যে যার মতো নিজের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়িতে ওঠার আগে কয়ালপাড়ার মুখে শিবের থানে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করলেন। নারী-পুরুষ সকলে। পাড়ি দিতে হবে প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার পথ। ট্রেনে কাটাতে হবে গোটা একটা রাত। সব মিলিয়ে ১৮ ঘণ্টার যাত্রা। যাত্রা যাতে নিরাপদে ও নির্বিঘ্নে হয়, এ সব ক্ষেত্রে ঈশ্বরের কাছে সেই প্রার্থনাই সাধারণত করা হয়ে থাকে। কিন্তু রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে দিল্লি রওনা হওয়ার আগে কামদুনির বাসিন্দারা বললেন, “দোষীদের যেন ফাঁসির ব্যবস্থা করে আসতে পারি, ঠাকুরের কাছে সেটাই বললাম।”
তিন-চার দিনের জন্য ঘর-সংসার-বাচ্চাকাচ্চা ছেড়ে এতটা পথ উজিয়ে যাওয়ার উৎকণ্ঠা আছে। ট্রেনে চড়ে দেশের রাজধানীতে গিয়ে রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে দেখা করার কথা মাথায় রেখে উত্তেজনা আছে। গ্রামে আসা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে সুবিচার চেয়ে মাওবাদী ও সিপিএম তকমা জোটার পর এ বার আবার কী পরিণতি হয়, তা নিয়ে চাপা ভীতিও আছে। কিন্তু কামদুনির অটল সেই সঙ্কল্প যে এতটুকু টাল খায়নি, সেটা এ দিন গ্রামবাসীদের কথা থেকেই পরিষ্কার। প্রত্যেকেরই বক্তব্য, “এর শেষ দেখে তবেই ছাড়ব।”
কারা দিল্লি যাবেন, সেই তালিকা গত সাত দিন ধরে তৈরি করেছে কামদুনি। এই নিয়ে প্রতি সন্ধ্যায় গ্রামে সভা বসেছে। প্রথমে ৮০ জনের নাম বাছা হয়। তার থেকে পাঁচ দফা আলোচনার শেষে ৫৬ জনকে বাদ দিয়ে ২৪ জনের একটি প্রতিনিধিদল চূড়ান্ত করা হয়। |
সব মিলিয়ে, গত ৭ জুন হওয়া এক নারকীয় ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওই জনপদের মানুষ যেন ক্রমেই এক সামাজিক আন্দোলনের দিকে এগোচ্ছেন বলে অনেকেরই অভিমত।
শাসকদলের পক্ষ থেকে অবশ্য এ দিনও কটাক্ষ করা হয়েছে কামদুনিকে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কামদুনি গিয়ে টুম্পা কয়াল, মৌসুমী কয়ালের মতো গ্রামের মহিলাদের মাওবাদী ও সিপিএম তকমা দিয়েছিলেন। শনিবার শাসনে এক নির্বাচনী জনসভায় মমতা নিজে কামদুনি নিয়ে কিছুটা সংযত বক্তব্য পেশ করলেও রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম বসিরহাটের মেটিয়া হাইস্কুলের মাঠের এক জনসভায় বলেন, “আমি একটা বই দেখেছিলাম অমিতাভ বচ্চনের ‘ম্যায় আজাদ হুঁ’। সেখানে দেখেছিলাম মিডিয়ার গ্যাস খেয়ে এক জন নেতা হল, তার পর মিডিয়ার গ্যাস খেয়ে সে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করল। আমি আল্লার কাছে প্রার্থনা করছি, আমার ওই ছোট দু’টো বোনের যেন মিডিয়ার গ্যাস খেয়ে সে রকম অবস্থা না হয়!” ববি নাম উল্লেখ না-করলেও তিনি টুম্পা ও মৌসুমীকে ইঙ্গিত করেছেন বলেই গ্রামবাসীদের মনে হচ্ছে।
অন্য দিকে, মুখ্যমন্ত্রী এ দিন বলেন, “আমি কিছু দিন আগে কামদুনি গ্রামে এসেছিলাম। এলাকায় কিছু নেই। এক দিকে রাজারহাট, আর এক দিকে অনেক দূরে বারাসত থানা। শীঘ্রই বারাসত থানাকে ভেঙে আরও তিনটি থানা করা হবে। আমি কামদুনির ঘটনায় ২২ দিনের মধ্যে চার্জশিট দিয়ে দিয়েছি। ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে বিচার চলছে। শাস্তি হবে।” কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর ওই কথা যে কামদুনির মানুষের কাছে যথেষ্ট নয়, সেটা এ দিনও গ্রামের বাসিন্দাদের মনোভাব থেকেই পরিষ্কার। |
কামদুনির প্রায় সবার কাছেই এত দিন পর্যন্ত রেলে যাওয়ার জায়গা বলতে ছিল বড়জোর বনগাঁ বা শিয়ালদহ। রাতভর ট্রেনযাত্রা, দিল্লিতে দু’রাত তিন দিন থাকার (মঙ্গলবার বিকেলে তাঁরা ফেরার ট্রেন ধরবেন) প্রস্তুতি নিতে বিস্তর সমস্যাও হয়েছে কারও কারও। আবার সেটা যাতে তাঁদের যাওয়ার পথে বাধা না-হয়ে দাঁড়ায়, সে জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন গ্রামের অন্যরা।
গ্রামের যুবক করুণা মণ্ডলের ঠিকঠাক জুতো ছিল না। সুজিত কয়ালের কাছ থেকে ৫০০ টাকা ধার করেন তিনি। তার পরে ২২০ টাকা দিয়ে একজোড়া জুতো কেনেন। বাকি টাকা রেখে দিয়েছেন, যদি দিল্লিতে কোনও দরকার হয়। দিল্লি যাওয়ার জন্য করুণাকে একটি জামা ধার দিয়েছেন রাধেশ্যাম নস্কর। সাগর নস্কর যেমন নিজের জুতো ধার দিয়েছেন ভাস্কর মণ্ডলকে। সুদীপ কয়াল নিজের মোবাইল এ ক’দিনের জন্য তুলে দিয়েছেন টুম্পা কয়ালকে।
কামদুনিতে মুখ্যমন্ত্রীকে সরাসরি প্রশ্ন করতে চেয়েছিলেন টুম্পা। দিল্লিযাত্রায় তাঁর সঙ্গী হয়েছেন মা মলিনা এবং বাবা প্রভাস কয়ালও। দিল্লি গিয়ে পরার জন্য টুম্পার মা-কে একটি তাঁতের শাড়ি দিয়েছেন বুলা কয়াল। মুখ্যমন্ত্রীকে নিজেদের দুর্দশার কথা জানাতে গিয়ে রাজ্য গোয়েন্দা শাখার রিপোর্টে নাম ওঠে মৌসুমী কয়ালের। এ দিন তাঁর সঙ্গে দিল্লি রওনা হলেন তাঁর স্বামী বিশ্বজিৎ ও জা সরমা। দুই বউ এবং এক ছেলে থাকবেন না, ঘরদোর সামলাতে হবে মৌসুমীর বৃদ্ধা শাশুড়ি সবিতা দেবীকে। সেই সঙ্গে দেখভাল করতে হবে বাচ্চাদের, যার মধ্যে আছে মৌসুমীর ছোট মেয়ে, আট বছরের দিয়াঞ্জলি। কোনও দিন তাকে ছেড়ে এক রাতও কাটাননি মৌসুমী। বাড়ি থেকে বেরোতে গিয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে অঝোরে কেঁদে ফেলেন তিনি। বলেন, “এইটুকু মেয়েকে রেখে যাচ্ছি। যে-কাজে এত দূর যাচ্ছি, জানি না, তার কী হবে। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে এত গণ্ডগোল হল, এ বার না-জানি কী হয়!” শাশুড়ি সবিতা ছোট বউমাকে আশ্বাস দিলেন, “আমি তো আছি। কোনও চিন্তা কোরো না।”
২৪ জনের এই দলে মহিলা রয়েছেন মোট পাঁচ জন। গ্রামের বয়স্ক মহিলারা তাঁদের বারবার বলে দিয়েছেন, ‘আমাদের রাষ্ট্রপতি বাঙালি, উনি বয়স্ক মানুষ। ওঁর সামনে প্রত্যেকেই তাঁতের শাড়ি পরে ঘোমটা দিয়ে যাবে।’
মৌসুমীরা যে দুশ্চিন্তা করছেন, তাকে নেহাতই অমূলক বলছেন না অনেকে। বরং রাজ্যের মন্ত্রী ববি হাকিমের বক্তৃতার দিকে ইঙ্গিত করেছেন তাঁরা। ববি এ দিন বলেন, “দিদি (মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) যদি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকদের জানিয়ে কামদুনি যেতেন, তা হলে ওখানে এক লক্ষ মানুষ থাকত। ওখানে দু’টি মেয়ে লাফালাফি করছিল। তা হলে তাদের ক্ষমতা হতো না এই সব করার।”
নিহত ছাত্রীর পরিবারের সদস্যদের মধ্যে তাঁর বাবা, দুই ভাই এবং এক খুড়তুতো ভাই ওই দিল্লির দলে আছেন। তাঁরা যখন রওনা হচ্ছেন, সেই সময়ে ছোট ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন নিহত ছাত্রীর মা। বলেন, “অত দূরে যাচ্ছিস, তোর দিদির খুনিদের ফাঁসির ব্যবস্থা করে তবেই আসবি। তবেই আমি শান্তি পাব।” কামদুনি-কাণ্ডের প্রতিবাদে পড়ুয়াদের নিয়ে মিছিল করার জন্য শো’কজ করা হয়েছে যাঁকে, কামদুনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সেই প্রধান শিক্ষক প্রদীপ মুখোপাধ্যায়ও যাচ্ছেন টুম্পা-মৌসুমীদের সঙ্গে। স্কুলে মিড ডে মিল রান্না করেন যাঁরা, সেই কাজল নস্কর, ঊষা নস্করেরা ছলছলে চোখে প্রদীপবাবুকে বলেন, “সাবধানে থাকবেন। আপনার নিজের সমস্যার কথাও বলবেন।” প্রদীপবাবু অবশ্য তাঁদের বলেন, “আমি আমার সমস্যার কথা বলতে যাচ্ছি না। আমি সিবিআই তদন্তের দাবি জানাতে দিল্লি যাচ্ছি। সিআইডি-র উপর আমাদের ভরসা নেই।”
কিন্তু গোড়া থেকে কামদুনির এই আন্দোলনের যাঁরা সামনেই ছিলেন, সেই মিতা কয়াল, সাগর নস্করেরা দিল্লি গেলেন না কেন? মিতার কথায়, “গ্রামে বাইকবাহিনী ঢুকছে, বাড়ি বাড়ি হুমকি দিয়ে যাচ্ছে, এ সব নজরে পড়ছে না? গ্রামের সবাই রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করতে গেলে গ্রামটাকে পাহারা দেবে কে?”
রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কামদুনির বাসিন্দাদের দেখা করানোর ব্যবস্থা তো বটেই, সেই সঙ্গে তাঁদের রাজধানী এক্সপ্রেসের এসি-থ্রি টিয়ারে নিখরচায় যাওয়া-আসা, দিল্লিতে থাকা-খাওয়া সব কিছুই হচ্ছে রেল প্রতিমন্ত্রী তথা কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরীর উদ্যোগে। রেল সূত্রের খবর, কামদুনি থেকে তিনটি গাড়িতে নিয়ে তাঁদের শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছে দেওয়া এবং ফেরার পথেও স্টেশন থেকে গাড়ি করে নিয়ে গিয়ে তাঁদের গ্রামে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছে রেল মন্ত্রক। অথচ কামদুনির বাসিন্দারা বরাবর দাবি করে আসছেন, তাঁদের এই আন্দোলনের সঙ্গে রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই, কোনও রকম রাজনৈতিক রং গায়ে লাগুক, সেটা তাঁরা চান না। কিন্তু অধীরবাবুর উদ্যোগে দিল্লি সফর করায় তাঁদের গায়ে কি শেষ পর্যন্ত রাজনীতির রং-ই লেগে গেল না?
মৌসুমী কয়াল অবশ্য সে কথা মানতে চান না। তাঁর কথায়, “আমাদের অবস্থা অন্ধের মতো। যে-হাত ধরে রাস্তা পার করে দেবে, তার সঙ্গেই আমাদের যেতে হবে। সেই পথটুকু কেউ পার করিয়ে দিতেই পারেন। বাকি কাজটুকু তো আমরা, গ্রামবাসীরাই করছি।” মৌসুমীর আরও যুক্তি, “মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা তো খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকই করেছিলেন। তেমনই রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করিয়ে দিচ্ছেন অধীর চৌধুরী। দেখা করতে যাচ্ছে তো শুধু গ্রামবাসীরাই।”
প্রদীপবাবুর বক্তব্য, “হতে পারে, আমরা কারও সহায়তা নিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু এটা তো জনগণের আন্দোলন।” আর টুম্পা কয়াল বলেন, “দিদি যদি আমাদের দাবি মানতেন, তা হলে আমাদের দিল্লি যেতে হত না। রাজনৈতিক রং আমাদের এই আন্দোলনে আগেও ছিল না, এখনও নেই।”
আর এই প্রসঙ্গে অধীরবাবুর বক্তব্য, “রেল প্রতিমন্ত্রী, কংগ্রেস নেতা ছাড়াও আমার আরও পরিচয় আছে। আমি কারও বাবা, কারও ভাই, কারও স্বামী। আমার ক্ষমতা অনুযায়ী, এক জন সাধারণ মানুষ হিসেবেই কামদুনির বাসিন্দাদের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেছি। এর মধ্যে রাজনীতি খুঁজতে যাওয়া বৃথা। তা ছাড়া, কামদুনির ওই বাসিন্দাদের নেতৃত্ব দিয়ে তো আমি বা কংগ্রেসের কেউ নিয়ে যাচ্ছি না। রাষ্ট্রপতির কাছে তাঁদের হয়ে স্মারকলিপিও লিখে দিচ্ছি না।” শাসকদলের কেউ কেউ অবশ্য সে কথা মানতে নারাজ। বসিরহাটে ববি হাকিম বলেন, “কংগ্রেসের দু’-এক জন রয়েছেন যাঁরা কামদুনি নিয়ে লাফালাফি করছেন। এক জন তো নিজে ক’টা খুন করেছে তার হিসেব নেই। এখন দিল্লি যাচ্ছে কামদুনি কাণ্ডের বিচার চাইতে। আমাদের প্রশাসন তো অপরাধীদের গ্রেফতার করেছে। টিভিতে মুখ দেখিয়ে কুৎসা করলে শ্বশুরবাড়ির লোকেরা সন্তুষ্ট হলেও জনগণকে খুশি করা যায় না।” অবশ্য কামদুনির মানুষের বক্তব্য, তাঁরা কেবল সুবিচার পেতে অঙ্গীকারবদ্ধ। এ দিন দুপুরে প্রতিনিধিদলের রওনা হওয়ার সময়ে তাঁদের পিছু পিছু প্রায় গোটা গ্রাম বেরিয়ে আসে বিদায় জানাতে। ভুল বলা হল। বিদায় নয়, বাকি গ্রাম যেন নিরুচ্চারে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলল, ‘জয়যাত্রায় যাও গো।’ |
কামদুনির পথেই হাঁটল খোরজুনা। ধর্ষণের পরে গ্রামের এক মহিলাকে খুনের ঘটনায় দোষীদের শাস্তির দাবিতে রেল প্রতিমন্ত্রী সাংসদ অধীর চৌধুরীর সহায়তায় আজ, রবিবার দিল্লির পথে রওনা দেবে পাঁচ জনের এক প্রতিনিধি দল। ওই দলে রয়েছেন মৃতার স্বামী, তাঁর খুড়শ্বশুর, খুড়তুতো দাদা ও দুই প্রতিবেশী। সঙ্গে যাচ্ছেন ধর্ষণের পর খুন হয়ে যাওয়া এই জেলার রানিতলার এক ছাত্রীর পরিবারের লোকজনও। আজ বিকেলে শিয়ালদহ থেকে রাজধানী এক্সপ্রেসে দিল্লি যাবেন তাঁরা। সোমবার তাঁরা রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করে দাবিপত্র পেশ করবেন। |