মুখ্যমন্ত্রী বা রাজ্য প্রশাসন যতই তাঁদের সিপিএম বা মাওবাদী বলে দেগে দিক, প্রতিবাদের রাস্তা থেকে সরছেন না কামদুনির মেয়েরা। টুম্পা -মৌসুমীরা বরং জোরের সঙ্গে বলছেন, “আমার কোনও দল করি না। সে দিন যা বলেছি, ঠিকই বলেছি। দরকার হলে আবার বলব।” প্রতিবাদ করলেই কি মাওবাদী তকমা জুটবে, প্রশ্ন তাঁদের।
সোমবার আচমকাই কামদুনি সফরে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তখন তাঁর কাছে এগিয়ে গিয়ে কিছু কথা বলতে চেয়েছিলেন টুম্পা। মুখ্যমন্ত্রী তাঁর কথা শুনতে না -চাইলে কিছুটা বাদানুবাদেও জড়িয়ে পড়েন তিনি। তার পরেই মুখ্যমন্ত্রী প্রতিবাদী মেয়েদের ‘সিপিএম’ বলে অভিহিত করেন। রাজ্য প্রশাসন তাঁদের মধ্যে মাওবাদীরাও আছে বলে দাবি করে। এ দিন চাঁদপাড়ার জনসভাতেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সে প্রসঙ্গ তোলেন। পোশাক -পরিচ্ছদ দেখেই তিনি মাওবাদীদের মহিলা সংগঠন মাতঙ্গিনী -ঘনিষ্ঠ এবং সিপিএম কর্মী -সমর্থকদের চিনে নিতে পেরেছেন বলে মন্তব্য করেন। টুম্পা -মৌসুমীরা কিন্তু এই অবস্থাতেও ঘাবড়ে না -গিয়ে স্পষ্ট করে নিজেদের কথা নিজেরা বলেছেন।
বুধবার কামদুনি ফুটবল মাঠে গ্রামের মহিলাদের সঙ্গে নিয়ে টুম্পার প্রশ্ন, “প্রতিবাদ করলেই কি মাওবাদী হয়ে যেতে হবে? শুনলাম কলকাতার বুদ্ধিজীবীরা এই ধর্ষণের প্রতিবাদ করতে মাঠে নামছেন। তা হলে ওই বুদ্ধিজীবীরাও কি মাওবাদী?”
পোশাক দেখে মুখ্যমন্ত্রী কী ভাবে মাওবাদী চিনে নিলেন, তা ভেবে বিস্মিত টুম্পা। টুম্পার সঙ্গে কথা বলে বুধবার মমতারই দলের বিধায়ক সব্যসাচী দত্তর মন্তব্য, “কে কোন বাদী আমি জানি না। আমি কোনও মাওবাদী দেখতে পাইনি। টুম্পার শ্বশুরবাড়ি নিউটাউন আমার নির্বাচন কেন্দ্রে পড়ে। আমি ওদের চিনি।” আর মৌসুমী বলেন, “মাওবাদীরা খুন করে বলেই জানি। আমি মাওবাদী কিনা তদন্ত হোক। যদি আমি মাওবাদী প্রমাণ হই, তা হলে গ্রাম ছেড়ে চলে যাব।” |
কামদুনির ধর্ষিতা মেয়েটি টুম্পার সহপাঠিনী ছিলেন। টুম্পা বলেন, “বন্ধুর মৃত্যুর পর থেকে আমি খুব ভেঙে পড়েছি। আমাদের এই আন্দোলনে কোনও রাজনীতি নেই। তবু কী ভাবে মুখ্যমন্ত্রী গ্রামের মেয়েদের সিপিএম আর মাওবাদী বলে গেলেন?” বাপের বাড়ি এসে এমন বিতর্কে জড়িয়ে পড়ায় শ্বশুরবাড়িতে একটু চাপের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। মঙ্গলবার টুম্পার স্বামী এসে তাঁকে শ্বশুরবাড়ি নিয়ে গিয়েছিলেন। বুধবার টুম্পা আবার বাপের বাড়ি ফেরেন। এ দিন টুম্পার শাশুড়ি জয়া মণ্ডলও বললেন, “বৌমা যা বলেছে, ঠিকই বলেছে। এক জন মেয়ে হয়ে মেয়ের পাশে দাঁড়িয়েছে।”
বুধবার দুপুরে টুম্পা -মৌসুমীদের সঙ্গে জড়ো হন গ্রামের মহিলারা। সকলেই হয়তো সংবাদমাধ্যমে মুখ খোলেননি। কিন্তু প্রত্যেকে টুম্পাদের পাশে থেকেছেন, তাঁদের কথায় সমর্থন জুগিয়েছেন। টুম্পা -মৌসুমী দু’জনেই বলেন, গ্রামের মানুষ, পরিবারের লোকজন তাঁদের সঙ্গে আছেন। প্রয়োজনে আবারও মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী তাঁরা। বললেন, “দিদি আমাদের অসম্মান করেছেন বলে আমরা ওঁকে অসম্মান করতে যাব কেন?” টুম্পার মা মলিনা কয়াল বলেন, “মমতার কাছে যারা প্রতিবাদ করেছিল, তারা তো মমতার মেয়ের মতো। ওরা যদি কোনও দোষ করে থাকে তা হলে তিনি যেন নিজ গুণে ক্ষমা করে দেন।” গত কয়েক দিন ধরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে কামদুনির উপর দিয়ে। চলছে প্রবল মানসিক চাপ। গ্রামে ‘বহিরাগত’দের খোঁজে ঘাঁটি গেড়েছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। কথা বলতে বলতে এক সময় কেঁদে ফেলেন মৌসুমী। বলেন, “আমরা বহিরাগত নই। এখানকার বাসিন্দা। দিদি এ ভাবে আমাদের গায়ে মাওবাদী লেবেল বসিয়ে দেবেন, কল্পনাও করতে পারিনি।” এলাকার মহিলাদের নানা রকম হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ পেয়ে এ দিনই রাজ্য মানবাধিকার কমিশন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে স্বরাষ্ট্রসচিবকে তদন্ত করে রিপোর্ট দিতে বলেছে। কামদুনির মহিলাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে উত্তর ২৪ পরগনার পুলিশ সুপারকেও নির্দেশ দিয়েছে তারা।
|