা ছাড়া আর কোনও সময় চাষ করতে পারি না। তাই বাধ্য হয়েই আমাদের হয় পুবে খাটতে যেতে হয়, না হলে আশেপাশে গ্রামে দিনমজুরি করতে হয়।” তাঁদের ক্ষোভ, এলাকায় সেচের ব্যবস্থা করার দাবি দীর্ঘদিনের। ভোট বৈতরণী পার করতে এলাকায় সেচ ব্যবস্থা গড়ার আশ্বাস দিয়েছেন প্রায় সব রাজনৈতিক দলই। কিন্তু না বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছরে, না তৃণমূল সরকারের ২ বছরেদাবি অপূর্ণই রয়ে গিয়েছে। তাঁদের আক্ষেপ, “আমরা কাজকর্ম ছেড়ে প্রতিবারই নেতাদের আশ্বাসে আশায় আশায় ভোট দিই, কিন্তু সেচের ব্যবস্থা আর হয় না।”
ক্ষোভ রয়েছে ১০০ দিন প্রকল্পের কাজ নিয়েও। সুন্দরীদেবী, হোপনিদেবীদের অভিযোগ, “ওই প্রকল্পে শেষ কবে কাজ করেছি মনে পড়ে না। বাড়ির পুরুষরা এখনও পুবেই খাটতে যায়।” গত বার পঞ্চায়েতের ১০টি আসনের মধ্যে ৫টি তৃণমূল, ১টি নির্দল, ১টি বিজেপি ও ৩টি সিপিএম পেয়েছিল। তৃণমূল, বিজেপি ও নির্দল জোট গড়ে পঞ্চায়েত দখল করে। স্থানীয় তৃণমূল নেতা শ্যামল মুখোপাধ্যায় বলেন, “এলাকায় ১০০ দিনের যথেষ্ট কাজ হয়েছে।” মহকুমাশাসক (বাঁকুড়া সদর) অভিজিত্ মুখোপাধ্যায় বলেন, “জেলার যে ক’টি ব্লক ১০০ দিনের প্রকল্পে ভাল কাজ করছে শালতোড়া তাদেরমধ্যে অন্যতম। ঢেকিয়ার বাসিন্দাদের এমন অভিযোগের কারণ খতিয়ে দেখব।”
তবে চার দিন পেরিয়ে যাওয়ার পরেও বুথে হামলায় যুক্ত দুষ্কৃতীদের পুলিশ কেন গ্রেফতার করতে পারল না, সে প্রশ্নও ঘুরপাক খাচ্ছিল এলাকায়। পুলিশের এক আধিকারিক জানান, পুনর্নির্বাচনে শান্তি বিঘ্নিত যাতে না হয়, সে জন্য তাঁরা অপেক্ষা করছিলেন। জেলা পুলিশ সুপার মুকেশ কুমারও বলেন, “শীঘ্রই দোষীদের গ্রেফতার করা হবে।” |