পাসপোর্ট আছে। ভিসা আছে। বিমানের টিকিটও কাটা। তবু দুর্গাদাস চৌধুরীর উগান্ডা যাত্রা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। শুধু একটি টিকার জন্য!
রোজ উদ্ভ্রান্তের মতো কলকাতা বিমানবন্দরের চত্বরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন দুর্গাদাসবাবু। শুধু একটি টিকার জন্য। দিনের শেষে এক রাশ হতাশা নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। টিকা না-পেয়ে।
উগান্ডা যেতে টিকা লাগবে কেন?
চেন্নাইয়ের একটি আর্থিক সংস্থার কর্মী দুর্গাদাসবাবু জানান, অফিসের কাজেই তিনি উগান্ডা যাচ্ছেন। আর উগান্ডার বিমানে ওঠার আগে ইয়েলো ফিভার’ বা পীতজ্বরের টিকা নেওয়াটাই দস্তুর। তাঁর কথায়, “বিমানে ওঠার অন্তত ১০ দিন আগে ওই টিকা নিতে হয়। আমার যাওয়ার কথা ১০ জুলাই। কিন্তু এখনও টিকা মেলেনি। এর পরে টিকা পাওয়া গেলেও যাত্রা পিছোতে হবে।” কিন্তু কত দিনে তা মিলবে, কবে রওনা হবেন, বুঝতে না-পেরে অস্থির হয়ে উঠেছেন তিনি।
চিকিৎসকেরা জানান, উগান্ডা, নাইজেরিয়ার মতো আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার ৪৫টি দেশে এক ধরনের মশার কামড়ে পীতজ্বর হয়। জ্বর ছাড়াও ওই অসুখের উপসর্গ কোমর ও মাথায় ব্যথা। বমিও হয়। চিকিৎসকদের কথায়, অনেক ক্ষেত্রে প্রাথমিক স্তরে পীতজ্বর শনাক্ত করা যায় না। তাই এই অনেকটা অচেনা-অজানা রোগের হাত থেকে বাঁচতে টিকা অর্থাৎ আগাম প্রতিষেধকই একমাত্র ভরসা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র মতে, পীতজ্বরে আক্রান্ত হয়ে বছরে সারা বিশ্বে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ মারা যান।
কিন্তু ওই টিকা মিলছে না কেন? |
ভারতে পীতজ্বর হয় না। তাই একমাত্র হিমাচল প্রদেশের কসৌলির সেন্ট্রাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট (সিআরআই) ছাড়া সরকারি বা বেসরকারি আর কোনও সংস্থা ওই টিকা তৈরি করে না। সিআরআই-এও তিন বছর ধরে পীতজ্বরের টিকা মিলছে না। ওই সংস্থায় যে-মেশিনে টিকা তৈরি হয়, সেটি অচল। সিআরআইয়ের অধিকর্তা সুনীল গুপ্ত বলেন, “যন্ত্রটি সারাতে বিদেশ থেকে যন্ত্রাংশ আনানো হচ্ছে।” অন্য কোনও ভাবে ওই টিকা জোগাড় করা হচ্ছে না কেন?
কলকাতা বিমানবন্দর সূত্রের খবর, সিআরআইয়ের সরবরাহ বন্ধ থাকায় মাঝখানে চিন থেকে ওই টিকা আমদানি করা হচ্ছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার সম্প্রতি তা-ও বন্ধ করে দিয়েছে। এই নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। কলকাতা বিমানবন্দরের স্বাস্থ্য অফিসার প্রকাশচন্দ্র মণ্ডল বলেন, “বেসরকারি একটি সংস্থা এখন ওই টিকা তৈরি করছে বলে কেন্দ্র সম্প্রতি বিভিন্ন বিমানবন্দর-কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে। কেউ ওই টিকা নিয়ে এলে আমরা দেওয়ার ব্যবস্থা করব। শংসাপত্রও দেব।” কিন্তু বেসরকারি সংস্থার টিকাও পাওয়া যাচ্ছে না।
কলকাতায় পীতজ্বরের টিকা কোথায় দেওয়া হয়?
মহানগরের তিনটি জায়গায় ওই টিকা দেওয়া হয়। বিমানবন্দর, খিদিরপুর বন্দর এবং মধ্য কলকাতার ইনস্টিটিউট অফ হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেল্থ। কিন্তু ওই তিন জায়গার কোথাও এখন টিকা নেই। অথচ প্রতিদিন গড়ে ২০-২৫ জন টিকার খোঁজে এসে হতাশ হয়ে ফিরে যান বলে জানাচ্ছেন ওই তিন সংস্থার কর্ণধারেরা। হাইজিন ইনস্টিটিউটের অধিকর্তা গিরিশ পাণ্ডের কথায়, “কসৌলি থেকে কবে টিকা পাওয়া যাবে, সেই বিষয়ে আমিও অন্ধকারে। যে-বেসরকারি সংস্থা পীতজ্বরের টিকা বানায়, তারাও মনে হয় সরবরাহ করতে পারছে না। তাই তিন মাস ধরে সমস্যাটা চলছে।”
কিন্তু টিকা নিতে না-পারলে কি ওই সব দেশে যাওয়া বন্ধই থাকবে?
বিমানবন্দরের স্বাস্থ্য অফিসার বলেন, “টিকা না-নিলেও ওই সব দেশে ঢোকার সময় কোনও সমস্যা হবে না। কিন্তু ওখান থেকে দেশে ঢোকার সময় বিমানবন্দর-কর্তৃপক্ষ ওই শংসাপত্র দেখতে চাইবেন। কেউ তা দেখাতে না-পারলে তাঁকে ছ’দিন বিচ্ছিন্ন অবস্থায় একটি আলাদা ঘরে রেখে পরীক্ষা করার কথা। তার পরে ছেড়ে দেওয়া হয়।”
টিকার অভাবে বিদেশযাত্রীদের কত দিন এ ভাবে হয়রান হতে হবে?
বৃহস্পতিবার একটা সুরাহার কথা শুনিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের ডিরেক্টর জেনারেল অফ হেল্থ সার্ভিস জগদীশ প্রসাদ। তিনি জানান, সিআরআইয়ের যন্ত্র অবিলম্বে সারানো হবে। সেটি না-সারানো পর্যন্ত নিয়মিত টিকা পাওয়ার পথ বাতলেছে হু। প্রসাদ বলেন, “হু চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ফ্রান্স থেকে টিকা জোগাড় করে ভারতে সরবরাহ করবে। ১৫ জুলাইয়ের পরে দেশের সর্বত্র তা পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।” |