শুধু বাড়ির মেয়েকে মর্মান্তিক ভাবে হারানোই নয়, অভিভাবকহীন হয়ে পড়লেন তাঁরা এমনই মনে হচ্ছে ডিরোজিও কলেজের ওই ছাত্রীর পরিজনেদের।
বাবা-জ্যাঠা, সকলের কাছেই ওই ছাত্রী ছিলেন অভিভাবক। তাঁর জ্যাঠার কথায়, “আমার ওই টুকু ভাইঝি হলে কী হয়, আমাকে উল্টে ও বিভিন্ন কাজে পরামর্শ দিত। বাড়ির সকলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পড়াশোনা তো ও-ই করেছিল। একেবারে অন্য রকম মেজাজ ছিল ওর। আমরা ওর কথা মেনে চলতাম।” চোখ মুছতে মুছতে ওই প্রবীণ আরও বলেন, “অল্প কথা বলত আমার ভাইঝি। ছোট থেকেই ছিল মৃদুভাষী। বাড়ির কেউ গলা চড়িয়ে কথা বললেও বিরক্ত হত। বলত, কখনও চিৎকার করে কথা বলতে নেই। এটা শিষ্টতা নয়।”
একই কথা বাবারও। “ও তো শুধু আমার মেয়ে ছিল না, আমাকে ও-ই শাসন করত। সেই মেয়ে পরীক্ষা দিতে বেরোলো। পরীক্ষা থাকলে এমনিতেই চিন্তা হয়। কিন্তু এমন দুর্ঘটনাও যে ঘটতে পারে, তা কে জানত? আমাদের চরম সর্বনাশ হয়ে গেল।”
ওই তরুণী যে স্কুল থেকে পাশ করেছেন, সেই একই কীর্তিপুর নবীনচন্দ্র স্কুলের দশম শ্রেণিতে পড়ে তাঁর ছোট ভাই। সেই ছোট ভাইয়ের কথায়, “দিদি শুধু আমার অভিভাববই ছিল না, ছিল আমার পথপ্রদর্শকও। আমার পড়াশোনা করা দিদিকে দেখেই।” নারকীয় অত্যাচারে দিদিকে হারিয়ে প্রবল মানসিক ধাক্কা খেয়েছে ছোট ভাই। কাঁদতে কাঁদতে বলছে, “ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই ওদের। ওরা যেন এলাকায় ফিরতে না পারে। তা হলে ওরা আমার দিদির মতো আরও কোনও মেয়ের সর্বনাশ করবে।” |
কামদুনি গ্রামের টালির চালা দেওয়া বাড়িতে শনিবার ভিড় করেছে শোকসন্তপ্ত মানুষ। শুধু বাড়ির লোকজনেদের কাছেই নয়, গ্রামের পড়ুয়াদের জন্যও ওই তরুণী ছিলেন পথপ্রদর্শক কিংবা অভিভাবক সম। গ্রাম ও আশপাশের যে সব ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করছে, কোনও টাকা না নিয়ে তাদের কয়েক জনকে পড়াতেন ওই তরুণী। যেমন দ্বাদশ শ্রেণির সীমা ঘোষ কিংবা কামদুনি গ্রামেরই বর্ণালী ঘোষের পাঁচ বছরের মেয়ে। গ্রামের মধ্যে কে এখন তাদের পড়াশোনা দেখিয়ে দেবে, সেটাও ওই নারকীয় কাণ্ডের পর প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।
পড়াশোনা মন দিয়ে করতেন, পড়াশোনার জন্য কষ্ট করতেন বলে কামদুনি গ্রামের অনেক অভিভাববকই ওই তরুণীর মতো হওয়ার জন্য নিজের সন্তানদের বলতেন। ওই তরুণীর মা কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। মাঝেমধ্যেই সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ছেন। কোনও রকমে বললেন, “লেকটাউনে পরীক্ষা দিতে যাবে বলে ভোর ৫টা নাগাদ বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল। শুক্রবার ছিল বাংলা পরীক্ষা। ঠাকুরের ছবিতে প্রণাম করে বেরিয়েছিল। তখন কি আর বুঝেছিলাম, ওটাই আমিার মেয়ের শেষ যাত্রা হবে!” বলতে বলতে ডুকরে কেঁদে ওঠেন মহিলা।
ওই তরুণীর বাবা রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করেন। রোজের মজুরি দেড়শো থেকে দু’শো টাকা। কখনও কখনও তিনি টিফিন বাবদ পেতেন রুটি, তরকারি ও একটি ডিম। কিন্তু ডিম সেদ্ধ নিজে না খেয়ে মেয়ের জন্য নিয়ে আসতেন তিনি। তাঁর কথায়, “মেয়ে আমার পড়াশোনার জন্য প্রচণ্ড খাটত। আমার তো ডিম কিনে দেওয়ার সামর্থ্য নেই। তাই টিফিনে নিজে না খেয়ে ওর জন্য নিয়ে আসতাম। বলতাম, মা একটু খা, তা হলে শরীরে বল পাবি, পড়াশোনাটাও ভাল ভাবে করতে পারবি। সব শেষ হয়ে গেল।”
বাবা নিজে পড়াশোনা করতে পারেননি বলে চাইতেন, ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে চাকরি করুক। সেই পথেই এগোচ্ছিলেন ওই তরুণী। শুক্রবার, জীবনের শেষ দিনেও পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ফেরা হল না। অভিভাবকহীন করে গেলেন নিজের বাড়ি-সহ গোটা গ্রামকে। |