গ্রামের ভেড়ির ধারে বৃষ্টিতে ভিজেছিলেন অমিতাভ বচ্চন। পুকুরে স্নান করেছিলেন পদ্মা খন্না। ভিজে কাপড়ে ছাগলছানা কোলে নিয়ে পুকুরের ধারে ঘুরতে ঘুরতে গানও গেয়েছিলেন। বটগাছের তলায় একটা ছোট্ট মাটির বাড়িতে বিয়ে করে সংসার পেতেছিলেন অমিতাভ।
আমাদের এই গ্রামের নামটি কামদুনি। ভেড়ি ঘেরা এই গাঁয়ের কথা জানে পাঁচজনে।
ধর্ষণ নিয়ে সদ্য উত্তাল হয়ে ওঠা এই কামদুনিতে এক সময় শ্যুটিং করে গিয়েছেন অমিতাভ বচ্চন। এই সেই গ্রাম যেখানে ভেড়ির দু’দিকে খেজুর আর হাজারটা ফুলগাছের ফাঁকে ঘুরে বেড়াত অনেকগুলো ময়ূর। মেঘ দেখলে তারা পেখম তুলে নাচত। সেই নাচ দেখে মুগ্ধ হতেন অমিতাভ। পুকুরে বড় বড় পদ্মফুল ফুটে থাকতে দেখে অবাক পদ্মা খন্না। বর্ষাকালে কামদুনির রূপ যেন পদ্মপাতায় জলের মতো টলমল করে।
সে ছিল সত্তরের দশক। কথা নেই, বার্তা নেই তখন মাঝেমধ্যেই শ্যুটিং পার্টি ভিড় করত কামদুনিতে। অমিতাভ তো বটেই, উত্তমকুমারের বেশ কয়েকটি ছবির শ্যুটিং হয়েছে এই কামদুনিতেই ‘গৃহদাহ’, ‘রাইকমল’, ‘সেই চোখ’....। শ্যুটিংয়ের জন্যই প্রায় প্রতি বছরই এখানে আসতেন তিনি। |
“আমি তখন হাফপ্যান্ট পরি। হঠাৎ শুনি বড়দের কে যেন বললেন, যা দেখে আয় তোদের নতুন মাস্টার এসেছে, গিয়ে দেখি একটা নতুন তৈরি খড়ের ঘরে বসে অ-আ শেখাচ্ছেন উত্তমকুমার।” ‘গৃহদাহ’র শ্যুটিংয়ের দৃশ্য। বলছিলেন এক স্থানীয় বাসিন্দা।
শ্যুটিং করতে গিয়ে কোনও সময়ে মহানায়ক নৌকা নিয়ে ভেসে বেড়িয়েছেন কামদুনির খাঁড়িতে। সঙ্গে সুচিত্রা সেন। বিলের জলে ছিপ ফেলে মাছ ধরেছেন। নারকেল গাছের আড়াল থেকে জলে ঢিল ছুড়ে সেই মাছ ধরা পণ্ড করে দিয়েছেন নায়িকা সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। তারপর জলের ধারে নায়ক-নায়িকার খুনসুটি। হাঁ করে তা’ও দেখেছে জড়ো হওয়া মানুষজন।
আর অমিতাভ বচ্চন? চল্লিশ বছর আগের স্মৃতিচারণ করছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা মদন মোহন মণ্ডল, “আমি তখন পনেরো, কী ষোলো। ভেড়ির বাগান পরিষ্কারের কাজ করি। শুনলাম বম্বে থেকে শ্যুটিং পার্টি এসেছে। সিনেমার নাম সওদাগর। তার নায়ক প্রায় সাত ফুট লম্বা। নাম অমিতাভ বচ্চন।” সামনাসামনি দেখে মুখটা চেনা-চেনা লাগলেও প্রথম-প্রথম অমিতাভের নামটা কিছুতেই মনে করতে পারেননি ওঁরা।
মদন বলেন, “ভেড়িতে আমার একটা বিশ্রামের ঘর ছিল। মাটি আর বেড়ার সেই ঘরটাকেই সাজিয়ে গুছিয়ে ওঁর জন্য তৈরি হল। সিনেমায় পদ্মা খন্নাকে বিয়ের পর অমিতাভ এই বাড়িতেই উঠেছিলেন।”
মদনবাবু বলে চলেন, “শুধু শ্যুটিং দেখাই নয়, সিনেমায় আমি ছিলাম পদ্মা খন্নার ভাই। বিয়ের শ্যুটিংয়ের সময় আমার রোল ছিল দিদি আর জামাইবাবুকে টা-টা করা। অমিতাভ বচ্চনের কাছে এক হাজার টাকা আর পদ্মা খন্নার কাছে পাঁচশো টাকা পেয়েছিলাম। তখন ওই টাকাই অনেক। সারা মাস খেটে এত টাকা হাতে পাওয়ার কথা ভাবতেও পারতাম না।” |
চল্লিশ বছর আগের সেই কামদুনির চেহারা অবশ্য পালটে গিয়েছে অনেকটাই। খেজুর গাছ আর ততটা নেই। ভেড়িতে, বাগানে অত পাখি আর বসে না। শুধু বারোশো বিঘা জমির ওপর যে বাগান আর ভেড়ি ছিল, সেটা রয়ে গিয়েছে অনেকটাই একই রকম। “শ্যুটিংয়ের দিনগুলোতে অমিতাভ থাকতেন খুব চুপচাপ। গম্ভীর। তবে ওঁর কাছে গেলে লজেন্স পাওয়া যেত।” বলছিলেন আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা স্থানীয় বাসিন্দারা।
পদ্মা খন্নাকে ওঁরা দিদি ডাকতেন। দিদি কিন্তু ওঁদের সঙ্গে গল্প করতেন। হাসিঠাট্টাও। সিনেমায় কড়াইতে গুড় জ্বাল দেওয়ার যে দৃশ্যটা দেখা যায় সেই গুড় জ্বাল দিতেন গ্রামেরই গোষ্ঠ বিহারী মণ্ডল। গোষ্ঠবাবু অবশ্য এখন আর নেই। মারা গিয়েছেন। সিনেমায় এই গ্রামেরই একটা সেতু পেরিয়ে গুড় বিক্রি করতে যেতেন অমিতাভ। কী ভাবে গাছে উঠে রস নিতে হয়, হাঁড়ি মাথায় রাস্তা ভাঙতে হয়, এসব শ্যুটিংয়ের দরকারে অমিতাভ মন দিয়ে শিখে নিয়েছিলেন এখানকার লোকজনের কাছেই।
এখন আর কোনও শ্যুটিং পার্টিই আসে না। বিশাল বিস্তীর্ণ ভেড়ি, রাস্তাঘাট, গাছপালা বৃষ্টিতে একলাই ভিজতে থাকে বর্ষাতে। ভরা বৃষ্টিতে আজও কামদুনি অপরূপা। তবু কেউ কেন যে আসে না আজ ছবির জন্য! ‘বড় ভেড়ি’ আজও তার সময়কে ভোলে না। অপেক্ষায় থাকে। আবার তাকে ফিরে পেতে।
|