প্রিয় বাঁধাকপি ছুঁয়েও দেখছে না। কলমি শাকে অরুচি। স্পেশাল মেনু খিচুড়িও পাতেই পড়ে। সারা দিনে কুটুস-কুটুস করে পিংপং শুধু ক’টা বিস্কুট দাঁতে কেটেছে। দিনভর যে ঘরময় পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়াত, তার ঠিকানা এখন খাটের তলায়। কান দু’টো তুলে সে যেন প্রতীক্ষায় রয়েছে কখন ফিরবে ওরা।
ওঁদের ফেরার কথা ছিল জুনের ২২ তারিখ। তার পরও কেটে গিয়েছে দিন পনেরো। এখনও ফেরেননি বাগুইআটির রঘুনাথপুরের বাসিন্দা জহর সাহা, স্ত্রী রীতাদেবী ও তাঁদের মেয়ে জয়িতা। ওঁদের সঙ্গে ছিলেন জয়িতার বন্ধুর মা সংযুক্তা দেবও। কেদারনাথ যাত্রার আগে বাড়ি আর বাড়ির পোষ্য ওই খরগোস পিংপং-এর দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন তাদের ভাড়াটে অরিজিৎ ও মিঠু মল্লিককে। সেই দায়িত্বই এখন দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তাঁদের। অরিজিৎ বললেন, “ওঁরা না ফেরায় পিংপং-এর মেজাজটাও খিটখিটে হয়ে গিয়েছে। কোলে নিতে গেলে আঁচড়ে দিচ্ছে।”
দু’বছর ধরে পিংপং এই বাড়ির বাসিন্দা। তাঁকে নিজের হাতে বড় করেছিলেন রীতাদেবী। ঠাকুরঘরে রীতাদেবী যত ক্ষণ থাকতেন, তাঁর গা ঘেষে থাকত পিংপং। অরিজিৎ বলেন, “হয়তো কাকতালীয়। কিন্তু ১৭ তারিখ, অর্থাৎ যে দিন মেঘভাঙা বৃষ্টি ও হড়পা বানে কেদারে বিপর্যয় হল, সে দিন সারা ক্ষণ ঠাকুরঘরে বসেছিল পিংপং। ওই দিন থেকেই মাসিমা-মেসোমশাই, জয়িতা আর সংযুক্তার খোঁজ নেই।” |
জহরবাবুরা কবে ফিরবেন কেউ জানেন না। ১৫ জুন সন্ধ্যায় কেদারনাথ মন্দিরে পুজো দেওয়ার পর শেষ বার জহরবাবুদের সঙ্গে কথা হয়েছিল অরিজিৎদের। তার পর থেকে আর কোনও খোঁজ নেই তাঁদের। অরিজিৎ বলেন, “কেদারনাথে যে খুব বৃষ্টি হচ্ছে, সেটা জহরবাবু ১৫ জুনই আমাকে জানিয়েছিলেন। উঠেছিলেন, ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘে। ফোনে বলেন, ভাল ভাবে পুজোও তারা দিয়েছেন। ঠিক ছিল, পরের দিনই তাঁরা গৌরীকুণ্ডে নেমে আসবেন। কিন্তু ১৬ তারিখ থেকেই তাদের আর কোনও খোঁজখবর নেই।”
মাকে খুঁজতে উত্তরাখণ্ডে যান সংযুক্তার ছেলে আশিস। রীতাদেবীর মেয়ে জয়িতা তাঁর বাগদত্তা। তেঘরিয়ার ফ্ল্যাটে বসে আশিস বলেন, “১৩ দিন ধরে তন্ন-তন্ন করে খুঁজেছি মা আর জয়িতাদের। ৪৮ ঘণ্টা না-খেয়ে ছিলাম। হরিদ্বার থেকে রুদ্রপ্রয়াগ সব জায়গার রেসকিউ ক্যাম্পে গিয়েছি। ৪০টার মতো রেসকিউ ক্যাম্পে গিয়ে ওদের ছবি দেখিয়েছি পুলিশকে। কোথাও কোনও আশার আলো পাইনি।”
আশিস বলেন, “গত ২৫ ডিসেম্বর মা-বাবার বিবাহবার্ষিকীতে আমরা সবাই মিলে আনন্দ করলাম। মা-বাবাকে স্পেশাল গিফট দিল জয়িতা। কেদারনাথে আমারও যাওয়ার কথা ছিল। হঠাৎ জরুরি কাজ পড়ে যাওয়ায় বাতিল করি। আমি সঙ্গে গেলে হয়তো অন্য রকম কিছু হতো।”
দেহরাদূনের রেসকিউ ক্যাম্পে খোঁজ করতে গিয়ে আশিস পেয়ে গিয়েছিলাম কেদারনাথের ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের এক জন কর্মীকে। জয়িতারা সেখানেই ছিলেন। ওই কর্মী জানান, ১৬ তারিখ সকালেও তিনি চা দিয়েছিলেন জয়িতাদের। সেই চা খেয়েই তাঁরা গৌরীকুণ্ডের দিকে রওনা দেন। আশিস বলেন, “ওরা যখন কেদারনাথের দিকে যাচ্ছিল, জয়িতার ফোন প্রায়ই নট রিচেবল বলতো। কিন্তু মায়ের ফোন সব সময় পাওয়া যেত। ১৬ তারিখ কিন্তু সারা দিন দু’টো ফোনই নট রিচেবল বলেছে। ১৭ তারিখ থেকে দু’টো ফোন সুইচড্ অফ বলতে থাকে।”
আশা এখনও ছাড়েননি আশিস। টিভির খবরের দিকে তাকিয়ে থাকেন। হঠাৎ যদি জয়িতা, বা অন্যদের দেখা মেলে। আশিস বলেন, “আশা ছাড়িনি। দরকার হলে আবার উত্তরাখণ্ডে যাব। ঠিক ওদের খুঁজে বার করব!” |