|
|
|
|
রসে বশে
জীবনকে বশ মানাতে গেলে বাঁচতে হবে রসেই? রসবোধ আবার অনেকের
কম থাকে।
বাড়ানোর উপায় কী? খোঁজ করলেন রেশমি বাগচী |
দেবাশিস রোজ নিয়ম করে সকালে লাফিং ক্লাবে যান। এক ঘণ্টা দু’হাত তুলে বারেবারে ঢেউয়ের ওঠানামার মতো হাসেন। অফিস সেরে বাড়িতে ফিরে, রাতে ডিনার করার সময় দেখেন লাফটার চ্যালেঞ্জের মতো শো। তখন আবার অর্চনা পূরণ সিংহ-র সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে এমন তারস্বরে হাসেন যে, দরজা জানলাগুলো পর্যন্ত ঝনঝন করে ওঠে। সম্প্রতি একটি ম্যাগাজিনে পড়েছেন হাসি-মশকরা ভাল থাকার জন্য কতটা জরুরি। তার পর থেকেই এই রুটিন। কিন্তু ২৪ ঘণ্টার ঝক্কি সামলাতে মাত্র দু’ঘণ্টা হাসি? গব্বর সিংহ হলে বলতেন, “বহুত না ইন্সাফি হ্যায় রে।” কেমন হয়, যদি সারা ক্ষণই আপনি রসেবশে থাকতে পারেন? এর জন্য কাঠখড় পোড়ানোরও কিছু নেই। এই গুণ আপনার মধ্যেই আছে। আপনার একান্ত নিজস্ব রসবোধ। ভাবছেন, যার সেন্স অব হিউমার নেই তিনি কী করবেন! ইচ্ছে থাকলে, উপায়ের অভাব হয় নাকি!
হাসির ঘটনায় হেসে ফেলুন ‘মুন্নাভাই এমবিবিএস’-এ মনে পড়ে বোমান ইরানির চরিত্র, ডা. আস্তানার কথা? মুন্না যেই কোনও কাণ্ড করতেন, অমনি তিনি হেসে উঠতেন, নিজেকে শান্ত রাখার জন্য। ওই দৃশ্য দেখে কতই না হেসেছেন আপনি। এ বার ভাবুন আপনি এ রকম কোনও অপছন্দের পরিস্থিতিতে পড়লেন। কী করবেন তখন? সানি দেওলের মতো নলকূপ উপড়ে ফেলবেন? (যদিও পারবেন না) ধুর ধুর, মোটেও না। রাগ তো দূরের কথা, দেখলেন দিব্যি ব্যাপারটা উপভোগ করছেন আপনি। আপনার রসবোধই আপনাকে এই পথ দেখায়। কারণ সমাজতত্ত্ববিদ অভিজিৎ মিত্রর কথায়, সেন্স অব হিউমার মানুষকে সহনশীল করে তোলে। অপরের প্রশংসা করতে শেখায়। পরিচালক সুজিত সরকার মনে করেন, নিজেকে নিয়ে, নিজের বেকায়দায় থাকা জীবন নিয়ে যিনি হাসতে পারেন, তিনিই প্রকৃত রসিক। তিনি মনে করেন, এর ফলে চারপাশ সম্পর্কে সচেতনতাও বাড়ে। চিকিৎসক সুব্রত মৈত্র বলছেন, “রোজকার জীবনে মধ্যে থেকেই খুঁজে নিতে হবে হাসির রসদ। নানা অসঙ্গতি থেকেই তো তৈরি রসিকতা। আর অসঙ্গতি ঘটছে আমাদের জীবনে প্রত্যেক মুহূর্তে। সেন্স অব হিউমারের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি স্ট্রেস থেকে মুক্তি পান। রসিকতায় তাঁর ভেতরের সব টক্সিনও বিদায় নেয়। একজন চিকিৎসকের খুব সুবিধা হয়, রোগীর সঙ্গে কমিউনিকেট করতে।” |
|
হাসছি আমি হাসছি দেখো: মিমি চক্রবর্তী। ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল |
|
মনোজয়, হোটেল ম্যানেজমেন্টের ছাত্র। পড়াশুনোর শেষে প্লেসমেন্ট কোথায় হবে, কী করবে, এই সব চিন্তা মাথায় ভিড় করে থাকে। বন্ধুদের সঙ্গেও খুব বেশি দেখাসাক্ষাৎ হয় না। খুব ‘অফিশিয়াল’ হয়ে গিয়েছে, বুঝতে পারছে। সারাদিনে ক’বার হাসে গুনে বলতে হবে। রসিকতা তো দূরের কথা।
মনোজয়ের মতো অবস্থায় কী করে নিজের মধ্যে রসবোধ বাড়াবেন কেউ?
উপায়-১ রবীন্দ্রনাথের লেখা দু’টো লাইন মনে করলেন সমাজতত্ত্ববিদ অভিজিৎ মিত্র। কবিগুরু লিখেছেন, ‘বাজে কথাতেই মানুষের আসল পরিচয় পাওয়া যায়’। এখানে বাজে কথা বলতে যা কাজের কথা নয়, তাই বুঝিয়েছেন উনি। অথচ এখন মানুষ কাজের বাইরে বাড়তি কথা প্রায় বলেন না। স্বার্থ ছাড়াও কথা বলুন, পরামর্শ অভিজিৎ মিত্রর।
উপায়-২ অভিনেতা শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় বললেন, “বাঙালির যাচ্ছি-যাব হাবভাবই তাদের রসিক করে তোলে। অফিসে যাওয়ার পথে, কারও সঙ্গে দেখা হল, দু’টো কথা হল, খানিক গুল দিল, হ্যা-হ্যা করে হাসল, একটু সমালোচনা করল এই সবের মধ্যে রসিকতাই তো প্রধান এলিমেন্ট।” রসবোধের চর্চা করতে একটুআধটু গুল মারাই যায়, কী বলেন?
উপায়-৩ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুকুমার রায়, শিবরাম চক্রবর্তী, তারাপদ রায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখের লেখা পড়লে রসবোধ ভেতর থেকে লাভার মতো বেরিয়ে আসবে। হলফ করে বলছেন চন্দ্রবিন্দুর অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কথায় ‘সিং নেই তবু নাম তার সিংহ, ডিম নয় তবু অশ্বডিম্ব’ বা ‘আমি শ্রী শ্রী ভজহরি মান্না’। এ রকম অনেক গান শুনে আমাদের রসবোধের ভাণ্ডার ফুলেফেঁপে ওঠে।
উপায়-৪ সুজিত সরকার ‘চুপকে চুপকে’, ‘ধন্যি মেয়ে’, ‘বাতোঁ বাতোঁ মে’, ‘সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্ট্যান্ট’ এই রকম কমেডি ছবি মাঝে মাঝেই দেখেন। শোনেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অডিও সিডি। “ওঁর স্পুটনিক রামায়ণ কত বার যে শুনেছি, তার ঠিক নেই। ভেতরের এই ভালবাসা থেকেই, ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’ তৈরির কথা ভেবেছি। বাঙালির এই সেরিব্রাল ইন্টেলিজেন্স, রসিকতা পৃথিবীর অনেকেই জানে না। সবাই জানুক, কত রসবোধ আছে বাঙালিদের।”
প্রমের ফাঁদে রসিকতা
নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী বলছেন, “আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে যা অবশ্য করে পেয়েছি, তা হল রসবোধ। বলা হয়, ঈশ্বর স্বয়ং রসের স্বরূপ। সংসারে প্রতি মুহূর্তে যার একান্ত প্রয়োজন। আপনার মধ্যে রসবোধ না থাকলে, পৃথিবীর এত রস উপভোগ করবেন কী করে?” সৌগত সদ্য কলেজে ঢুকেছে। ওঁর অন্য কিছু নিয়ে মাথাব্যথা নেই। একটাই প্রশ্ন, প্রেমের ক্ষেত্রে এই রসবোধ কেন এত জরুরি? নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী বললেন শ্রীকৃষ্ণের কথা। শ্রীকৃষ্ণ চূড়ান্ত রসবোধের অধিকারী ছিলেন। তাঁর মতো কথা বলার ক্ষমতা আর কারও নেই। কী রঙিন তার প্রেমলীলা রাধিকার সঙ্গে, গোপিনীদের সঙ্গে তা তো আমরা সবাই জানি। এমনকী রাজনীতিতেও তাঁর রসিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত। সুবিধা আরও আছে। “প্রেমে রসবোধ অনেক বিপজ্জনক মুহূর্ত নিমেষে সামলে দেয়, প্রেমিকা রাগে বা অভিমানে গম্ভীর হয়ে থাকলে তার সঙ্গে ফস্টিনষ্টি করেই রসবোধ জাগিয়ে তোলা যায়,” বলছেন অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়।
সংসার সুখের হয় রসবোধের গুণে
শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় বলছেন, “স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একজনের অন্তত রসবোধ থাকা খুব জরুরি। না থাকলে, জীবন খুব স্ট্রেসফুল হয়ে ওঠে। কারণ ওই রসবোধই কঠিন থেকে কঠিনতর পরিস্থিতিতে হাল্কা রাখতে পারে। না হলে দিনের পর দিন একজনের সঙ্গে সংসার করা মুশকিল হয়ে পড়ে।”
প্রেমিকার ক্ষেত্রে যে রসিকতা দারুণ খাটে, বাড়িতে স্ত্রীয়ের সঙ্গে সেটা আদৌ খাটে না। যেমন সফ্টওয়্যার কোম্পানির কর্মী দেবজিৎ সাহা এ ব্যাপারে কিছুটা বিভ্রান্ত। এমনিতে ওঁর সেন্স অব হিউমার নিয়ে বন্ধুমহলে বেশ নামডাক আছে, কিন্তু বাড়িতে স্ত্রী-র সামনে ওর যাবতীয় রসবোধ গুবলেট হয়ে যায়। “স্ত্রীর সঙ্গে রসিকতা করতে হলে, তাঁর সঙ্গে কাটানো পুরনো দিনের মুহূর্ত মনে করিয়ে দিয়েই রসিকতা করলে তার মধ্যে একটা উষ্ণতা থাকে,” জানালেন অনিন্দ্য।
“কিন্ত খুব গুরুতর বিষয়ও হাল্কা চালে বললে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও রসিকতার সম্পর্ক তৈরি হতে পারে,” মত সুজিত সরকারের। আগে স্পার্ম ডোনেশন নিয়ে সবার সামনে কেউ কথাই বলতেন না। আর এখন? সুজিত তাঁর অভিজ্ঞতা ভাগ করলেন। বললেন, “একটি বাচ্চাদের অনুষ্ঠানে স্বামী-স্ত্রী সঙ্গে দুটি সন্তান
নিয়ে এসেছেন, তারা যমজ। একজন জিজ্ঞেস করলেন “কার মতো
হয়েছে ওরা? বাবা না মা? ভদ্রলোক অকপট উত্তর দিলেন, ‘ভিকি ডোনরের মতো।’ শুনে সবাই হেসে গড়াগড়ি।” সমাজতত্ত্ববিদ অভিজিৎ মিত্র
বলছেন, এই ফ্রিনেস থাকাটা খুব দরকার। একটা বিষয় অভিভাবকদের মনে রাখতে হবে, রসবোধ প্রথম বাড়িতেই প্রকাশ পায়। বাবা মায়ের সামনে। বাচ্চাকে বাড়িতে ইয়ার্কি, মজা, ক্যারিক্যাচার করতে দিতে হবে।
আর তার ওই মজা করায় বাবা-মাকে অংশও নিতে হবে। আপনি নিশ্চয়ই চাইবেন আপনার সন্তানও আপনার মতো রসিক হোক।
অর্থাৎ রামগরুড়ের ছানা হয়ে লাভ নেই, তার চেয়ে বরং কাতুকুতু বুড়ো হওয়া ভাল। খেয়াল করে দেখবেন, আপনার পাশের মানুষটির কোনও কারণে যখন মন খারাপ, তখন তাকে আপনার রসিকতার মাধ্যমে হাসিয়ে কী দারুণ আনন্দ পাওয়া যায়। তাই তো সুকুমার রায় লিখেছেন, ‘যত ক্ষণ না হাসবে তোমার কিচ্ছুতে নাই ছুটি’।
|
হাসির সহজ পাঠ |
পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
১) একদম ভাববেন না আপনার মধ্যে হিউমার নেই। সবার মধ্যেই রসবোধ আছে, হয়তো প্রকাশ করতে পারেন না অনেকে
২) যে কোনও কথা শুনে তার সোজা অর্থ না ধরে, দ্বিতীয় অর্থ খোঁজার চেষ্টা করুন, দেখবেন ব্যাপারটা দারুণ মজার
৩) কয়েকটা জোকস মনে রেখে দিন। বাড়িতে প্র্যাকটিস করুন, তার পর সবার সামনে বলুন
৪) প্রথম প্রথম রসিকতায় একটু আধটু এদিক ওদিক হতেই পারে, তাতে হতাশ হবেন না। হিউমারের ক্ষেত্রে টাইমিং ভাল হতে হয়। ‘তাই, তুমি ছিলে?’ কথাটা অনেক রকম ভাবে বলা যায়। এমন ভাবে বলুন যেন অন্যের কাছে কিছুটা শ্লেষযুক্ত মনে হয়
৫) একটু দুষ্টুমি করা শুরু করুন। অন্যের লেগ পুল করা, প্রশংসা করা— এমন ভাবে যার দু’টো মানে হতে পারে |
|
বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী
১) রসসাহিত্য চর্চা করুন। দেখবেন গল্পে পড়া নানা মজা, ঠিক নিজের জীবনে কাজে লাগাতে পারছেন
২) পেট পরিষ্কার রাখুন, না হলে মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে থাকবে। ভালমন্দ খাবেন, তাতে রসবোধ বাড়বে
৩) প্রেম করুন, বিশেষ করে পরকীয়া। প্রেমিকা আর গিন্নি দু’জনকে সামলাতে আপনার রসবোধই একমাত্র উপায়
৪) রসিকতা বাড়ানোর জন্য লাফিং ক্লাবে যাবেন না। জোর করে হাসির প্রয়োজন নেই। উলটে আপনার সম্ভাবনাময় রসবোধ শামুকের মতো খোলসে ঢুকে পড়তে পারে
৫) হয়তো আপনি একটু চুপচাপ গোছের, সবার সঙ্গে প্রথম প্রচুর কথা বলা শুরু করুন। কে কী বলছেন, সে দিকে খেয়াল রাখুন, কথার সূত্র ধরে পাল্টা রসিকতা করুন |
|
মীর
১) প্রথমেই দেখেশুনে চট করে বিয়ে করে ফেলুন। বাসর ঘরে এমন একজন থাকবেন, যাঁর ভাণ্ডারে থাকবে অনেক গান। ভাঙা হারমোনিয়াম নিয়ে তিনি একটার পর একটা গান শোনাতে থাকবেন। এ দিকে এত রকম আচার-আচরণ সামলে আপনার খুব ঘুম পাচ্ছে। সেই সময় আপনাকে হাসি মুখে গানগুলো শুনে যেতে হবে এবং প্রশংসাও করতে হবে। রসবোধ বেরিয়ে আসবেই। আপনার ফুলশয্যার রাত নিয়ে পাড়া-প্রতিবেশী-বন্ধু-আত্মীয়দের কী প্রচণ্ড উৎসাহ! আপনি আপনার গ্যাঁটের টাকা খরচ করে বিয়ে করেছেন। অথচ বাকিদের ফুলশয্যা নিয়ে এত উৎসাহ দেখে হাসি পেতে বাধ্য আপনার
২) এমন একটা বন্ধু পাতিয়ে ফেলুন, যিনি মাঝে মাঝেই আপনার কাছ থেকে টাকা ধার নেবেন। প্রতিবার এসে একই ডায়লগ দেবেন, খুব লজ্জা করছে চাইতে, কিন্তু পরের বার পুরো টাকা শোধ করে দেব। অনেকটা আবহাওয়া দফতরের মতো, যা বলবে তা হবে না। তখন দেখবেন টাকা দিচ্ছেন, আর নিজের ওপরই কেমন হাসি পাবে
৩) একটা রুদ্রাক্ষের মালা কিনে জপ করুন। আইপিএল-এ কোনও কেলেঙ্কারি নেই, শ্রীসন্ত নির্দোষ, চান্ডিলা খুব ভাল ছেলে। এমনটা করতে করতে দেখবেন এক সময় অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন
৪) রাতে আপনার স্ত্রী যখন একগাদা ক্রিম মাখতে মাখতে আপনাকে জিজ্ঞেস করবেন, হ্যাঁ গো, আমি কি মোটা হয়ে গিয়েছি? বা আমাকে কতটা সুন্দর লাগে তোমার? সঠিক উত্তর দিলে, বাড়িতে আপনার থাকা হবে না। তাই মিষ্টি হেসে উত্তর দেবেন, খুব রোগা দেখাচ্ছে তোমাকে কয়েক দিন ধরে। এই ভাবে খাওয়াদাওয়া কমিয়ে দিলে তোমাকে চেনাই যাবে না। হাসি চেপে এই কথা বলতে হলে, সেন্স অব হিউমার বাড়বেই
৫) সকালবেলা উঠে আপনার পাসবুকটা দেখবেন। দেখবেন কী ভাবে একটু একটু করে টাকার অঙ্ক কমছে। দেখে হাসি পাবে। এত খাটাখাটনি করে মাত্র এই টাকা পাই আমি |
|
|
|
|
|
|