অলীক কল্পনা
কজনের নাম রম্ভানী।

‘অলীক সুখ’ ছবিতে এ ভাবেই
বোঝানো হয়েছে ঋতুপর্ণার দ্বৈতসত্তা সোহিনীকে
আরেকজন কবিতা।
রম্ভানী জীবিত।
কবিতা তাঁর সন্তানকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা গিয়েছেন।
কিন্তু মারা যাওয়ার পর কবিতা আবার ফিরে আসেন রম্ভানীর জীবনে।
গল্প করেন ছাদে দাঁড়িয়ে।
আলোআঁধারি করিডরে হাত বাড়িয়ে দেন।
শোয়ার ঘরে ঢুকে ঝগড়া করে যান।
মাঝে মধ্যে দু’জনের গলার স্বর মিশে যায়।
কে এই কবিতা?
শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় আর নন্দিতা রায়ের ‘অলীক সুখ’য়ে কবিতার ভূমিকায় সোহিনী সেনগুপ্ত।
রম্ভানী হলেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত।
ভুল করে কিন্তু কবিতাকে ভূত মনে করবেন না। পুরনো বাংলা ছবির বিবেকের ভূমিকায়ও তিনি নেই এখানে। সিনেমায় কবিতা হলেন রম্ভানীর দ্বৈতসত্তা।
বিদেশের সিনেমায় দ্বৈতসত্তা বা ‘ডপেলগ্যাঙ্গার’রা বারবার ফিরে ফিরে এসেছেন। তা সে নাতালি পোর্টম্যানের ‘ব্ল্যাক সোয়ান’ হোক কী হেনরি সেলিকের ‘ক্যারোলিন’। হলিউড অভিনেত্রী ড্রিউ ব্যারিমোর ১৯৯৩ সালে করেছিলেন ‘ডপেলগ্যাঙ্গার’। এক লেখকের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক তৈরি হয়। কিন্তু অদ্ভুত কিছু ঘটনার পরে, দর্শক বুঝতে পারেন না যে, লেখক যাঁর প্রেমে পড়েছেন তিনি কি ড্রিউ ব্যারিমোর নিজে, না তাঁর দ্বৈতসত্তা (‘ইভল টুইন’)?
কিন্তু বাংলা সিনেমাতে ‘ডপেলগ্যাঙ্গার’য়ের কনসেপ্টটা বেশ নতুন। এই সপ্তাহে মুক্তি পেতে চলেছে ‘অলীক সুখ’। পরিচালকরা মনে করছেন হয়তো বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এই প্রথম এই টেকনিকটা ব্যবহার করা হয়েছে। সিনেমাতে ঋতুপর্ণার স্বামীর ভূমিকায় রয়েছেন দেবশঙ্কর হালদার। তিনি এক নামী ডাক্তার। প্রসবের সময় সোহিনীর মৃত্যু হয়। তার জেরেই নার্সিং হোমে শুরু হয় ভাঙচুর। খবর পেয়ে ঋতুপর্ণা ছুটে যান সেখানে।
ছবিতে ঋতুপর্ণা অন্তঃসত্ত্বা। “প্রথম বার সোহিনীকে দেখি নার্সিং হোমের মর্গে। তার পর সোহিনীর চরিত্রটি মাঝে মাঝেই আমার জীবনে ফিরে আসে। কথা বলে। ঝগড়া করে। মনে করিয়ে দেয় যে ওর সঙ্গে যা হয়েছে তা ঠিক নয়। চিকিৎসার গাফিলতির দায় কিছুতেই দেবশঙ্কর এড়িয়ে যেতে পারবে না। আমি শুনতে পাই সোহিনী আমাকে বলছে, ‘ন’মাস পেটে রাখলাম। একবার যদি মুখটা দেখে মরতাম!’” বলছেন ঋতুপর্ণা।
তার পর শুরু হয় ঋতুপর্ণার বিবেক দংশন। ভয় হতে থাকে সোহিনী হয়তো তাঁর স্বামী আর সন্তানের ক্ষতি করবেন। মাঝে মধ্যেই নিজের দ্বৈতসত্তাকে দেখতে পান তিনি।
কিন্তু কেন এই পরীক্ষা? “মানসিক দিক থেকে কেউ যখন একটু ভঙ্গুর হয়ে পড়েন, তখন মনের মধ্যে অনেক রকম চিন্তাভাবনা চলতে থাকে। ‘অলীক সুখ’য়ে আমার চরিত্রের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব কাজ করছে, সেগুলোর বহিঃপ্রকাশ হয়েছে এই ‘ডপেলগ্যাঙ্গার’ কৌশলটা ব্যবহার করে,” বলছেন ঋতুপর্ণা।
সুচিত্রা ভট্টাচার্যের উপন্যাসে দ্বৈতসত্তার উল্লেখ নেই ঠিকই। “কিন্তু আমার পরে মনে হয়েছিল যে, উপন্যাস নিয়ে সিনেমা করতে গেলে এই পরীক্ষাটা করার জায়গা রয়েছে,” সোহিনী বলছেন।

‘ডপেলগ্যাঙ্গার’
নিজে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী। ‘ডপেলগ্যাঙ্গার’ নিয়ে পড়াশোনা আছে তাঁর। “ওয়ার পোয়েট্রিতে অনেক সময় দেখেছি কী ভাবে সৈনিকরা যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে নিজেদের দ্বৈতসত্তা দেখতে পেতেন। আমি দিদি আর শিবু (নন্দিতা আর শিবপ্রসাদ)-কে বলি কেমন হয়, যদি আমাদের সিনেমাতে এই রকম একটা পরীক্ষা করা যায়? ওঁরা রাজি হয়ে যান,” বলছেন সোহিনী।
পরীক্ষা শুরু হয়। কিন্তু খেয়াল রাখতে হয় যাতে সোহিনীর চরিত্রটিকে কোনও ভাবেই ভৌতিক না লাগে। হয়তো একটা ফ্রেমে সোহিনী আর ঋতুপর্ণা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। সিনেমার পোস্টারে ওঁদের দুজনের ছবিগুলো বেশ পরিষ্কার। কিন্তু সিনেমাতে সোহিনীর ইমেজটা নাকি ইচ্ছে করেই একটু ঝাপসা করে দেওয়া হয়েছে।
“আমার চিত্রপরিচালক শীর্ষ রায়ের সঙ্গে আলোচনা করি, ঠিক কী ভাবে ইমেজের মাধ্যমে আমরা দ্বৈতসত্তাকে ছবিতে তুলে ধরতে পারব। ঠিক হয় মুম্বই থেকে একটা লেন্স আনা হবে। ‘টিল্ট অ্যান্ড শিফ্ট ফোটোগ্রাফি’ ছাড়া এ ভাবে দু’টো ইমেজকে ছবিতে ফুটিয়ে তুলতে পারতাম না আমরা,” বলছেন শিবপ্রসাদ।
তবে সব চেয়ে অভিনব পরীক্ষাটা করা হয়েছে ডাবিংয়ের সময়। শব্দের ব্যবহারটা ঠিক কী ভাবে করা হবে, সেটা নিয়ে আলোচনা করা হয় অনির্বাণ সেনগুপ্ত আর দীপঙ্কর চাকির সঙ্গে। নন্দিতা জানাচ্ছেন প্রথমে ঠিক হয়েছিল ঋতুপর্ণার গলাটাই যদি সোহিনীর জন্য ব্যবহার করা হয়। কিন্তু তার পর ঠিক হয় ঋতুপর্ণার পিচ-এর সঙ্গে একেবারে মিলিয়েই সোহিনীকে ডাব করানো হবে।
মাঝে মধ্যে ছবিতে এমন ভাবে সোহিনী আর ঋতুপর্ণার ভয়েস ট্র্যাককে প্রায় পাশাপাশি ব্যবহার করা হয়েছে যে, দর্শকের মনে একটা দ্বন্দ্ব কাজ করতেই পারে। “দর্শক ভাবতেই পারেন এটা কি ঋতুপর্ণা কথা বলছেন? নাকি সোহিনী নিজে?” জানাচ্ছেন শিবপ্রসাদ।
শুধু তাই নয়। পোশাকের দিক থেকেও এই ব্যাপারটা মাথায় রেখেছেন সোহিনী। সোহিনীর চরিত্রটি একেবারেই নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের। সাধারণ ভাবে দেখতে গেলে, ভাষার পালিশ না থাকাটাই স্বাভাবিক এই চরিত্রে। “কিন্তু যখন ঋতুর সঙ্গে ও কথা বলে, ওর পোশাক-আশাক, ভাষাটা বেশ পালটে যায়। মার্জিত একটা ভাব চলে আসে ওর কথার মধ্যে। সাউথ কটনের শাড়ি পরে ও। ছবিতে আমার চরিত্রটির নাম কবিতা। আমরা ঠিক করি ও যখন ঋতুর সঙ্গে কথা বলবে, তখন সংলাপে যেন একটা ছন্দ থাকে,” বলছেন সোহিনী।
আর লুক? সেটা কি ইচ্ছে করেই বেশ গথিক স্টাইলে করা? সোহিনীর চোখে ঘন কাজল। মাথা থেকে নেমে আসা এক ঢাল খোলা কোঁকড়া চুল। বলছেন নন্দিতা, “গথিক স্টাইলটা মাথায় রেখেই সোহিনীর লুকটা আমরা ঠিক করেছিলাম। সারাক্ষণ ওর পরনে কালো শাড়ি। চোখের তলায় কাজলটা ইচ্ছে করেই ধেবড়ে দিই।”

‘ব্ল্যাক সোয়ান’
পুরনো জার্মান ছবিটিতে প্রায় একই ভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল ‘ডপেলগ্যাঙ্গার’-এর কৌশলটা। মূল চরিত্রটিকে তাঁর দ্বৈতসত্তা এসে বুঝিয়ে দিতেন তিনি যে ভয়ঙ্কর একটা দোষ করেছেন, তার মূল্য তাঁকে দিতে হবেই। “এই ‘গিল্ট ফ্যাক্টর’-টা ঋতুপর্ণার চরিত্রে বারবার উঠে আসে। সোহিনী ওকে যা যা বলে, সেগুলো আসলে ওর নিজেরও কথা। ও নিজেও মনে করে সোহিনীর মৃত্যুর কারণ যেহেতু ওর স্বামী, তাই সোহিনী হয়তো ওর বাচ্চাকেও শেষ করে দেবে,” বলছেন শিবপ্রসাদ।
অনেকের ধারণা, দ্বৈতসত্তার সুচিন্তিত ব্যবহারের ফলে নাতালি পোর্টম্যান অস্কার জিতেছিলেন ‘ব্ল্যাক সোয়ান’ ছবিতে। যখনই মানসিক দিক থেকে নড়বড়ে হয়ে পড়তেন নাতালি, নিজের দ্বৈতসত্তাকে দেখতে পেতেন তিনি।
ঋতুপর্ণা ‘ব্ল্যাক সোয়ান’ দেখেননি। বলছেন, “একবার কথা উঠেছিল যদি, ‘অলীক সুখ’-এ আমি দু’টো চরিত্রে অভিনয় করি। কিন্তু তার পর ঠিক হয় যে, দু’জন ভাল অভিনেত্রী একসঙ্গে কাজ করলে সেটাও বেশ জোরালো হবে।”
তবে এত কিছু থাকা সত্ত্বেও শিবু আর সোহিনী এ বিষয়ে একমত যে, ছবিটি দেখতে গেলে এত সব কৌশলগত ব্যাপার না বুঝলেও চলবে। সোহিনী বলছেন, “যাঁরা দ্বৈতসত্তার ব্যাপারটা জানেন, তাঁরা সিনেমাটা দেখে এগুলো ঠিক ধরতে পারবেন। আমার বাবা (রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত) ছবিটি দেখলে হয়তো ‘ডপেলগ্যাঙ্গার’ নিয়ে ভাববেন।”
তবে শেষ কথা একটাই। কেউ যদি ‘অল্টার ইগো’, ‘ডপেলগ্যাঙ্গার’-এর মতো ভারিক্কি শব্দের বোঝা না নিতে চান, তাতেও ছবিটি বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.