|
|
|
|
দু’ঘণ্টার গোষ্ঠীযুদ্ধ |
নির্বিচার তাণ্ডবে ভাঙচুর, মারধর |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
সাতসকালের ভরা বাজারে চড়াও গুন্ডাবাহিনী!
কারও হাতে পিস্তল, কারও হাতে পাইপগান, বল্লম কিংবা লোহার রড। কারও হাতে শাসকদলের ঝান্ডা। হাতের সামনে যা পাচ্ছে, ভেঙে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। লাঠির বাড়ির সঙ্গে নির্বিচারে চড়-থাপ্পড় খাচ্ছেন পথচলতি মানুষ, বাজারের সব্জি-মাছের পসরা ঠেলে ফেলা হচ্ছে নর্দমায়। আতঙ্কে পরের পর দোকান ঝাঁপ ফেলছে। তাণ্ডব ক্যামেরাবন্দি করতে গিয়ে দুই চিত্র-সাংবাদিক রক্তাক্ত। এমনকী, তাঁদের এক জনের গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরানোর চেষ্টা হয়। ঘটনাস্থলের ত্রিসীমানায় পুলিশ নেই!
যেন বলিউডের মার-কাটারি সিনেমার দৃশ্য! যেখানে অবাধে সন্ত্রাস-রাজ চালিয়ে যায় মাফিয়া সর্দারেরা, ত্রাসে কাঁটা হয়ে থাকে আমজনতা।
বিস্তারিত দেখতে
ক্লিক করুন |
|
বাস্তবে শুক্রবার সকালে এমনই দৃশ্যের সাক্ষী রইলেন ব্যারাকপুরের মণিরামপুরের বাসিন্দারা। যার সূত্র ধরে আঙুল উঠেছে সিন্ডিকেট-ব্যবসা ও এলাকার দখলদারি ঘিরে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের দিকে। শাসকদলের বিবদমান ‘শিবু-রবীন’ গোষ্ঠীর বিবাদের জেরেই এ দিন সকালের মণিরামপুর দীর্ঘ সময় কার্যত ‘মুক্তাঞ্চল’ হয়ে দাঁড়িয়েছিল বলে অভিযোগ শোনা গিয়েছে স্থানীয় বাসিন্দা ও রাজনীতির কারবারিদের বড়
অংশের মুখে।
দলীয় সূত্রের খবর: ‘শিবু’, অর্থাৎ শিবু যাদব হলেন ভাটপাড়ার তৃণমূল বিধায়ক অর্জুন সিংহের ঘনিষ্ঠ। অন্য দিকে ‘রবীন’, অর্থাৎ রবীন ভট্টাচার্য পানিহাটির দলীয় বিধায়ক নির্মল ঘোষের অনুগামী হিসেবে পরিচিত। পুলিশ ও স্থানীয়-সূত্র বলছে, মণিরামপুরে আবাসন-প্রকল্পে ইমারতি পণ্য সরবরাহ ও সরকারি সংস্থায় ঠিকাদারির বরাত আর গঙ্গার বালি তোলা নিয়ে দু’পক্ষে দীর্ঘ দিনের রেষারেষি। ওঁরা অভিযোগ মানতে না-চাইলেও স্থানীয় তৃণমূলের একাংশ এ দিনের হিংসার দায় মূলত শিবুবাবুর দলবলের উপরেই চাপিয়েছেন। প্রাথমিক তদন্তেও মোটামুটি এই তথ্য মিলেছে বলে পুলিশ-সূত্রের ইঙ্গিত। |
|
|
নয়া বস্তিতে ভাঙচুর |
|
দিনের শেষে অবশ্য শিবুর সঙ্গে সংশ্রবের কথা তৃণমূল নেতৃত্ব অস্বীকার করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, শিবু যাদবের সঙ্গে তাঁর দলের কোনও সম্পর্ক নেই। এ দিন মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “শিবু যাদব তৃণমূলের কেউ নয়। যারা হাঙ্গামা করেছে, তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে পুলিশকে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছি। শিবু যাদব-সহ প্রত্যেককে গ্রেফতার করতে হবে।” উত্তর ২৪ পরগনা জেলার দলীয় পর্যবেক্ষক জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের কথায়, “তৃণমূলের পতাকা তো কিনতে পাওয়া যায়! দেখতে হবে, তা নিয়ে সিপিএম বা কংগ্রেস এই কাণ্ড ঘটিয়েছে কি না। তবে বলতে পারি, তৃণমূল যুক্ত নয়।” তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের যুক্তি, “তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব কি না, তা এ ভাবে বলা যাবে না। পতাকা যে কেউ হাতে নিতে পারেন। কর্মী আর সমর্থকের মধ্যেও পার্থক্য রয়েছে। বিপদে পড়লে এখন অনেকেই তৃণমূল হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন। পুলিশ তদন্ত করুক।”
তবে পুরো বিষয়টিতে যে দুই গোষ্ঠীর নাম উঠে এসেছে, তাদের নেতারা হাঙ্গামায় নিজেদের সংশ্রব অস্বীকার করলেও কার্যত পরস্পরকে দুষেছেন। পুলিশ জানিয়েছে, অশান্তির সূত্রপাত বৃহস্পতিবার রাতে, এক যুবকের খুন হওয়াকে কেন্দ্র করে। সেই খুনটিও শিবু-রবীন বিরোধেরই পরিণাম বলে তদন্তকারীদের অনুমান। উপরন্তু নিহত যুবকের দেহ নিয়ে এ দিন সন্ধ্যায় শ’খানেক মোটরবাইকের যে মিছিল বেরোয়, তা তৃণমূলের দলীয় পতাকায় সুসজ্জিত ছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। সব মিলিয়ে ঘটনা পরম্পরায় তৃণমূলের উপস্থিতি একেবারে উড়িয়ে দিতে পারছেন না এলাকাবাসী ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মী-সমর্থকদের অনেকে।
তাণ্ডবের প্রেক্ষাপট কী?
পুলিশ-সূত্রের খবর: বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে দশটা নাগাদ মণিরামপুর স্টেট ব্যাঙ্কের পিছনে মুরগিমহলে জিতুলাল তাঁতি (২৮) নামে এক যুবককে বোমা মেরে-গুলি করে খুন
করা হয়। স্থানীয় গোলামহল এলাকার বাসিন্দা ওই যুবক ছিলেন শিবুবাবুর ঘনিষ্ঠ। বাসিন্দারা জানিয়েছেন, জিতু-হত্যার প্রতিবাদে রাতেই তৃণমূলের কিছু সশস্ত্র যুবক এলাকা দাপিয়ে বেড়ায়। দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর হয়। পুলিশ এসে পড়ায় তখনকার মতো তারা রণে ভঙ্গ দেয়। |
|
|
প্রহৃত দুই সাংবাদিক আস্তিক চট্টোপাধ্যায় ও বরুণ সেনগুপ্ত |
|
কিন্তু রাত পোহাতেই ফের চড়াও হয়। এ বার নতুন উদ্যমে, নতুন শক্তিতে। কী রকম?
স্থানীয় সূত্রের খবর, ভোর সাড়ে ছ’টা নাগাদ তৃণমূলের পতাকা নিয়ে শ’তিনেক সশস্ত্র দুষ্কৃতী রাস্তায় নেমে পড়ে। সদর বাজার থেকে ভাঙচুর চালাতে চালাতে তারা মণিরামপুর বাজারের দিকে এগোতে থাকে। দোকানপাট-গাড়ি-মোটরসাইকেল তো বটেই, ভাঙচুর করে রাস্তার পাশের বাড়ি-ঘরও। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, সদর বাজার থেকে মণিরামপুরের সব ক’টা মোড়ে দাঁড়িয়ে গুন্ডার দল সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে পিটিয়েছে, মহিলাদেরও ছাড় দেয়নি। তাণ্ডবে দিশেহারা হয়ে পথচলতি লোকজন ছোটাছুটি শুরু করে দেন। দোকান-বাজার বন্ধ হয়ে যায়, কিছু ক্ষণের মধ্যে রাস্তাঘাট প্রায় শুনশান। বাস ও অটো চলাচল শিকেয় ওঠে। এ দিন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা ছিল, ফলে যানবাহনের অভাবে পরীক্ষার্থীরা পড়েন চরম দুর্ভোগে।
প্রশাসন কী করছিল? বাসিন্দাদের অভিযোগ, সকাল সাড়ে ছ’টা থেকে সাড়ে আটটা পাক্কা দু’ঘণ্টা এ ভাবে সন্ত্রাস-অরাজকতা চললেও পুলিশের দেখা মেলেনি। সাড়ে আটটার পরে পুলিশ এসে দুষ্কৃতীদের তাড়া করে ছত্রভঙ্গ করে। “ততক্ষণে গুন্ডারা গোটা তল্লাট তছনছ করে দিয়েছে। ব্যারাকপুরে এত দিন বাস করছি, এমন কাণ্ড আগে দেখিনি। এ যে সমাজবিরোধীদের মুক্তাঞ্চল! যাকে খুশি মারছে, যা খুশি ভাঙছে! কেউ বলার নেই!” আক্ষেপ করছেন ভুক্তভোগী এক বৃদ্ধ।
এ দিকে খবর পেয়ে ছবি তুলতে ঘটনাস্থলে এসে দুষ্কৃতীদের রোষের মুখে পড়েন দু’টি টিভি চ্যানেলের দুই চিত্র সাংবাদিক। আস্তিক চট্টোপাধ্যায় ও বরুণ সেনগুপ্ত নামের ওই দু’জনকে পেটানোর পরে বরুণবাবুর গায়ে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে মারার চেষ্টাও হয় বলে অভিযোগ। পুলিশ দু’জনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনার সঞ্জয় সিংহ বলেন, “হাঙ্গামার ঘটনায় তিন জন এবং সাংবাদিক নিগ্রহে আরও তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তদন্ত চলছে। আরও ক’জনকে গ্রেফতার করা হবে।”
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে এ-ও জানা যাচ্ছে যে, তৃণমূলের সমর্থকদের একাংশের দাপাদাপিতে গত তিন দিন ধরেই মণিরামপুর উত্তপ্ত ছিল। মঙ্গলবার ব্যারাকপুর মহাদেবানন্দ কলেজে ব্যাপক ভাঙচুর চলে। বুধবার একটি দোকানে বোমাবাজি হয়। তার পরেই বৃহস্পতিবার রাতের জিতু-হত্যা, যা অশান্তির বারুদে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। ওই খুনের পিছনেও শিবু-রবীন দ্বন্দ্বেরই ছায়া দেখছেন পুলিশ ও রাজনীতিতে জড়িতদের একাংশ। |
|
|
বাকারমহল এলাকায় ভাঙচুর |
|
কেন? তৃণমূলের এক সূত্রের দাবি, শিবু যাদব আগে কংগ্রেস করতেন, স্থানীয় সিপিএম নেতাদের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল। সম্প্রতি বিধায়ক অর্জুনবাবু ও বিধানসভায় তৃণমূলের মুখ্য সচেতক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে তিনি তৃণমূলে যোগ দেন। অন্য দিকে পেশায় আইনজীবী রবীনবাবু তৃণমূলের পুরনো লোক। দলীয় সূত্রের ইঙ্গিত, বহিরাগত শিবু যাদব ক্রমশ প্রতিপত্তিশালী হয়ে ওঠায় দু’তরফে দ্বন্দ্ব দানা বাঁধে, যা আরও পেকে ওঠে সিন্ডিকেট-ঠিকাদারির বরাত দখলের টক্কর ঘিরে। বস্তুত শিবুর দাপটে রাশ টানতে তাঁর ঘনিষ্ঠ জিতুকে খুন করা হয়েছে এমন সম্ভাবনা খারিজ করছেন না পুলিশ-কর্তাদের অনেকেও।
দলীয় সূত্রের খবর, জিতু খুনের পরে শিবু গোষ্ঠীর রাগ গিয়ে পড়ে রবীনবাবুদের উপরে। ঘটনার রাতে এলাকায় তাণ্ডবের পাশাপাশি রবীনবাবু ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সঙ্গী লাল্টুর বাড়িতেও ভাঙচুর চালিয়েছিল শিবুর দলবল। বিধায়ক অর্জুনবাবুও এ দিন প্রথমে জিতু-হত্যার দায় পরোক্ষে রবীন-গোষ্ঠীর উপরে চাপিয়ে বলেছিলেন, “মণিরামপুরের খুনের পিছনে এক আইনজীবীর ছায়াসঙ্গী লাল্টুর হাত রয়েছে। পুলিশকে তা-ই জানানো হয়েছে।” একই সঙ্গে এ দিনের হাঙ্গামায় শিবু যুক্ত নয় বলেও দাবি করেছিলেন তিনি।
কিন্তু মহাকরণের খবর, সন্ধ্যায় শিবু যাদব সম্পর্কে অভিযোগ কানে আসার পরে মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং অর্জুনবাবু ও শোভনদেববাবুর সঙ্গে কথা বলেন। তার পরে ওঁরাও শিবুর কোনও দায় নিতে চাননি। মহাকরণ-সূত্রে জানা গিয়েছে, মুখ্যমন্ত্রীর কঠোর মনোভাব আঁচ করে অর্জুনবাবু তাঁকে বলেছেন, “শিবু যাদব দলের কেউ নয়, তবে সে দলে ভিড়তে চেয়েছিল। আমরা নিইনি।” শোভনদেববাবুও শীর্ষ নেতৃত্বকে জানিয়ে দেন, তিনি শিবু যাদবকে চেনেন না। আইজি (আইন-শৃঙ্খলা) অনুজ শর্মাকে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, অবিলম্বে শিবু যাদব ও তাঁর সঙ্গীদের গ্রেফতার করতে হবে। গ্রেফতারি এড়াতে কোনও উমেদারিতে কান না-দিতেও পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন মমতা।
রবীনবাবু কী বলছেন?
শিবু যাদবের সঙ্গে তাঁর যে গোলমাল ছিল, তা কার্যত মেনে নিয়ে তাঁর মন্তব্য, “ও তো সমাজবিরোধী! আমি নিজেই ওর বিরুদ্ধে দু’টো মামলা করেছি। যাঁরা বলছেন শিবু তৃণমূল নেতা, তাঁদের জানা উচিত, ইচ্ছে হলেই তৃণমূলের সদস্য হওয়া যায় না। যাঁরা তাণ্ডব চালিয়েছে, তাঁরা কেউ তৃণমূলের লোক নয়।” আর শিবুর বক্তব্য, “রাতের গণ্ডগোলের সময়ে আমি ব্যারাকপুরের বাইরে ছিলাম। আর সকালে তো ঘুমোচ্ছিলাম! শুনেছি, ভাঙচুর হয়েছে।”
|
ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায় |
|
|
|
|
|