রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কোনও রকম দ্বন্দ্বে না-গিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে যাবতীয় মতপার্থক্য মিটিয়ে নিতে রাজ্য সরকারকে পরামর্শ দিল কলকাতা হাইকোর্ট। বুধবার হাইকোর্টের বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল বিমল চট্টোপাধ্যায়কে উদ্দেশ করে বলেন, “এটা কোনও যুদ্ধের ব্যাপার নয়। কমিশনের সঙ্গে রাজ্য সরকারের কোনও দ্বন্দ্বে যাওয়া উচিত নয়। মতপার্থক্যগুলির যাতে সমাধান হয়, সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে রাজ্য সরকারের তা দেখা উচিত।”
প্রসঙ্গত, নির্বাচনী সন্ত্রাস নিয়ে প্রদেশ কংগ্রেসের দায়ের করা মামলাটি বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের এজলাসেই চলছে। এ দিন তাঁর এজলাসে একটি রিপোর্ট জমা দিয়ে কমিশন জানায়, তারা ভোটের প্রচারে বাইক-বাহিনী নিষিদ্ধ করলেও প্রশাসন সহযোগিতা করছে না। কত বাহিনী মোতায়েন করা হচ্ছে, প্রশাসন সে বিষয়েও তাদের অন্ধকারে রেখেছে বলে কমিশনের অভিযোগ।
আর তার প্রেক্ষিতে এ দিন রাজ্য সরকারের প্রতি বিচারপতির নির্দেশ, কমিশনের ওই নিষেধাজ্ঞা যাতে কঠোর ভাবে বলবৎ হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। শুধু তা-ই নয়, প্রচারে বাইক-বাহিনী বন্ধ করা গেল কি না, সরকারের তরফে কাল, শুক্রবারই তা হাইকোর্টকে জানাতে হবে। পাশাপাশি কমিশনের চাহিদামতো কোথায় কত বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে, শুক্রবার রাজ্য সরকার তার হিসেবও কোর্টে পেশ করবে। কিন্তু কমিশন বলা সত্ত্বেও বাইক-বাহিনীর দাপট বন্ধ হচ্ছে না কেন?
পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “আমি তো দেখছি মোটরবাইকও আছে, নির্দেশও আছে! আমরা দুর্বল, শান্তিপ্রিয় মানুষ! ওঁরা যা বলবেন, মানছি।”
একই সঙ্গে সুব্রতবাবুর দাবি, পঞ্চায়েত ভোটপর্ব শান্তিতেই চুকবে। তবে ঘটনা হল, হাইকোর্ট যতই পরামর্শ দিক না কেন, কমিশনের সঙ্গে বিরোধ মেটানোর পথে যে তৃণমূল তথা সরকার আপাতত হাঁটছে না, এ দিন পঞ্চায়েতমন্ত্রীর কথায় তার ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে। দ্বন্দ্ব কেন মিটছে না, সে প্রসঙ্গে সুব্রতবাবু বলেছেন, “আমরা সুপ্রিম কোর্টকে লিখেছিলাম, রমজানে ভোট করতে চাইছি না। উনি (নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডে) কী লিখেছিলেন? তার মানে দাঁড়ায়, উনি রমজানে ভোট চেয়েছিলেন।” পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র বা তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীর পরে এ দিন নির্বাচন কমিশনারের উদ্দেশে তীব্র ভাষায় আক্রমণ শানিয়েছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ও।
নির্বাচনী সন্ত্রাস প্রতিরোধের লক্ষ্যে গত শুক্রবার বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের মুখ্যসচিব ও স্বরাষ্ট্র-সচিবকে নির্দেশ দেন কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে বসে ব্যবস্থা যথোচিত নিতে। সেই মতো গত শনিবার দু’পক্ষে বৈঠক হয়। বৈঠকের রিপোর্ট এ দিন এজলাসে জমা দিতে বলেছিলেন বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায়। কমিশনের কৌঁসুলি লক্ষ্মীচাঁদ বিয়ানি এ দিন ২৫ পাতার রিপোর্টটি পেশ করেন। রাজ্যের তরফেও একটি বন্ধ খাম বিচারপতিকে দেওয়া হয়।
কমিশনের রিপোর্টে মূলত দু’টো বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে। প্রথমত জানানো হয়েছে, প্রচারে সন্ত্রাস বন্ধে তারা কী ব্যবস্থা নিয়েছে। দ্বিতীয়টি নিরাপত্তাবাহিনী মোতায়েন সংক্রান্ত। আর সেই সূত্রেই কমিশনের দাবি, হাইকোর্টে বিরোধীদের তোলা অভিযোগের ভিত্তিতে গত রবিবার বাইক-বাহিনী নিষিদ্ধ করে জেলা প্রশাসনগুলিকে নির্দেশিকা পাঠানো হয়েছে। অথচ তা কার্যকর হয়নি। প্রশাসনই নির্দেশিকা যথাযথ পালন করেনি বলে রিপোর্টের অভিযোগ। পাশাপাশি অভিযোগ: কোথায় কত বাহিনী পাঠানো হয়েছে, তা কমিশনকে জানানো হচ্ছে না। কী রকম?
রিপোর্টে বলা হয়েছে, রাজ্যের নিজস্ব বাহিনী কম থাকায় বিকল্প কী হতে পারে, সে সম্পর্কে কমিশন সরকারের সঙ্গে শনিবার দীর্ঘ বৈঠক করেছে। সেখানে স্থির হয়েছে, রাজ্যের মোট ৩২৯টি ব্লকের নির্বাচনী প্রচারপর্বে ব্লকপিছু ৩ সেকশন বাহিনী মোতায়েন হবে। প্রতি সেকশনে থাকবেন এক জন এসআই বা এএসআই, এবং ৯ জন কনস্টেবল। কমিশনের অভিযোগ, বাহিনী নিয়ে রাজ্যের বাস্তব অবস্থা কী, মুখ্যসচিব তা জানিয়ে দেবেন বলেছিলেন। কিন্তু এ দিন সকাল পর্যন্ত কমিশন এ ব্যাপারে অন্ধকারেই রয়েছে।
বস্তুত বাহিনী প্রশ্নে তাদের অভিজ্ঞতা যে খুব সুখকর নয়, তা জানিয়ে কমিশন আদালতকে বলেছে, মনোনয়নপর্বে রাজ্যের কাছে ৩২১ কোম্পানি চেয়ে মিলেছিল সাকুল্যে ৩০ কোম্পানির কিছু বেশি। এই বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন অ্যাডভোকেট জেনারেল। “কমিশনের এই তথ্য ঠিক নয়। পরে আরও চার হাজার বাহিনী পাঠানো হয়েছিল।” বলেন তিনি।
আর তখনই সরকারকে কমিশনের সঙ্গে বিরোধ অবসানের পরামর্শ দেন বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায়।
|