|
|
|
|
স্মরণ |
রাজকাহিনি
ভালবাসতেন গালিব। গানের মুখড়া শুনে বলে দিতেন দর্শক নেবে কি না।
নকল করার ঘোর বিরোধী ছিলেন। ১৮ জুলাই তাঁর প্রয়াণের প্রথম বছর পূর্ণ হবে।
তার আগে অচেনা রাজেশ খন্নার কথায় সুরকার প্যারেলাল। শুনলেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত |
|
|
প্যারেলাল রামপ্রসাদ শর্মা। বয়স ৭৩। ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে তিনি কিংবদন্তি।
লক্ষ্মীকান্ত শান্তারাম কুদলকরের সঙ্গে জুটি বেঁধে ৬৩৫টি ছবিতে সুর দিয়েছেন। রাজেশ খন্না থেকে অমিতাভ বচ্চন হিন্দি ছবির সব সুপারস্টারের বহু হিট গানে খেলা করেছে তাঁদের সুরের জাদু ।
লক্ষ্মীকান্ত চলে গিয়েছেন ১৯৮৮তে। প্যারেলাল আজও সঙ্গীত চর্চার মধ্যেই আছেন। আপাতত তুমুল ব্যস্ত চিন থেকে একদল মিউজিশিয়ানের সঙ্গে কাজের তোড়জোড়ে। তাঁর মধ্যেই রাজেশ খন্নার স্মৃতি রোমন্থনের অনুরোধ। ফেরালেন না তিনি। ফোনেই কথা বললেন ‘পত্রিকা’র সঙ্গে।
প্রথম দেখা এক হোটেলে
তখন রাজেশ খন্না সুপারস্টার। রাজ খোসলার ‘দো রাস্তে’ ছবিতে লক্ষ্মীকান্ত-প্যারেলালের কাজ করার কথা। “ওঁকে প্রথম দেখি ‘সান অ্যান্ড স্যান্ড’ হোটেলে। বেশ শান্ত স্বভাবের মানুষ ছিলেন কাকা (রাজেশ খন্না)। লক্ষ্মীজির সঙ্গেই বেশি কথা হত ওঁর। রাজ খোসলা চেয়েছিলেন, ‘দো রাস্তে’র জন্য আমরা যেন নতুন ধাঁচে সুর করি। তখন কাকার সব গানই কিশোরকুমার গাইতেন। খানিকটা আমতা আমতা করেই কাকাকে বললাম: কিশোরকুমারের মতো আর দ্বিতীয় গায়ক হয় না। তবে আমরা একটা গান তৈরি করেছি ‘ছুপ গ্যয়ে সারে নজারে’, এটা যদি মহম্মদ রফিকে দিয়ে গাওয়াই ....’। শুনে কিন্তু উনি কোনও আপত্তি করলেন না,” বলছিলেন সুরকার। গানটা রেকর্ড করা হয় মহম্মদ রফি আর লতা মঙ্গেশকরকে দিয়ে। ইউ টিউবে রাজেশ খন্না আর মুমতাজের এই গানটির ‘হিট’য়ের সংখ্যা ৮ লাখের বেশি। ‘দো রাস্তে’র অন্যান্য হিটের মধ্যে ছিল ‘ইয়ে রেশমি জুলফেঁ’ আর ‘খিজা কে ফুল পে’ গানটি। ‘ইয়ে রেশমি’র ‘হিট’য়ের সংখ্যা ৯ লাখের উপর। |
বিয়ের দিনে |
মুমতাজের সঙ্গে |
|
কিশোরকুমারকে চাই ‘দো রাস্তে’তে রাজেশ কিশোরকুমারকে নেওয়ার জন্য কোনও জোরাজুরি করেননি, কিন্তু অন্য একটা ছবির ক্ষেত্রে রাজেশ আবার কিশোরকে নেওয়ার জন্য অদ্ভুত একটা কাণ্ড করেন। ছবির নাম ‘দুশমন’। “আমরা সবাই বসে আছি। রাজেশজিকে ‘ওয়াদে তেরা ওয়াদা’ গানটা শুনিয়েছি। গানটা আগে কিশোরকুমারকেও শোনানো হয়েছিল। উনি শুনে আমাদের বলেন, ‘সুন্দর গান, কিন্তু আমার মনে হয় এটা রফি সাব গাইলে ভাল হবে।’ শুনে আমরা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলাম, অনেক ভেবেচিন্তেই আমরা গানটা তাঁকে দিয়ে গাওয়াব বলেই ঠিক করেছি। এটা অন্য কাউকে দিয়ে গাওয়ানোর নয়,” বলছিলেন প্যারেলাল। ঠিক যেমন অভিনেতাদের ক্ষেত্রে তাঁরা ভেবে ভেবে গান তৈরি করতেন, গায়কদের ব্যাপারেও তাই। “ছবিতে কাকার ট্রাক ড্রাইভারের রোল। বিন্দু ডান্সারের রোল-এ। এক রাতে কাকা পৌঁছন বিন্দুর ডেরাতে। ও রকম একটা সিনে হিরোইনকে দিয়ে গান গাওয়ানোটাই প্রথা। আমরা ঠিক করলাম উলটো পথে হাঁটব। ছবিতে কাকা গাইবেন। আর বিন্দু তার তালে তালে নাচবেন। পরিচালক দুলাল গুহর আইডিয়াটা দারুণ পছন্দ হল। আমরা জানতাম, রাজেশজি যখন কিশোরকুমারের গাওয়া গানটা শ্যুট করবেন, তখন গোটা ব্যাপারটা অন্য মাত্রা পেয়ে যাবে,” বলছিলেন তিনি।
কিন্তু শুরুতেই যে গলদ! কিশোরকুমার রাজি নন। তখন রাজেশ খন্না নিজেই ঠিক করেন, তিনি দায়িত্ব নিয়ে কিশোরকুমারকে রাজি করাবেন। “আমাদের নিয়ে কাকা গেলেন কিশোরকুমারের সঙ্গে দেখা করতে। কোনও কারণে সেই মিটিং-এ রমেশ সিপ্পিও ছিলেন। কাকা আমাদের দিকে তাকিয়ে একবার চোখ মারলেন। তার পর কিশোরজিকে বললেন, ‘দেখুন আপনি যদি এই গানটা না গান, তা হলে ছবি থেকেই এটা বাতিল করে দেওয়া হবে। মুহূর্তের মধ্যে কাজ হাসিল। রাজি হয়ে গেলেন কিশোরকুমার।” বলে হেসেই ফেলেন প্যারেলাল।
মুখড়া শুনে বলে দিতেন এটা হিট
কোন সুরটা ভাল, কোনটা দর্শক নেবে, সেটা বোঝার অদ্ভুত এক ক্ষমতা ছিল রাজেশ খন্নার। যশ চোপড়ার প্রযোজনায় প্রথম ছবি ‘দাগ’। পরিচালনার দায়িত্বেও তিনি নিজে। মুখ্য চরিত্রে রাজেশ খন্না আর শর্মিলা ঠাকুর। শাহির লুধিয়ানভির লেখা, ‘মেরে দিল মে আজ ক্যয়া হ্যায়’। সুর লক্ষ্মীকান্ত-প্যারেলাল। প্যারেলাল বলছিলেন, “সুরটা করেই আমরা চেয়েছিলাম কাকাকে গানটা শোনাতে। মনে আছে, সেদিন স্টুডিয়োতে ওঁর আসার কথা ছিল ছ’টায়। এ দিকে এলেন যখন, তখন প্রায় সাড়ে আটটা-ন’টা বেজে গিয়েছে। এসেই দেরির জন্য ক্ষমা চাইলেন। এবার গান শোনানোর পালা। সবে মুখড়াটা শুনিয়েছি। কাকা থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আগে মত্ শুনাও। ইয়ে গানা হিট হোগা!’ তার পর বললেন, আরে, গানটাকে সেলিব্রেট করে আজ রাতেই কিন্তু পার্টি করা উচিত। সেই রাতে সবাইকে নিয়ে পার্টি দিলেন কাকা। যত বার ঘটনাটার কথা ভাবি, অবাক হই। এই রকম কান ক’জনের থাকে? মুখড়া শুনে গান বোঝার ক্ষমতা তো চাট্টিখানি ব্যাপার নয়।” |
রাজেশ খন্না, অমিতাভ বচ্চন, জয়া ভাদুড়ি, ডিম্পল কাপাডিয়া |
রাজেশ খন্না, শর্মিলা ঠাকুর |
|
অন্যের গানের ডাবিংয়েও যেতেন
শুধু সুর বুঝতেন তা নয়, এমনকী অন্যের গানের ডাবিংয়েও যেতেন তিনি। একবারের কথা বলছিলেন প্যারেলাল, “আমরা ‘দো রাস্তে’র জন্য একটা গান রেকর্ড করব ঠিক করেছিলাম লতাজির সঙ্গে। ‘বিন্দিয়া চমকেগি’। পুরো কাজটা মুমতাজকে নিয়ে। কাকা এই গানে কোথাও নেই। কিন্তু যেদিন ডাবিং হওয়ার কথা, হঠাৎ দেখি উনি চলে এলেন স্টুডিয়োতে। সারাটা ক্ষণ থাকলেন। ডাবিং দেখলেন। কোনও হুড়োতাড়া নেই। চুপচাপ বসে দেখলেন। পুরো ডাবিং শেষ হতে তার পর বাড়ি ফিরে গেলেন।”
শায়েরি পছন্দ করতেন তিনি
খুব বেশি মানুষ জানেন না, রাজেশ খন্না শের আর শায়েরির খুব ভক্ত ছিলেন। “এ রকম অনেক দিন গিয়েছে, যখন কাকা, আনন্দ বক্সি, শাহির লুধিয়ানভি মিলে মেহফিল বসিয়েছেন। সেখানে শায়েরি শোনানো হত। কাকা নিজে গালিব আর মীর থেকে শায়ের শোনাতেন। গানের ভাল কথা তো তারিফ করতেনই, সঙ্গে শের বা শায়েরির ভাল মাত্রায় সমঝদার ছিলেন কাকা,” বলছিলেন প্যারেলাল।
ওঁর কথাতেই শোনা গেল, ‘রোটি’ ছবির দুটো গানের চলন অনেকটা কবিতার ছন্দ মাথায় রেখে করা হয়েছিল। “মনে আছে রাজেশ খন্নার সেই ‘ইয়ে পাবলিক হ্যায় সব জানতি’ গানটা? ওটা ওঁর খুব পছন্দ হয়েছিল। তার পর আমরা সুর করি ‘নাচ মেরি বুলবুল’। গানটা গাওয়ানো হয় একদম একটা অন্য স্টাইলে। ‘সিংগিং’ যাকে বলে, সেটা ও ভাবে তেমন ছিল না। তবু কী ইমপ্যাক্ট! রিদম্টা কাকার অসম্ভব পছন্দের ছিল!”
আমাদের প্রথম শোতে গিয়ে কী নাচ
১৯৮৪ সাল। লক্ষ্মীকান্ত-প্যারেলালের প্রথম বিদেশ শো। ইউরোপ আর আমেরিকা সফর। “লন্ডন, প্যারিস, লস এঞ্জেলেস, নিউ ইয়র্ক আর কানাডাতে একটা শো। মে মাসে গিয়েছিলাম আমরা। আমাদের প্রথম শো। রাজেশ খন্না তখন তো সুপারস্টার। কিন্তু আমাদের সম্পর্কে কী অসম্ভব শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। মনে আছে, আমাদের প্রথম শো-তে গিয়ে কী ভাবে মাতিয়ে দিয়েছিলেন। স্টেজে উঠে গানের সঙ্গে সে কী নাচ!” বলছিলেন প্যারেলাল। যে ক’টা শো করেছেন, প্রত্যেকটাতে রাজেশ খন্নার বিশেষ দু’টো গান গাইতেই হত‘মেরে মেহবুব ক্যয়ামত হোগি’, ছবির নাম ‘মিস্টার এক্স’। আর অন্যটা হল ‘দো রাস্তে’ থেকে ‘ছুপ গ্যয়ে সারে নজারে’। |
|
সপরিবারে রাজেশ খন্না |
টোকাটুকি পছন্দ করতেন না
বিদেশি গান থেকে ‘অনুপ্রেরণা’ নেওয়ার ‘অভিযোগ’ বলিউডের অনেক সুরকারেরই রয়েছে। কিন্তু লক্ষ্মীকান্ত-প্যারেলালের ক্ষেত্রে এটা খুব একটা শোনা যায় না। “এই ব্যাপারটা আমরা শঙ্কর-জয়কিষেনের কাছ থেকে শিখেছি। কিন্তু দু’একটা ক্ষেত্রে আমাদের কিছু করার ছিল না। সে সব ক্ষেত্রে জোর করা হয়েছে। ‘ঝুমা চুমা দে দে’ গানটা নিয়ে যেমন। গানটা হিট করে। কিন্তু তার পর বাপিদার ‘তাম্মা দে দে’। ওই এক সুর। অন্য স্টারের ক্ষেত্রে যাই হোক না কেন, কাকা এ সব ব্যাপারে একেবারে অন্য রকম ছিলেন। কোনও দিন আমাদের বলেননি, কোনও বিদেশি গান শুনে সেটার যেন আমরা একটা নকল ভার্সান করি। কিংবা কোনও পুরনো সুর আবার ফিরিয়ে আনি।” প্যারেলাল বলছিলেন, “কাকা চাইতেন ভাল অরিজিনাল সুর। তাতে ঝুঁকি থাকলে থাকুক। কিন্তু সহজে, সস্তায় বাজিমাত করাতে কিছুতেই ওঁর মন চাইত না। আর সেটাই বোধহয় ছিল ওঁর সাফল্যের ট্রাম্পকার্ড। মনে পড়ে, ‘মেহবুব কি মেহেন্দি’র কথা। ছবির ফিনান্স আর ডিস্ট্রিবিউশন সব কাকার দায়িত্বে। অভিনয়ে ওঁর সঙ্গে লীনা চন্দ্রভারকর। বিরাট ঝুঁকি নিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানেও সহজ বা চটুল কিছু করে সাফল্য পেতে চাননি। আর তাতে ফলও পেয়েছেন। ছবিটায় আমরা সুর করেছিলাম ‘জানে কিঁউ লোগ মহব্বত কিয়া করতে হ্যায়’ গানটির। আজও তো লোকে সে গান মন দিয়ে শোনে।”
শেষ কাজ ‘অনুরোধ’
সিম্পল কাপাডিয়া হিরোইন। আর রাজেশ খন্না হিরো। কী সব অনবদ্য গান ‘আতে যাতে খুবসুরত’, ‘আপকে অনুরোধ সে’, ‘মেরে দিল না তড়প কে যব নাম তেরা পুকারা’। “আমাদের একটা টিমওয়ার্ক কাজ করত। আনন্দ বক্সি বা শাহির লুধিয়ানভি গান লিখতেন। আমরা সুর দিতাম। কিশোরকুমার গাইতেন। শক্তি সামন্ত সেটাকে পিকচারাইজ করতেন। আর কাকা সেটাকে স্ক্রিনে ফুটিয়ে তুলতেন। দু’হাত তুলে এক রকমের স্টাইলাইজড নাচ ছিল ওঁর সিগনেচার। আর ছিল কাকার বিখ্যাত হাসি। সুর করার সময় এটাও খেয়াল করতাম আমরা, যাতে পর্দায় ভাল করে ওঁর হাসি ভরা মুখটা ফুটে ওঠে। দর্শকের মন ভরে যায়।” আজও সেই হাসিটাই মনে ধরে রেখেছেন প্যারেলাল।
কথার শেষে বললেন, “চোখ বন্ধ করলেই ওই হাসিটা দেখতে পাই। মনে হয়, যদি স্বর্গ বলে কিছু থাকে, সেখানেও একই ভাবে কাকা হাসি বিলিয়ে বেড়াচ্ছেন। সবার অলক্ষ্যে মুক্তোদানার মতো সেই হাসি ছড়িয়ে পড়ছে সারা আকাশে।” |
|
|
|
|
|