রক্তে ভেসে যাচ্ছে ঘর। সেই রক্তের মধ্যেই চিত হয়ে পড়ে আছেন এক বৃদ্ধা। নলি কাটা। শরীরের অন্যত্রও একাধিক ধারালো অস্ত্রের আঘাত। ঘরের আলমারি, বিছানাপত্র লন্ডভন্ড।
পুলিশ জানায়, নিহত বৃদ্ধার নাম সুলোচনা চারি (৬৭)। ওই দক্ষিণী মহিলা ন্যাশনাল স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষিকা। স্কুল থেকে অবসর নিলেও বাড়িতে নিয়মিত ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির ছাত্রছাত্রী পড়াতেন তিনি। অবিবাহিত সুলোচনাদেবী কসবার দেবিয়াডাঙা সেকেন্ড লেনে একটি বহুতলের চারতলায় এক কামরার ফ্ল্যাটে একাই থাকতেন। দু’বেলা কাজ করতেন এক পরিচারিকা। রবিবার বিকেলে ফ্ল্যাট বন্ধ দেখে এবং বৃদ্ধার সাড়াশব্দ না-পেয়ে পড়শি এবং অন্য পরিচিতেরা বিকল্প চাবি দিয়ে দরজা খোলেন। ঢুকেই রক্ত দেখে শিউরে ওঠেন তাঁরা। প্রাথমিক ধাক্কা সামলে তাঁরাই খবর দেন কসবা থানায়।
পুলিশ গিয়ে বৃদ্ধার দেহ ময়না-তদন্তে পাঠায়। পৌঁছে যান গোয়েন্দা-প্রধান পল্লবকান্তি ঘোষ, লালবাজারের ডাকাতি দমন ও হোমিসাইড শাখার অফিসারেরা। আসে পুলিশ-কুকুরও। প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশ জানিয়েছে, নলি তো কেটে দেওয়া হয়েছিলই। তা ছাড়াও ওই বৃদ্ধার কপাল-সহ শরীরের একাধিক জায়গায় ধারালো অস্ত্রের আঘাত মিলেছে। সারা ঘর ছত্রখান হয়ে ছিল। তদন্তকারী গোয়েন্দাদের অনুমান, খুনের সঙ্গে একাধিক লোক জড়িত এবং তাদের মধ্যে ছিল বৃদ্ধার পরিচিতেরাও। |
কে বা কারা, কেন ওই বৃদ্ধাকে খুন করল, গভীর রাত পর্যন্ত তা জানা যায়নি। ওই বহুতলে কোনও রক্ষী নেই। ফলে কে বা কারা কখন ওই বাড়িতে ঢুকছে বা বেরোচ্ছে, সেই ব্যাপারেও কোনও তথ্য মেলেনি। এক পুলিশকর্তা বলেন, “সোমবার ময়না-তদন্তের পরে খুনের সময়টা বোঝা যাবে। তখন তদন্তের একটা অভিমুখ মিলবে বলে আশা করা হচ্ছে।”
ঠিক কী হয়েছিল এ দিন?
পুলিশি সূত্রের খবর, সুলোচনাদেবী বাড়িতে ছাত্রছাত্রী পড়াতেন। এ দিন বিকেল সওয়া ৪টে নাগাদ এক ছাত্রী তাঁর বাড়িতে পড়তে গিয়েছিল। প্রতিবেশীরা পুলিশকে জানিয়েছেন, ওই ছাত্রী ঘরের ভিতরে শিক্ষিকার সঙ্গে এক ব্যক্তির ঝগড়ার আওয়াজ পেয়েছিল। কিছু ক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরে সে ফোন করে তার বাড়িতে ঝগড়ার বিষয়টি জানায়। তার পরেই সে নিজের বাড়িতে ফিরে যায়। ইতিমধ্যে ওই ছাত্রীর বাড়ি থেকে সুলোচনাদেবীর স্কুলের কিছু সহকর্মী-সহ কয়েক জন পরিচিতকে বিষয়টি জানানো হয়। তাঁরা বিকেল ৫টা নাগাদ বৃদ্ধার ফ্ল্যাটে পৌঁছে যান। তত ক্ষণে অবশ্য ঝগড়াঝাঁটির আওয়াজ থেমে গিয়েছে। দেখা যায়, বৃদ্ধার ফ্ল্যাটের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। বহুতলের উল্টো দিকের বাড়িতে ওই শিক্ষিকার পরিচিত এক দক্ষিণী পরিবারের কাছে বিকল্প চাবি রাখা থাকত। সেখান থেকেই চাবি নিয়ে দরজা খোলা হয়।
এক কামরার ফ্ল্যাটে দেহটি পড়ে ছিল আলমারির সামনেই। লন্ডভন্ড হয়ে ছিল আলমারি-বিছানা। বৃদ্ধার গায়ের উপরে পড়ে ছিল দলা পাকানো শাড়ি-চাদর। তদন্তকারীদের অনুমান, ঘরে বেশ কিছু জিনিস খোয়া গিয়েছে। তবে ঠিক কী কী খোয়া গিয়েছে, সুলোচনাদেবীর পরিবারের কেউ না-থাকায় রাত পর্যন্ত তা জানতে পারেননি গোয়েন্দারা। পুলিশের খবর, সুলোচনাদেবীর এক আত্মীয় মুম্বইয়ে থাকেন। তাঁকে খবর দেওয়া হচ্ছে। পুলিশের কাছ থেকে খবর পেয়ে রাতে বেহালা থেকে এসে পৌঁছন সুলোচনাদেবীর এক ভাগ্নি। তবে তাঁর সঙ্গে সংবাদমাধ্যমকে কথা বলার সুযোগ দেয়নি পুলিশ।
বিকেলে যে-ছাত্রীটি পড়তে গিয়েছিল, তার খোঁজ পেলেও পুলিশ এখনও তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। ছাত্রীটি সওয়া ৪টে নাগাদ বৃদ্ধার বাড়ির দরজায় পৌঁছে ঘরের ভিতর থেকে ঝগড়ার আওয়াজ পেয়েছিল বলে খবর। আর বৃদ্ধার সহকর্মী এবং অন্য পরিচিতেরা ৫টা নাগাদ ফ্ল্যাট খুলে বৃদ্ধাকে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। পুলিশ মনে করছে, ছাত্রী এবং পরিচিতদের বক্তব্য ঠিক হলে খুনটা হয়েছে সওয়া ৪টে থেকে ৫টা ৪৫ মিনিটের মধ্যে।
কিন্তু কয়েকটি ব্যাপারে ধন্দ থেকেই গিয়েছে।
• ঘরের ভিতরে কার বা কাদের সঙ্গে বৃদ্ধার ঝগড়া হচ্ছিল?
• সে বা তারা কী ভাবে পালিয়ে গেল?
• পালানোর আগে তারাই কি ঘরে চাবি দিয়ে গিয়েছিল?
তদন্তকারীরা জানান, ঠিক ক’জন এসেছিল বলা যাচ্ছে না। তবে ঘরের ভিতরে রক্তমাখা কয়েকটি পায়ের ছাপ মিলেছে। তার মধ্যে বেশ কয়েকটিতে মহিলাদের পায়ের ছাপের আদল আছে। অর্থাৎ আততায়ীদের মধ্যে মহিলাও থাকতে পারে। সুলোচনাদেবীর পরিচিতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ জেনেছে, দরজা খোলার আগে আই-হোল দিয়ে দেখে নিতেন তিনি। এই তথ্যের ভিত্তিতে তদন্তকারীরা অনুমান করছেন, আততায়ীরা ওই বৃদ্ধার পরিচিত। চেনা লোক দেখেই তিনি দরজা খুলে তাদের ভিতরে ঢুকতে দিয়েছিলেন। এখন প্রশ্ন, সেই পরিচিতেরা কারা? জবাব পেলে জট অনেকটাই খুলবে বলে মনে করছে পুলিশ। যে-দক্ষিণী পরিবারের কাছে বিকল্প চাবি ছিল, সেখান থেকে বৃদ্ধার পরিচারিকার খোঁজ পেয়ে তাঁকে ডাকিয়ে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে পুলিশ তাঁকে থানায় নিয়ে যায়। সুলোচনাদেবী কাদের সঙ্গে মিশতেন, দক্ষিণী পরিবারটির কাছে তা জানতে চায় পুলিশ। তারা জেনেছে, সকালে বেরিয়েছিলেন সুলোচনাদেবী। ফেরেন বেলা দেড়টা নাগাদ। তিনি কোথায় গিয়েছিলেন, জানার চেষ্টা চলছে। |