শিবুর বোঝা নামাতে মরিয়া সকলেই
ভাটপাড়ার তৃণমূল বিধায়ক অর্জুন সিংহের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা এলাকায় সুবিদিত। সেই সূত্রে স্থানীয় সাংসদ দীনেশ ত্রিবেদীর সঙ্গেও তার যোগাযোগ ছিল, এমন কথাও এলাকায় ভাসছে। যদিও মুখ্যমন্ত্রী শুক্রবার দাবি করেছিলেন, সে অর্থাৎ শিবু যাদব দলের কেউ নয়। এখন শিবুর ‘বোঝা’ ঘাড় থেকে নামাতে তৃণমূলের অন্য নেতারাও মরিয়া।
অর্জুন সিংহ যেমন বলছেন, “এখানে বহু লোক আমার সঙ্গে হাঁটে। শিবুও ওই রকম। কিন্তু আমার দলের কেউ নয়।” তেমনই সাংসদ দীনেশ ত্রিবেদীও বলছেন, “আমি ওকে চিনি না। সামনে এলেও চিনতে পারব না। আমি এলাকায় কাজ করি পৌরপ্রধান ও বিধায়কদের মাধ্যমে। ক্রিমিনালদের বরদাস্ত করি না।” আরও বলছেন, “আমার
শিবু যাদব
কাজ যে স্তরে, সেখানে এ সব লোকের কোনও স্থান নেই।”
তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের গলাতেও শিবুকে ‘ঝেড়ে ফেলার’ সুর স্পষ্ট। তাঁর মতে, দীনেশ ও অর্জুনকে অহেতুক দোষারোপ করা হচ্ছে। অথচ শিবু যে দিন কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেন, সে দিন সাংসদ-বিধায়ক দু’জনেই মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। এ প্রসঙ্গে মুকুলবাবুর বক্তব্য, “স্থানীয় কোনও অনুষ্ঠান হলে অনেকে মঞ্চে উঠে পড়ে। আমি বলছি শিবু যাদব দলের কেউ নয়। ভবিষ্যতে যাতে এই ধরনের (সাংবাদিক নিগ্রহ) ঘটনা না ঘটে, তার জন্য দলের তরফে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
শুক্রবারের ঘটনার পর শিবুকে অবিলম্বে গ্রেফতারের জন্য পুলিশের এক শীর্ষ কর্তাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অথচ শনিবার সকাল থেকেই শিবুর আর কোনও খোঁজ পাচ্ছে না পুলিশ। সেই শিবু, প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অনুযায়ী চব্বিশ ঘণ্টা আগেও যে বসে ছিল ব্যারাকপুর থানার ওসি-র ঘরে!
আগের রাতে পাড়ায় ভাঙচুরের অভিযোগ জানাতে শুক্রবার সাতসকালে থানায় গিয়ে বড়বাবুর ঘরে শিবুকে দেখে আঁতকে উঠেছিলেন অনেকেই। মাঝারি গড়ন, গাঁটাগোট্টা পেটানো চেহারার শিবুকে দেখে ভয়ে কথা খুঁজে পাচ্ছিলেন না তাঁরা। স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকের সঙ্গে কথা বলেই সে-দিন রঙ্গমঞ্চে শিবুর এই উপস্থিতির কথা জানা গিয়েছে। ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনার সঞ্জয় সিংহের যদিও দাবি, বিষয়টি তাঁর জানা নেই। শিবুও দাবি করেছে গোলমালের সময়ে সে বাড়িতে ঘুমোচ্ছিল। কিন্তু পুলিশ অফিসারদের কারও কারও বক্তব্য, আগের রাতের খুন সংক্রান্ত অভিযোগ জানাতেই শিবু তখন থানায় ছিল। স্থানীয়দের দাবি, মণিরামপুরে ভাঙচুর বা রাস্তায় গোলমাল নিয়ে কেউ অভিযোগ জানানোর পরেও ওসি-র ঘরে বসেই ফোড়ন কাটছিল সে। অভিযোগকারীরা তার বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর অমুক নেতার লোক বলে দাবি করে আঙুল দিয়ে দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিল।
পুলিশের সঙ্গে শিবুর দহরম মহরমের অভিযোগ অবশ্য নতুন নয়। রাজনীতির ছত্রচ্ছায়ায় থাকার কারণে ৩২ বছরের ওই যুবককে পুলিশ অনেক দিনই রেয়াত করে চলত। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, ব্যারাকপুরের নয়াবস্তির এক সাধারণ দুধের ব্যবসায়ীর ছেলে শিবু ছেলেবেলা থেকেই ডাকাবুকো। খুব অল্প বয়সে পলতার জলপ্রকল্পের এলাকায় পাঁচিল টপকে ঢুকে লোহা চুরি করে তার অপরাধে হাতেখড়ি। পরের ব্যবসা জুয়া। সেই থেকে স্থানীয় দুষ্কৃতীদের মধ্যে প্রতিপত্তি বাড়তে থাকে তার। এই জুয়ার বোর্ড চালানো নিয়ে বারবার পুলিশের কাছে অভিযোগ গেলেও কাজ হয়নি। বরং পরে নেতাদের সঙ্গেও শিবুর মাখামাখি বাড়তে দেখেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। গোড়ায় ছিল সিপিএমের সঙ্গে আঁতাঁত। ২০০৯-এর লোকসভা ভোটে টাকা ও পেশিশক্তি দিয়ে সে কংগ্রেসের সহায় হয়। পরের বছর ব্যারাকপুরের কংগ্রেস নেতা তথা আত্মীয় রাজেন্দ্র যাদবের হাত ধরে একেবারে নোয়াপাড়া টাউন (২) যুব কংগ্রেসের সভাপতি পদে। তার বিরুদ্ধে তোলাবাজির অভিযোগও ওঠে। এলাকার লোকেরাই বলেছেন, ইদানীং তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ মণীশ শুক্লর সঙ্গে মাখামাখি বেড়েছিল শিবুর। দিন কুড়ি আগে প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে তৃণমূলে যোগ দেয় সে (যদিও নেতারা এখন তাকে স্বীকার করতেই নারাজ)।
স্থানীয়দের অনেকে বলছেন, ব্যারাকপুরের মতো শিল্পাঞ্চলে এমনিতেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় সমাজবিরোধীরা আশ্রয় নেয়। এ ক্ষেত্রে শিবুর সঙ্গে একেবারে শাসক দলেরই সংস্রবের অভিযোগ, এবং সেই সূত্রেই উঠে আসছে এক বিধায়ক ও সাংসদের নাম। শিবুর বিরোধী গোষ্ঠীতে আবার রয়েছেন তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতা ও রাজ্যসভা সাংসদের অনুগামীরা। এই গোষ্ঠীই শিবু ও তার দলবলের বিভিন্ন অসামাজিক কাজকর্মে বাধা দিত বলে শোনা যাচ্ছে। তবে অনেকের মতে তা মূলত ভাগাভাগির লড়াই।
মণিরামপুর, সদরবাজারে পুরনো তৃণমূল নেতা তথা আইনজীবী রবীন ভট্টাচার্যের সঙ্গে শিবুর সংঘাত কখনওই ফিকে হয়নি। মণিরামপুরের কাছে ফিশারি গেটের পাশে গঙ্গার ধারে একটি ইটভাটায় প্রায় ৩০০ কোটি টাকার আবাসন-প্রকল্পের থেকেও শিবু তোলা আদায় করছিল বলে অভিযোগ। একই সঙ্গে চলছিল বালি ও ইট-পাথরের সিন্ডিকেট ব্যবসার দখলদারি নিয়ে লড়াই। শিবুর প্রতিপক্ষ বলে পরিচিত রবীনবাবুরও দাবি, শিবুর বিরুদ্ধে খুনের মামলা-সহ প্রায় সাত-আটটি মামলা আছে। এর মধ্যে রবীনবাবু ও তাঁর ঘনিষ্ঠ লাল্টু ঘোষকে খুনের চেষ্টার অভিযোগও রয়েছে। গত ক’দিনে রবীন-লাল্টুদের সঙ্গে শিবু ও তাঁর দলবলের সংঘাত তুঙ্গে উঠেছিল।
ব্যারাকপুরের চিড়িয়ামোড়ের একটি নাইটক্লাবের বাউন্সার জিতু তাঁতি খুন হওয়ার পরে বৃহস্পতিবার রাতেও তাঁর দেহ তৃণমূলের পতাকায় মুড়ে মিছিলের পুরোভাগে ছিল শিবু। শুক্রবারও সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সে কথা বলে বুক ফুলিয়ে। কিন্তু শনিবার সকাল থেকেই তার ফোন বন্ধ। দেখা নেই। তবে পুলিশের গড়িমসি দেখে পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ কাণ্ডের ঠিক পরে-পরেই আরও একটি সাংবাদিক নিগ্রহের ঘটনার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে অনেকের। ঘটনাটি ঘটে গাঙ্গুলিবাগানে। তাতে অভিযুক্ত কলকাতার পুলিশের কর্মী তারক দাসকে ধরার সময়েও একই রকম টালবাহানা দেখা গিয়েছিল পুলিশের তরফে। এ বার শিবুও অধরা। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের ২৪ ঘণ্টা পরেও পুলিশের জবানিতে সে ‘পলাতক’।

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.