মাস আটেক আগে ম্যারাপ বেঁধে, মাইক ফুঁকে ঘটা করে উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনের ফিতে কাটতে নবনির্মিত দোতলা স্বাস্থ্যভবনের দরজা ওই দিনই কেবল একবার খোলা হয়েছিল। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত কুড়ুলপাড়ার উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দরজা আর খোলেইনি। আজও মুর্শিদাবাদ-জিয়াগঞ্জ ব্লকের ডাহাপাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রত্যন্ত-এলাকার কুডুলপাড়া গ্রাম সংসদের উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রে তালা ঝুলছে। অথচ দুর্গম ওই তল্লাটের কয়েক হাজার মানুষের কাছে নূন্যতম স্বাস্থ্যপরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার ঘোষিত নীতি কার্যকর করতে সাড়ে ১২ লক্ষ টাকা খরচ করে তৈরি করা হয় উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রেটির দোতলা ভবন। স্বাস্থ্য পরিষেবার বদলে নব নির্মিত ভবন আজ ছেয়ে গিয়েছে আগাছায়। ভবনে ঢোকার মুখের সিঁড়িতেও ধরেছে বিশাল ফাটল। অথচ দুর্গম এলাকার আমজনতার পক্ষে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা পাওয়ার জন্য গ্রামেরই সহোদর আইনাল হক ও আজিজুল হক ৫ শতক জমি দান করেছেন উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রেটির ভবন তৈরি করতে। |
মাস আটেক আগে ভবনের দ্বারোদ্ঘাটন করেন স্থানীয় বিধায়ক কংগ্রেসের শাঁওনি সিংহ রায়। অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে ছিলেন মুর্শিদাবাদ-জিয়াগঞ্জ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি রফিকুল ইসলাম ও স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েতের উপ-প্রধান বেদার হোসেন। তাঁরা দু’জনেই কংগ্রেসের স্থানীয় নেতা। বিধানসভা, পঞ্চায়েত সমিতি ও গ্রাম পঞ্চায়েত এক কথায় গ্রামীন ক্ষমতার সব ক’টি প্রতিষ্ঠান একটি দলের দখলে থাকলেও উদ্বোধনের ৮ মাস পরেও উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি চালু হয়নি কেন? শাঁওনি সিংহ রায় বলেন, “চালু করার কথা তো আমাদের নয়। চালু করবে স্বাস্থ্য দফতর। হয়তো কর্মীর অভাবে তাঁরা চালু করতে পারেনি।” আজও চালু হয়নি শুনে তো আকাশ থেকে পড়েন পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, “বলেন কী! উদ্বোধনের এত দিন পরেও চালু হয়নি! আমাকে কেউ তো সে কথা বলেনি। খোঁজ নিচ্ছি।” পঞ্চায়েতের উপ-প্রধান বেদার হোসেনের জবাব আরও কিম্ভূত। তিনি বলেন, “ওই উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কর্মীরা সবাই সিপিএমের সমর্থক। তাই তাঁরা চক্রান্ত করে চালু করছে না। কথা দিলাম, এক সপ্তাহের মধ্যে চালু করবই।” ‘কথা দেওয়া’র পর দু’সপ্তাহ কেটে গিয়েছে।আজও তবু উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রের তালা খোলেনি। ওই গ্রাম থেকে নির্বাচিত পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য মমতা মণ্ডল বলেন, “গ্রাম পঞ্চায়েতের তত্ত্বাবধানে উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ভবনটি নির্মান করা হয়েছে। ভবনের চাবিটিও রয়েছে পঞ্চায়েতের এক্তিয়ারে।” মুর্শিদাবাদ জেলার মুখ্যস্বাস্থ্য আধিকারিক অজয়কুমার চক্রবর্তী বলেন, “স্বাস্থ্যকর্মী না থাকার কথা সঠিক নয়। প্রয়োজনীয় কর্মী রয়েছে। ভবনের পাশ দিয়ে বিদ্যুতের হাইটেনশান লাইন গেলেও উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়নি। জলের ব্যবস্থাও নেই। যে সিঁড়ি দিয়ে প্রসূতি ও অসুস্থরা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ঢুকবেন সেটিতেই বড়সড় ফাটল ধরেছে। এবং সিঁড়িটি অগম্য। পঞ্চায়েত থেকে ওই সব অব্যবস্থা দূর করে ভবনটি স্বাস্থ্য দফতরকে হস্তান্তর করা হলেই পরিষেবা দেওয়ার কাজ শুরু করা হবে।” জরুরি ওই সব কাজগুলি পঞ্চায়েত থেকে সম্পন্ন না করা পর্যন্ত ওই তল্লাটের কয়েক হাজার মানুষকে বরাবরের মতো ভুগতেই হবে। কেমন সেই ভোগান্তি?
বাঘিরাপাড়া, রামরাজাপুর, ডাঙাপাড়া, কুডুলপাড়া, কমলা পুস্কুরিণী, মির্জাপাড়া, নতুনপাড়া ও বগুলা নিয়ে কুডুলপাড়া গ্রাম সংসদ। কুডুলপাড়া ও লাগোয়া কয়েকটি গ্রাম সংসদ এলাকা থেকে নিকটবর্তী হাসপাতাল রয়েছে বহরমপুর অথবা লালবাগে। দু’টিরই দূরত্ব প্রায় ১০ কিলোমিটার। ওই গ্রামের সব্জি ব্যবসায়ি সেলিম শেখের ভাষায়, “বহরমপুর ও লালবাগের দূরত্ব ফিতের মাপে ১০ কিলোমিটার হলেও সময়ের হিসাবে তা কখনও একদিন, কখনও দু’দিন।” সেলিমের ব্যাখা, “গ্রাম থেকে বের হওয়ার রাস্তার কিছুটায় কোন আদ্দ্যিকালে মোরম বিছানো হয়েছিল। কিছুটায় আজও হয়নি। ফলে বৃষ্টি নামলে এক-দু’দিন পর কাদা না শুকালে রোগী নিয়ে গ্রামের বাইরে যাওয়া অসম্ভব।” ওই গ্রামের পঞ্চায়েত সমিতির সদস্যের স্বামী আনন্দ মণ্ডল বলেন, “ওই দুর্গতি থেকে মুক্তি দিতে দোতলা ভবন নির্মান করা হয়। স্বাস্থ্যকর্মীদের থাকার জন্য ওই ভবনের দোতলায় ঘরও রয়েছে।” ওই সব সুবিধা-সহ প্রসূতি ও শিশুদের আরও কি কি উপকার মিলবে তার দীর্ঘ ফিরিস্তি লেখা রয়েছে সরকারি প্রকল্পে ও সদম্ভে উচ্চারিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জনপ্রতিনিধিদের খই ফোটা বুলিতে।
বাস্তবে কিন্তু সবটাই আজও অধরা! |