রাত ন’টা। অক্সিজেনের নলটা খুলে নেওয়া হবে তার পরেই। এমনটাই ঠিক ছিল। কিন্তু রবিবারের মহানগর দেখিয়ে দিল, চাইলে মৃত্যুকেও দাঁড় করিয়ে রাখা যায়! অন্তত কিছু সময়ের জন্য।
অতএব ডাক্তারবাবু অপেক্ষা করলেন। কাউন্টার খোলা থাকল লম্বা লাইনকে সম্মান দিয়ে। ‘দাদাঠাকুর’ শরৎ পণ্ডিতের রসিকতায় ডাক্তারের সমাস ভেঙে যেত ডাক ও তারবাবু! তার ছিঁড়ে দেওয়ার শেষ দিনটিতে তারবাবুরাও তাঁদের পরিচয়টিকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলেন আরও ঘণ্টা দুয়েক। রাত এগারোটা তিন, কলকাতার শেষ টেলিগ্রাম গেল। ১৬৩ বছর বয়সে দীর্ঘ রোগভোগের পরে প্রয়াত হল ভারতীয় টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা।
আগেই ঘোষণা হয়ে ছিল, রবিবারই দেশ জুড়ে টেলিগ্রাম পাঠানোর শেষ সুযোগ। বিভিন্ন শহরে সেন্ট্রাল টেলিগ্রাফ অফিস (সিটিও) খোলা থাকবে রাত ন’টা পর্যন্ত। কিন্তু জনতার উৎসাহ সময়সীমা পার করিয়ে দেয়। শেষ টেলিগ্রাম পাঠানোর জন্য রীতিমতো ভিড় উপচে পড়ে শহরগুলোতে। দিল্লির চার-চারটি সিটিও অফিসে হাজার হাজার মানুষের লাইন! কেউ কেউ একসঙ্গে ২০টি টেলিগ্রামও করেছেন এ দিন। চাপ সামলাতে কর্মীদের অনেকেরই ছুটি বাতিল করতে হয়েছে।
এই তারবাবুরা এর পর কোন বিভাগে চাকরি করবেন? বিভিন্ন জায়গায় ভাগাভাগি করে তাঁদের কাজ দেওয়া হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। তবু ছাঁটাইয়ের আশঙ্কায় সিপিএম-প্রভাবিত কর্মী-ইউনিয়নের ডাকে ধর্মঘট চলছে কলকাতায়। বিবাদী বাগ অঞ্চলের সিটিও-র কথাই ধরা যাক! কর্মীরা অনেকেই রবিবার আসেননি। যাঁরা এসেছেন, তাঁদের একাংশের প্রতিবাদে টেলিগ্রাম পাঠানোর হলঘরে ‘এসি’ চালানো হয়নি। ভ্যাপসা গরম! ১৯৮২ সালে এখানে চাকরিতে ঢুকেছিলেন জয়ন্ত চক্রবর্তী। তাঁর মতো কয়েক জনই এ দিন কাউন্টার সামলিয়েছেন। তবু সন্ধে উতরোলেও স্লগ ওভারের উত্তেজনা ঠেকানো যায়নি। জয়ন্তবাবু বলছিলেন, “লাইন দেখে আমার চাকরির শুরুর দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে!” এক পদস্থ কর্তা জানালেন, শেষ দিনে এই অফিস থেকে তিনশোরও বেশি টেলিগ্রাম হয়েছে। কোথায় পাঠানো হচ্ছে তার উপরে নির্ভর করে এই টেলিগ্রাম পৌঁছতে এক-দু’দিন বা সাত-আট দিনও লেগে যেতে পারে! |
কলকাতা থেকে শেষ টেলিগ্রাম। রবিবার রাত এগারোটার পরে
সিটিও অফিসে অহনা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য |
সময় যতই লাগুক। এক টুকরো ইতিহাস নিজের সংগ্রহে রাখতে বা প্রিয়জনের কাছে পাঠাতে উৎসুক সকলেই। তাই বালিগঞ্জের মনীষা সেনগুপ্ত, আড়িয়াদহের গৌর চক্রবর্তী, ঢাকুরিয়ার পারমিতা মুখোপাধ্যায় বা ফোর্ট উইলিয়ামের সেপাই রসুল শেখ লম্বা লাইন, ঘেমো গরম সত্ত্বেও টেলিগ্রাম পাঠাতে মরিয়া! সেপাই রসুলসাহেবের সঙ্গে তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তা, মেজর জেনারেল বিপিন রাওয়াতের বার্তা। শুধুমাত্র স্মারক পাঠাতেই বিপিন নয়ডায় তাঁর বাবাকে লিখেছেন, “ড্যাডি কিপিং গুড হেল্থ!” আবার জনসংযোগের হাতিয়ার হিসেবেও টেলিগ্রামের শেষ দিনটিকে ব্যবহার করেছেন কিছু ব্যবসায়ী-গোষ্ঠী। গণ-বার্তা পাঠিয়েছেন শুভানুধ্যায়ীদের কাছে।
আর পাঁচটা মৃত্যুতে যেমন হয়, ফেসবুক-টুইটারে ‘আরআইপি’ (রেস্ট ইন পিস) লিখেই দায় সারলেন না কেন? লাইনে দাঁড়ানো মানুষগুলোর কথা থেকেই বেরিয়ে এল উত্তরটা টেলিগ্রাম যে দীর্ঘদিন অবধি বড় অমোঘ ভাবে জড়িয়ে ছিল প্রতিটি পরিবারের সুখ-দুঃখের সঙ্গে! বহু মানুষের জীবন-ইতিহাসের সঙ্গে!
এক সময় লর্ড ডালহৌসি বলতেন, টেলিগ্রাফই ভারতকে বাঁচিয়ে দিল! ইতিহাসবিদরা বাস্তবিকই নথি ঘেঁটে দেখিয়েছেন, ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহ দমন করা সম্ভব হত না টেলিগ্রাফের কৃপা ছাড়া। ১৮৩৩ সালে ২৪ বছর বয়সী এক আইরিশ ডাক্তার ভারতে আসেন। নাম, উইলিয়াম ব্রুক ও’শগনেসি। নানা বিষয়ে উৎসাহ। ১৮৫০ সালে কলকাতা থেকে ডায়মন্ড হারবারের মধ্যে ২৭ মাইল টেলিগ্রাফ লাইন তাঁরই তৈরি। ভাগ্যিস! সাত বছর পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ‘মিউটিনি’-র ধাক্কা সামলে উঠল তার দৌলতেই। আর ডেভিড আর্নল্ড তাঁর বইয়ে লিখেছেন ১৯৩৯, অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালেই লক্ষ মাইল ছড়িয়ে গিয়েছিল তারের খুঁটি!
বটেই তো! নিশ্চিন্দিপুর ছেড়ে আসার সময়েই তো অপু দেখেছিল, “একটা ছোট্ট খড়মের বউলের মতো জিনিস টিপিয়া স্টেশনের বাবু খটখট শব্দ করিতেছে!” সেই ‘খড়মের বউল’ থেকে টরেটক্কা মেশিন, হারিয়ে গিয়েছিল বহু আগেই। পরবর্তী পর্যায়ে কম্পিউটারের মাধ্যমে ‘ওয়েববেস্ড টেলি মেসেজিং সিস্টেম’ চলতে থাকে। কিন্তু ই মেল, এসএমএস বা স্কাইপ-ওয়াট্সঅ্যাপ-এর যুগে সে সবই তো নেহাত শিশু।
আশির দশকেও দিল্লির কেন্দ্রীয় সিটিও অফিস থেকে দিনে লাখখানেক টেলিগ্রাম যেত-আসত। কলকাতা সিটিও-র চিফ সুপারিন্টেনডেন্ট সুব্রত কুমার দাস বলছিলেন, “মাসে-মাসে কয়েক লক্ষ টাকার টেলিগ্রাম রওনা দিত কলকাতার সিটিও অফিস থেকে।” নয়ের দশকে ইন্টারনেট আর মোবাইল পরিষেবা চালু হওয়ার পর থেকেই অবস্থাটা বদলাতে শুরু করল দ্রুত। ফ্যাক্স-ডেটা কমিউনিকেশন-ভিডিও টেক্সটের কল্যাণে টেলিফোন বিভাগের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ক্রমশ পিছিয়ে পড়তে লাগল টেলিগ্রাফ বিভাগ।
সূত্রের খবর, শেষ দিকে পরিষেবা চালাতে বিএসএনএলের বাৎসরিক খরচ হত প্রায় ১০০ কোটি টাকা। আয়? ৭৫ লক্ষ টাকা। শেষের দিকে শব্দ প্রতি খরচের অঙ্ক বাড়িয়ে ঘাটতি মেটানোর মরিয়া চেষ্টা করেছিল বিএসএনএল। কিন্তু কোমা থেকে রোগী আর উঠে বসেনি। ‘সপ্তপদী’তে উত্তমকুমারের হাতে ধরা সেই ‘মাদার এক্সপায়ার্ড ফাদার’ লেখা খামটির মতোই তারও মৃত্যু পরোয়ানা লেখা হয়ে গিয়েছিল!
রবিবার শুধু প্রদীপটা নেভার আগে শেষ বারের মতো জ্বলে উঠল কেবল। আড়াই ঘণ্টা লাইন দিয়ে সাত মাসের মেয়েকে ‘তার’ পাঠালেন বাঁশদ্রোণীর ইন্দ্রনীল বিশ্বাস। লেখা থাকল, ‘দিস ইস ইওর ফার্স্ট অ্যান্ড লাস্ট টেলিগ্রাম, অন ইট্স গুডবাই ডে। লাভ পাপা!’
|
তার-কাহিনি |
• ১৮৩৬: স্যামুয়েল মোর্সের বিশেষ লিপি আবিষ্কার।
• ১৮৪১: ব্রিটেনে পরীক্ষামূলক ভাবে চালু ‘তার’ পরিষেবা।
• ১৮৪৪: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চালু টেলিগ্রাফ।
• ১৮৫০: ভারতে প্রথম টেলিগ্রাম-কলকাতা থেকে ডায়মন্ড হারবারে।
• ১৮৫৭: ডালহৌসিতে সিটিও অফিস তৈরি।
• ১৯৯৪: মোর্স কোডের অবলুপ্তি। শুরু কম্পিউটারে টেলিগ্রাম পাঠানো।
• ২০১৩: মৃত্যু পরিষেবার। |
|