ফোন-মেলের দাপটে শেষ টরেটক্কা
ফাদার ইল কাম শার্প...
সাইকেলের ক্রিং ক্রিং শব্দ। আর তার একটু পরেই দরজায় কড়া নেড়ে হলদেটে খামটা এগিয়ে দেওয়া...বাড়ির মধ্যে একজন কেউ খামটা নেবেন, খুলবেন, কী লেখা আছে পড়ে
সকলকে বলবেন...তত ক্ষণ পরিবারের সব ক’টা মুখ দমবন্ধ করে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকবে!
এক সময়কার অতি পরিচিত এই দৃশ্যটা অনেক দিনই হারিয়ে গিয়েছিল জীবন থেকে। এ বার সেটা একেবারেই ইতিহাসের বিষয় হয়ে উঠতে চলেছে। আগামী ১৫ জুলাই থেকে টেলিগ্রাম-পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসএনএল।
সংস্থার সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার (টেলিগ্রাফ সার্ভিসেস) শামিম আখতার একটি সার্কুলার জারি করে জানান, ১৫ জুলাই থেকে কোনও টেলিগ্রাফ অফিস টেলিগ্রামের জন্য আর বুকিং নেবে না। ঠিক যে ভাবে পোস্টকার্ডে চিঠি লেখার চল কমেছে, যে ভাবে টাইপরাইটার তৈরি বন্ধ হয়েছে, যে ভাবে ফিল্মের রোল ভরা ক্যামেরা আর সাদা-কালো টিভি উঠে যেতে বসেছে, ঠিক সে ভাবেই এ দেশে ১৬০ বছরের পুরনো টেলিগ্রাম ব্যবস্থার মৃত্যুসংবাদ ঘোষিত হয়ে গেল।
অথচ আজ থেকে পঁচিশ-তিরিশ বছর আগে পর্যন্তও জনজীবনে টেলিগ্রামের উপস্থিতি ছিল অমোঘ। কুরিয়ার পরিষেবা চালু হয়নি তখনও। মোবাইল ফোন নেই, ই-মেল নেই। ঘরে ঘরে টেলিফোনও নেই সব ক্ষেত্রে।
টেলিফোন থাকলেও বেশি দূর থেকে ফোনের খরচ কুলিয়ে ওঠা ছিল দুঃসাধ্য। ট্রাঙ্ক-কল ‘বুক’ করা ছিল বেশ ঝঞ্ঝাটের। অতএব জরুরি কথা দ্রুত পৌঁছতে টেলিগ্রামই ভরসা। তাই মধ্যবিত্ত পরিবারে অনেক সময়ই ‘টেলিগ্রাম’ বলে হাঁক শোনামাত্রই বুক ধুকপুক শুরু হয়ে যেত, ‘খারাপ খবর নয় তো?’ তবে টেলিগ্রামে যে শুধু খারাপ খবরই আসত তা-ও নয় অবশ্য! সন্তান জন্মের খবর, পরীক্ষায় পাশের খবর, চাকরি পাওয়ার খবরও তারযোগেই মিলত! ইংরেজির সিলেবাসে টেলিগ্রাম লেখাও শেখানো হত অনেক সময়। অপরেশ লাহিড়ীর জনপ্রিয় গান আর শিশুপাঠ্য ছড়ায় ‘টরে টক্কা’ মুখে মুখে ঘুরত। প্রথম বার টেলিগ্রাফে সংকেত পাঠানো দেখে বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গিয়েছিল অপু।
সাহিত্যিক নবনীতা দেবসেন মনে করেন, বিদেশে বাগদান-পর্ব মেটার পরে হবু স্বামীর (অমর্ত্য সেন) সঙ্গে ওয়েলস-এ বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে বাড়ির সকলকে পিকচার পোস্টকার্ড পাঠান। নবনীতা হাসতে হাসতে বলেন, “মা (রাধারানি দেবী) এর উত্তরে টেলিগ্রাম পাঠালেন। তাতে লেখা, “এনজয় ইওরসেল্ফ. ডোন্ট সেন্ড পিকচার পোস্টকার্ডস.’’ আবার দশম বিবাহবার্ষিকীতে অমর্ত্যর পাঠানো টেলিগ্রামটিও মনে আছে নবনীতার। অমর্ত্য তখন বিদেশে। টেলিগ্রাম এল, “কান্ট ফাইন্ড ফ্লোরিস্ট. ট্রিট দিস টেলিগ্রাম অ্যাজ ফ্লাওয়ার্স.”
এ হেন টেলিগ্রামের জন্ম উনিশ শতকের মাঝামাঝি। আমেরিকায় এফ বি মোর্স এবং ইংল্যান্ডে ডব্লিউ এফ কুকের নেতৃত্বে দু’টি গোষ্ঠী আলাদা ভাবে বৈদ্যুতিন টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। ১৮৪৫ সালের পর থেকে একে একে গড়ে উঠতে থাকে টেলিগ্রাফ সংস্থা। বিখ্যাত ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন-এর জন্ম ১৮৫১-য়। প্রায় দেড়শো বছর পর ২০০৬ সালে তারা টেলিগ্রাম পরিষেবা বন্ধ করেছে। শুধু ব্যক্তিগত বার্তা আদানপ্রদান নয়, ব্রেকিং নিউজের আগের যুগে সে রকম গুরুত্বপূর্ণ কোনও ঘটনা ঘটলেও টেলিগ্রাম প্রকাশ করে জানানো হত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর খবর টেলিগ্রামই জানিয়েছিল প্রথম।
পৃথিবী জুড়ে টেলিগ্রামের সেই প্রতাপ অবশ্য কমে এসেছিল অনেক আগেই। ফেসবুক-এসএমএস-টুইটারের যুগে টেলিগ্রামের কার্যকারিতা বহু দিনই অবলুপ্ত প্রায়। ছেদ-যতি-ফাঁক ব্যবহারের খরচ বাঁচানোর জন্য বানান করে ‘স্টপ’ লেখার প্রয়োজন শেষ। বিএসএনএল কর্তৃপক্ষ এত দিনে ডাক বিভাগের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পর টেলিগ্রাম পরিষেবা আনুষ্ঠানিক ভাবে বন্ধ করার সিদ্ধান্তই নিয়েছেন। উদ্বৃত্ত কর্মীদের অন্যান্য বিভাগে কাজ দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে।
১৮৪৪ সালের ২৬ মে। ওয়াশিংটন থেকে বাল্টিমোর পৌঁছেছিল স্যামুয়েল মোর্সের প্রথম টেলিগ্রাম। তাতে লেখা ছিল, “হোয়াট হ্যাথ গড রট?”
২০১৩, ১৫ জুলাই। ভারতের শেষ টরে টক্কা বলবে, টেলিগ্রাম এক্সপায়াডর্।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.