|
|
|
|
|
|
|
নাটক সমালোচনা... |
|
ক্ষমতার ভাষা বদলায় না |
‘স্বপ্নসন্ধানী’র প্রযোজনা ‘থানা থেকে আসছি’ সে কথাই নতুন করে বলল। লিখছেন তাপস সিংহ |
কফি শপ চেনের সেই ছেলেটি হঠাৎ যেন অন্তরালে চলে গেল! ক’দিন পরে জানা গেল, তার চাকরি গিয়েছে। সে বসত ওই কফি-বিপণির ক্যাশে। কেন তার এই শাস্তি? চেনামুখ দেখে বিল বানানোর আগেই কফির পেয়ালা পাঠিয়ে দিয়েছিল সে। লহমায় ভুলে গিয়েছিল, সিস্টেমে ‘এন্ট্রি’ করার আগে এটা বেআইনি। অতএব, সামান্য কিছু ক্ষণের মধ্যেই ওই ছেলেটি এ সমাজে প্রান্তিক হয়ে গেল!
কফি শপের ছেলেটি যাঁর মুখ দেখে আনন্দে নিয়ম ভেঙে কফির পেয়ালা পাঠায়, এই ঘটনায় বেশ কয়েক দিন ঘুমোতে পারেননি সেই কৌশিক সেন! বহু সন্ধানে ছেলেটির নম্বর জোগাড় করে তাকে ফোন করেন কৌশিক। জানতে পারেন, সে ব্যবসা করছে। আর্থিক সাহায্যের প্রস্তাব সবিনয়ে ফিরিয়ে দেয় সেই ছেলে।
আর এরই মধ্যে শহরে আসেন নরেন্দ্র মোদী। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী এখন উন্নয়নের মুখ। কিন্তু, কেমন সে উন্নয়ন? এটাই কি আদর্শ মডেল? প্রান্তিক সেই ছেলে আর প্রতাপশালী এক রাজনীতিককে অন্য ভাবে মঞ্চে আনার ভাবনায় কৌশিক আশ্রয় নেন অজিত গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত নাটক ‘থানা থেকে আসছি’-র। প্রকাশ্যে না থেকেও এই নাটকের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র সন্ধ্যা চক্রবর্তীর সঙ্গে কোথায় যেন মিল হয়ে যায় কফি শপের চাকরি যাওয়া সেই ছেলের!
ব্রিটেনের নাটককার জে বি প্রিস্টলে-র নাটক ‘অ্যান ইনস্পেক্টর কল’ অবলম্বনে ’৬৮ সালে লেখা অজিত গঙ্গোপাধ্যায়ের ওই নাটক কমার্শিয়াল থিয়েটারে প্রথম মঞ্চস্থ করেছিলেন কৌশিকের বাবা শ্যামল সেন। সে নাটক হত একেবারে হুবহু মূল নাটক মেনে। ‘স্বপ্নসন্ধানী’ অবশ্য সে পথ থেকে সরে এসেছে।
দুই ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে ও মেয়ের ‘এনগেজমেন্ট’ উপলক্ষে পার্টিতে ছেলের বাবা শেখর মাইতি বলছেন: ‘আগামিকাল শহরে নরেন্দ্র মোদী আসছে, আমি কিন্তু খুব উত্তেজিত হয়ে আছি।’ মেয়ের বাবা চন্দ্রধর সেন: ‘সার্টেনলি এই লোকটির দিকে আমাদের নজর রাখতেই হবে হোয়াট আ ক্যারিশম্যাটিক পার্সোনালিটি দ্য ক্রিয়েটর অফ ভাইব্র্যান্ট গুজরাত কিন্তু একটাই সমস্যা।’ শেখর: ‘দাঙ্গার কথা বলছ তো? ভুলে যাচ্ছ চাঁদু, মানুষ দ্রুত ভুলে যাচ্ছে সবরমতীর ঠান্ডা জলে সব ধুয়ে যাচ্ছে আমদাবাদ, ভদোদরা, সুরাত, রাজকোট, ভাবনগর এই সব জায়গার মধ্যবিত্তরা ঢেলে ভোট দিয়েছে, ৪৪টা সিটের মধ্যে ৪০টাই মোদীর। একটাই মন্ত্র উন্নয়ন তা সে যে ভাবেই হোক, দাঙ্গা-ফাঙ্গা কে মনে রাখে?’ |
|
চন্দ্রধর সেন সমাজের অত্যন্ত প্রভাবশালী ও ধনী। কতটা? তাঁর স্ত্রী রমা হবু জামাই শারনকে বলেন, ‘তোমার শ্বশুরমশাই মোস্ট প্রবাবলি রাজ্যসভায় যাচ্ছেন খুব ইনফ্লুয়েন্সিয়াল একটা ব্লক থেকে ওঁকে নমিনেট করা হয়েছে।’
আনন্দের ফোয়ারা বয়। বিদেশি ওয়াইন নেশা ছড়ায়। রাত বাড়ে। জমে ওঠে ক্ষমতা আর ঐশ্বর্যের প্রদর্শনী। আর ঠিক সেই সময়েই আসরে প্রবেশ পদ্মপুকুর থানার সাব ইনস্পেক্টর তিনকড়ি হালদারের।
কিন্তু, সেই পুরনো নাটক আজও এ ভাবে প্রাসঙ্গিক! ইনস্পেক্টর তিনকড়ি হালদারের প্রবেশ নিছকই সাদামাটা। সমাজের উঁচুতলার চন্দ্রধর সেনের বাড়িতে এক সাধারণ মেয়ের আত্মহত্যার তদন্তে এসেছেন এক ‘সামান্য’ ইনস্পেক্টর (যাঁকে কথায় কথায় নিজের ভাগ্নে ডিসি (সাউথ) রমেশের কথা শোনাতে ভোলেন না চন্দ্রধর ও তাঁর স্ত্রী মনোরমা)! নিছকই কুণ্ঠা ভরে রঙ্গমঞ্চে যে চরিত্রের প্রবেশ, সেই চরিত্রই ধীরে ধীরে অন্য সব চরিত্রের মাথা ছাপিয়ে গেল! ‘স্বপ্নসন্ধানী’র এই নাটকে তিনকড়ির ভূমিকায় অভিনয় করেছেন কাঞ্চন মল্লিক! নির্দেশক কৌশিক সেন নিজে সেই ওজনদার চরিত্রে অভিনয় না করে কাঞ্চনকে নামালেন কেন? বিশেষ করে, নাটকে তিনকড়ির চরিত্রে ছিলেন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রথম চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন উত্তম কুমার, রিমেকে সব্যসাচী চক্রবর্তী, সেখানে কাঞ্চনের মতো কৌতুকাভিনেতা কেন? কৌশিক বলছেন, ‘ওই জন্যই। প্রথমে সকলে ভাববেন, কাঞ্চন বুঝি এখানেও দর্শককে হাসাবে! কিন্তু সে ভুল ভেঙে যায়, কমেডির মোড়কে তিনকড়ির ছায়া গ্রাস করে মঞ্চকে।’
অসামান্য অভিনয়ে চমক দিয়েছেন কাঞ্চন। ছোট-বড় পর্দায় তাঁর চিরাচরিত অভিনয়ের বাইরে বেরিয়ে এসে কাঞ্চন নিঃসন্দেহে তিনকড়ি হালদারকে এক ভিন্ন মাত্রা দিয়েছেন।
কৌশিক বরাবরের সুঅভিনেতা। চন্দ্রধর চরিত্র তাঁর অভিনয়ে জীবন্ত। কিন্তু তাঁর স্ত্রী মনোরমার চরিত্রে চমক দিয়েছেন রেশমী সেন। নিয়মিত বিউটি পার্লারে গিয়ে বয়স ধরে রাখা ব্যবসায়ীর স্ত্রী, নিজেও একাধিক কর্মকাণ্ডে জড়িত। আভিজাত্য আর ক্ষমতার অদ্ভুত মিশেল তাঁর কথায়-চলাফেরায় ফুটে বেরোয়। প্রান্তিক মেয়েদের নিয়ে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা চালিয়েও যিনি আর এক প্রান্তিক, অসহায় মেয়ের সামনে দরজা বন্ধ করে দেন! তাঁর পাশাপাশি চমৎকার উপস্থিতি রবীন্দ্রনাথ জানারও।
মঞ্চ ভাবনায় সঞ্চয়ন ঘোষ এবং আলোয় জয় সেন অসাধারণ। গোটা নাটকে সঙ্গীতকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছেন গৌতম ঘোষ। ‘স্বপ্নসন্ধানী’র একের পর এক প্রযোজনায় এসেছে রাজনীতি আর ক্ষমতার ভাষা। ২০১০-এ ‘বীরপুরুষ’, ২০১১-য় ‘নটীর পূজা’, ওই বছরেই ‘সেই সুমৌলি’, ২০১২-য় ‘ম্যাকবেথ’ এবং এ বারে ‘থানা থেকে আসছি’। শাসক বদলেও ক্ষমতার ভাষা না-বদলানোর এক পরিক্রমা। ‘থানা থেকে আসছি’-তে উঠে আসে অমোঘ আর এক প্রশ্ন। চন্দ্রধরের জামাই শারন বলছে, ‘আমরা তো আর ক্রিমিনাল নই, রেসপেক্টেবল সিটিজেনস্।’’
তিনকড়ি হালদার: ‘দেখুন এই ক্রিমিনাল আর রেসপেক্টেবল সিটিজেনস এ দুটোর মধ্যে তফাতটা কি খুব পরিষ্কার? আমার তা মনে হয় না। কতটা অবধি রেসপেক্টেবল, আর কোনখান থেকে ক্রিমিনাল, এ যদি আমাকে কেউ বলতে বলে, আমি তো বলতে পারব না।’
কে-ই বা পারে! |
|
|
|
|
|