দশ দিন তাঁরা ছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর প্রতীক্ষায়। সোমবার মুখ্যমন্ত্রী এলেন ঠিকই, কিন্তু যে ভাবে তাঁদের গায়ে ‘সিপিএম’ এবং ‘মাওবাদী’ তকমা দেগে দিয়ে গেলেন, তাতে ব্যথিত কামদুনির বাসিন্দারা।
মুখ্যমন্ত্রীর সফরের পরে চব্বিশ ঘণ্টা পেরিয়ে গিয়েছে। এই সময়ের মধ্যেই যেন এলাকায় বয়ে গিয়েছে নিঃশব্দ ঝড়। মহিলাদের চোখেমুখে বিভ্রান্তি আর হতাশা। তাঁদের কথায়, “দিদি যদি দাঁড়িয়ে দু’দণ্ড কথা বলতেন, সান্ত্বনা দিতেন, তা হলেই তো অনেক সাহস পেতাম। আমরা কোনও রাজনীতি করি না। উনি এমন কথা বলতে পারলেন!”
রাস্তার ধারের বাঁশের মাচায় বসেছিলেন গ্রামের যুবকরা। মাচার চার দিকে তৃণমূলের পতাকা লাগানো। সেই যুবকদেরও প্রশ্ন, “আমরা তো এই ঘটনায় কোনও রাজনৈতিক রং লাগাতে চাইনি। তবু উনি আমাদের গ্রামের মেয়ের ধর্ষণের প্রতিবাদকে সিপিএমের ষড়যন্ত্র তকমা কেন দিলেন? কেনই বা মাওবাদী বললেন?” এলাকার সমস্যার কথা বলতেই স্থানীয় মহিলারা মুখ্যমন্ত্রীর পিছনে পিছনে অনেকটা পথ দৌড়েছিলেন বলে দাবি এক যুবকের। আর গ্রামের প্রবীণদেরও বক্তব্য, “বাম আমলে এই ঘটনা ঘটলে হয়তো অভিযোগ জানানোর সাহসও পেতাম না। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলেছে। তাই চেয়েছিলাম, মুখ্যমন্ত্রী আমাদের সমস্যার কথা শুনুন। |
আমরা সিপিএম হতে যাব কেন?”
বস্তুত মঙ্গলবারেও তাদের প্রতিবাদের গায়ে রাজনীতির রং লাগতে দিতে চায়নি কামদুনি। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অধীর চৌধুরী এসে এলাকাবাসীদের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করাতে দিল্লি নিয়ে যাবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। সেই মতো এ দিন ওই কিশোরীর পরিবার ও এলাকাবাসীদের সঙ্গে কথা বলতে আসেন কংগ্রেস নেতারা। কিন্তু তাঁদের বলে দেওয়া হয়, “কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আমরা দিল্লি যাব না। রাষ্ট্রপতি বা কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা ডেকে পাঠালে দেখব।”
রাজনীতির রং নিয়ে গ্রামবাসীদের দাবি এ দিনও খারিজ করে দিয়েছে তৃণমূল। দলের সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় বলেন, “একটা পরিবারের পক্ষ থেকে বিক্ষোভ করা হয়েছে। তিন-চার জন মহিলা পরিকল্পনামাফিক এটা করার চেষ্টা করেছেন।” ওই মহিলাদের পরিবারের সকলে সিপিএম করেন বলেই তাঁর দাবি।
সোমবার মুখ্যমন্ত্রীর সামনে যাঁরা রোষ উগরে দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন মৌসুমী কয়াল, মিতা কয়াল, টুম্পা কয়াল। দলীয় সূত্রের খবরের ভিত্তিতে মুকুলবাবুর দাবি, মৌসুমীর স্বামী বিশ্বজিৎ কয়াল কয়ালপাড়ায় সিপিএমের দায়িত্বে রয়েছেন। মিতার স্বামী রঘুনাথ কয়াল সিপিএমের কামদুনি লোকাল কমিটির সদস্য। আর ক্রুদ্ধ মুখ্যমন্ত্রী যে মহিলাকে ‘চোপ’ বলে ধমক দিয়েছিলেন, সেই টুম্পার বাবা প্রভাত কয়াল ও মা মলিনা কয়াল সিপিএম কর্মী বলে দাবি মুকুলবাবুর। মমতাকে ঘিরে বিক্ষোভে মাওবাদীদের যোগসাজশের কথাও বলা হয়েছিল রাজ্য প্রশাসনের তরফে। মুকুলবাবুও এ দিন বলেন, “ওই এলাকায় দু’-এক জন মাওবাদী ঢুকেছে।” |
মুখ্যমন্ত্রী সোমবার বলেছিলেন, “কামদুনিতে ঢুকেই দেখি লাল পতাকায় চার দিক ঢেকে দেওয়া হয়েছে। তখনই বুঝেছিলাম, কোথাও একটা পরিকল্পনা ছকে রাখা হয়েছে।” এ দিন কিন্তু কামদুনি মোড় থেকে মৃত ওই কিশোরীর বাড়ি পর্যন্ত রাস্তায় কোথাও লাল পতাকার দেখা মেলেনি। বরং ২৯টি জায়গায় লাগানো রয়েছে তৃণমূলের তেরঙা পতাকা। গ্রামের এক কিশোর বলল, “এখানে লাল পতাকা থাকবে কী করে? পঞ্চায়েতে ১২টির মধ্যে ১১টি আসনেই তো তৃণমূল ছাড়া আর কেউ মনোনয়ন দিতে পারেনি।” এলাকায় তৃণমূলের একচ্ছত্র আধিপত্য এনে দিয়েছেন যাঁরা, সোমবার তৃণমূল নেত্রী ঘুরে যাওয়ার পর তাঁরাই রীতিমতো আতঙ্ক ও আশঙ্কায় ভুগছেন।
কেন? কয়ালপাড়ার বাসিন্দাদের অভিযোগ, সোমবার রাতেই কয়েক জন যুবক এলাকায় আসেন। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়া মহিলার বাড়ির সামনে এসে বাড়ির লোকেদের কিছুটা ধমক দিয়েই তাঁরা বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করলেন কেন? এটা মোটেই উচিত হয়নি।” এখানেই শেষ নয়। অভিযোগ, মঙ্গলবার সকালে ফের একটি গাড়িতে করে আসেন পাঁচ জন যুবক। কয়ালপাড়ায় গিয়ে নিজেদের মুখ্যমন্ত্রীর লোক বলে পরিচয় দিয়ে তাঁরা টুম্পাকে তাঁদের সঙ্গে যেতে বলেন। জামাইষষ্ঠীতে বাপের বাড়ি আসা টুম্পা রাজি হননি। এর পর ওই যুবকরা জানান, সোমবার মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ‘উদ্ধত’ ব্যবহারের জন্য টুম্পাদের মিডিয়ার সামনে ক্ষমা চাইতে হবে। এ কথা শুনে প্রতিবাদ করেন কয়ালপাড়ার বাসিন্দারা। তাঁরা বলেন, “কেউ-ই উদ্ধত ছিলেন না। কেউ ব্যক্তিগত সমস্যার কথাও মুখ্যমন্ত্রীকে বলতে যাননি। বলতে গিয়েছিলেন, গ্রামের রাস্তায় দ্রুত আলো জ্বালানোর ব্যবস্থা হোক। রাস্তাটা ভাল হোক। মেয়েরা যেন নির্ভয়ে বাড়ি ফিরতে পারে।” এর পরে ওই যুবকেরা ফিরে গেলেও অভিযোগ, সারা দিনই দফায় দফায় চক্কর দিয়েছে মোটরবাইকবাহিনী। যার জেরে তাঁরা আতঙ্কিত। পরিস্থিতি ভাল নয় বুঝে এ দিনই দুপুরে টুম্পার স্বামী এসে তাঁকে শ্বশুরবাড়ি নিয়ে গিয়েছেন।
এলাকাবাসীর এই অভিযোগ অবশ্য উড়িয়ে দিয়েছেন মুকুলবাবু। তিনি বলেন, “হুমকি দেওয়ার অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। এতে প্রমাণিত হচ্ছে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই এ সব করা হচ্ছে।” বারাসতের সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদারও হুমকির কথা অস্বীকার করে বলেন, “ঘটনাস্থলের কাছেই আমার বাড়ি। হুমকি দেওয়া হলে আমি জানতাম।”
আতঙ্কের পরিবেশ তৈরির অভিযোগ যখন উঠছে, তখন তার জেরে কি স্তব্ধ হয়ে যাবে ধর্ষণ-হত্যার প্রতিবাদ? কামদুনি অবশ্য সে কথা বলছে না। স্থানীয় এক মহিলার কথায়, “যা-ই হোক না কেন, দোষীদের ফাঁসি আর এলাকার নিরাপত্তার ব্যবস্থা না-হলে বিক্ষোভ চলবে।” সেই কথা সত্যি প্রমাণ করে মঙ্গলবার দুপুরে অঝোর বৃষ্টির মধ্যেই মিছিল করে কীর্তিপুর নবীনচন্দ্র হাইস্কুলের ছাত্রছাত্রীরা। মিছিল থেকে স্লোগান ওঠে, ‘মুখ্যমন্ত্রী কথা না-বলে চলে গেলেন কেন?’
কামদুনির ঘটনার জেরে মুখ্যমন্ত্রীকে এ দিনও এক হাত নিয়েছেন বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু। তিনি বলেন, “ধৃতদের কারও কারও সঙ্গে তৃণমূলের যোগ আছে। আর মুখ্যমন্ত্রী সিপিএম-কে দোষ দিয়ে এলেন। গ্রামবাসীরা কিছু বলতে চাইছিলেন। তিনি বলেছেন, আমার সব জানা আছে। উনি সবজান্তা! সবই যদি জানতেন, তা হলে কামদুনি গেলেন কেন?” তাঁর আরও কটাক্ষ, “মুখ্যমন্ত্রীর কথাই নীতি, ওঁর কথাই আইন, ওঁর কথাই রায়! উনি কিছু শুনতে চান না। শুধু শোনাতে চান!”
এ দিন মুর্শিদাবাদে অধীর চৌধুরীও বলেন, “এ রাজ্যে মা, বোনেরা ধর্ষিতা হচ্ছেন। আর তার বিচার চাইতে গেলেই মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের ধমক দিচ্ছেন। এই অহঙ্কার মানুষ সহ্য করবে না।”
আনসার আলি-সহ ধৃতদের এ দিন বারাসত আদালতে তোলা হয়। আনসারকে ফের চার দিনের জন্য সিআইডি হেফাজতে পাঠানো হয়। এজলাসে হাসিমুখেই ছিল আনসার।
|