বয়স মাত্র এগারো। ছোট্ট আরিয়ানকে বাঁচাতে প্রয়োজন বছরে ৮৮ লক্ষ টাকা। একমাত্র ছেলের চিকিৎসায় দিল্লি থেকে কলকাতা ছুটে বেড়িয়েছেন হাওড়ার বাসিন্দা শিবশঙ্কর চৌধুরী ও দেবযানী চৌধুরী। জানতে পারেন, বিরল রোগ মিউকোপলিস্যাকারাইডোসিস-২ (এমপিএস-২)-এর হান্টার সিনড্রোমের শিকার আরিয়ান। আইডুরোনেট টু সালফাটেজ এনজাইমের অভাব এর অন্যতম কারণ। ফলে মিউকোপলিস্যাকারাইড্স জমা হয় কোষের লাইসোজোমে। প্রতিহত হয় স্বাভাবিক দৈহিক প্রক্রিয়া। বাধাপ্রাপ্ত হয় মানসিক গঠনও। দিশেহারা চৌধুরী দম্পতি রাজ্য প্রশাসন থেকে কেন্দ্রীয় স্তর-সহ সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যোগাযোগ করেও সুরাহা পাননি।
ঠিক এক বছর আগে আরিয়ানকে নিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের পরে আরিয়ানের চিকিৎসার সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল বেশ কিছু হাত। যদিও খরচের অনুপাতে তা সমুদ্রে এক ঘটি জল ঢালার মতো।
ইতিমধ্যে পায়ের জোর কমেছে আরও। আরিয়ান এখন গোড়ালি উঁচু করে হাঁটতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। জামার বোতাম আটকাতে পারে না। নিজের হাতে খাবার মুখে তোলা আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি কষ্টকর। গত এক বছরে আঙুল শক্ত হওয়ায় আঙুলগুলো মুড়তে পারে না। তরকারির ঝোলে রুটি ভিজিয়ে হাতে তুলে খায় কোনওরকমে। ভাত জাতীয় যে সমস্ত খাবার আঙুলে তুলে খেতে হয়, তা আর নিজে খেতে পারে না। গত এক বছরে ঘন ঘন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে আরিয়ান। এ সবই ওর অসুখের অবনতির লক্ষণ। |
চার বছর বয়সে প্রথম অসুখটা ধরা পড়ে। তার আগে পর্যন্ত পাঁচটা সুস্থ বাচ্চার মতোই ছিল আরিয়ান। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে ‘হান্টার সিনড্রোম’-এ আক্রান্ত শিশুদের নির্দিষ্ট শারীরিক গঠনের ধাঁচেই বদলেছে আরিয়ান।
চিকিৎসকদের মতে, একমাত্র চিকিৎসা ‘হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি’। বাইরে থেকে আইডুরোনেট টু সালফাটেজ এনজাইম প্রয়োগ করে রোগের অবনতি রোধ করা সম্ভব। সারা বিশ্বে একটিই মাত্র ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থা এই রোগের ইন্ট্রাভেনাস ইঞ্জেকশনটি তৈরি করে। তার খরচও আকাশ ছোঁয়া। দেহের ওজনের উপরে নির্ভর করে এর খরচ। রোগীকে আজীবন এই ইঞ্জেকশন নিয়ে যেতে হয়। প্রায় বছর খানেক আগে লেখা এইমস্-এর এক শিশু বিশেষজ্ঞের স্বাক্ষরিত চিঠি অনুযায়ী আরিয়ানের ক্ষেত্রে খরচের পরিমাণ বছরে কম করে ৮৮ লক্ষ টাকা।
শিশু বিশেষজ্ঞ অপূর্ব ঘোষ বলেন, “আইডুরোনেট টু সালফাটেজ এনজাইমকে বাইরের থেকে জোগান দিলে সমস্যার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। যদিও এই হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি বর্তমানে পরীক্ষামূলক পর্যায়ে। সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম (সিএনএস) ঠিক মতো কাজ করলে রোগীর এই চিকিৎসায় সাড়া দেওয়ার কথা। আরিয়ানের ক্ষেত্রে এখনও সিএনএস ঠিক মতো কাজ করছে। ফলে ওর ক্ষেত্রে আশা আছে।”
সম্প্রতি খবর, ওই ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থাটি এ দেশে হান্টার সিনড্রোমে আক্রান্ত কয়েক জন রোগীর আজীবন নিখরচায় রোগের চিকিৎসা করানোর বিশেষ প্রকল্প আনছে। এর জন্য সারা দেশ থেকে চিকিৎসকদের নিয়ে হয়েছে কমিটি। তার সুপারিশেই বাছা হবে রোগীদের। এই খবরে নতুন করে আশায় বুক বাঁধছেন আরিয়ানের বাবা-মা। কমিটিরই এক জন দিল্লির এক বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক রত্না পুরী। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “সংস্থাটি ভারতে এখনও কাজ শুরু করেনি। শীঘ্রই করবে। এ বিষয়ে আর কিছু বলব না।”
চিন্তিত আরিয়ানের বাবা শিবশঙ্করবাবু বলেন, “কীসের ভিত্তিতে রোগী-তালিকা চূড়ান্ত হবে তা-ই তো জানি না। দেশজুড়ে ‘হান্টার সিনড্রোমে’ আক্রান্ত বেশ কিছু বাচ্চা আছে। কত জনকে বাছবে ওরা সেটা পর্যন্ত অজানা। আরিয়ানের নাম সেখানে আদৌ ঠাঁই পাবে কি!” তথ্য অনুযায়ী, এ রাজ্যে হান্টার সিনড্রোম রোগীর সংখ্যা দুই। এদেরই এক জন পঞ্চম শ্রেণির পড়ুয়া আরিয়ান। অথচ, এ রাজ্য থেকে কোনও চিকিৎসক নেই কমিটিতে। কলকাতার চিকিৎসকদের একাংশ তাই খানিকটা হলেও শঙ্কিত রোগী বাছাই পর্বের স্বচ্ছতা নিয়ে। আরিয়ানের চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষ বলেন, “ওর নাম ঢোকানোর জন্য ব্যক্তিগত ভাবে আমি কমিটিতে থাকা চিকিৎসকদের অনুরোধ করতে পারি, এইটুকু। কারণ ওর সুস্থ হওয়ার অনেকটাই আশা রয়েছে। বাকিটা শুধু অপেক্ষা।” |