‘সত্যকে স্বাভাবিক ভাবে নিতে হয়’
ক সময় যে জেলা ছিল তাঁদের গড়, আজ সেই মাটিতেই ফুটেছে ঘাসফুল। এতটাই যে গোটা জেলায় তাঁদের দলের বিধায়ক সাকুল্যে এক!
নকুল মাহাতোর বাড়ি যে এলাকায়, সেই পুঞ্চার ন’পাড়ায় বছর কয়েক আগে পর্যন্ত লাল পতাকা ছাড়া অন্য কিছু খুঁজে পাওয়াই ছিল মুশকিল। দোর্দণ্ডপ্রতাপ এই সিপিএম নেতার বাড়ির মুখেও এখন হাওয়ায় দোলে ঘাসফুলের পতাকা। তাঁর বাড়িতে যাতায়াতের পথের প্রায় সব দেওয়ালে কাঁচা হাতে লেখা দলবাজি, দুর্নীতির অভিযোগের সাতকাহন। মাঝেমধ্যেই বিকেলে তাঁর বাড়ির সামনে দিয়ে মিছিল যায়। সিপিএমের বিরুদ্ধে পরিবারতন্ত্র, স্বজনপোষণ, দলতন্ত্রের নানা অভিযোগ তুলে স্লোগানে এলাকা কেঁপে ওঠে।
‘পরিবর্তন’ কাকে বলে, তা প্রতিপদে বুঝতে পারছেন নকুলবাবু। তবু, হাল ছাড়তে তিনি রাজি নন। বরং সব দেখেশুনে এক টানা ৪৭ বছর সিপিএমের জেলা সম্পাদক পদে থাকা এই অশীতিপর বৃদ্ধ বলছেন, ‘একেবারেই স্বাভাবিক ব্যাপার’!
এত বছর ধরে জেলা সামলালেন। এত উন্নয়ন করেছেন বলে দাবি করেন। তা হলে আপনার এলাকার মানুষের মধ্যেই এত ক্ষোভ-বিক্ষোভ, অভিযোগ জমল কেন? হাসলেন নকুলবাবু। বললেন, “১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর সিপিএমের জেলা সম্পাদক হয়েছিলাম। ২০১১ সালে ৩১ ডিসেম্বর সেই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়েছি। এত বছরে আমি পরিবারের জন্য ঠিক কতটুকু সময় দিয়েছি, তা আমার অতি বড় শত্রুরাও জানেন। কিন্তু, সকলকে এক সঙ্গে খুশি করা কারও পক্ষে সম্ভব নয় বলেই সমালোচনার লাভাস্রোত বারেবারে আমাদের দিকে ধেয়ে আসে। তার মোকাবিলা করেছি। আগামী দিনেও করার চেষ্টা করব।” প্রত্যয়ী শোনাল তাঁর গলা।

নকুল মাহাতো।
পঞ্চায়েত ভোটের মুখে রাজ্য জুড়ে হানাহানি, হিংসা হলেও পুরুলিয়া ব্যতিক্রম। এই জেলাতেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শাসকদলের জয়ী প্রার্থীর সংখ্যা সবচেয়ে কম। কী এর রহস্য? হাসি ফুটল সিপিএম নেতার মুখে। মনের মতো প্রশ্ন হয়েছে, দৃশ্যতই বোঝা গেল, যখন বললেন, “আর যেথায় যা হোক, এখানে (পুরুলিয়ায়) কথায়-কথায় কংগ্রেস-তৃণমূল-সিপিএমের মধ্যে মারপিট, খুনোখুনি হওয়ার নয়। এখনকার সব দলের নেতা, ছেলেছোকরাদের মনে রাখতে হবে, তাঁদের বাপ-ঠাকুর্দারা একজোট হয়ে লড়ে বিহার থেকে আলাদা হয়ে বাংলায় ঢুকেছিল পুরুলিয়া। সেটা কি ভোলা যায় বটে!”
দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের সময়ে এই একবারই বোঝা গেল, এই নকুল মাহাতো শুধুই সিপিএমের নন। এই তিনি সব দলের। বোঝা গেল, লড়াকু নেতা হিসাবে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা কেন আজও সব দলের কাছে একই রকম।
রঘুনাথপুর মহকুমায় চোরাই কয়লার ব্যবসায় দিনের পর দিন মদত দেওয়ার অভিযোগ ওঠায় দলের একাধিক নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছিলেন এই নকুলবাবু। আবার নিজের মেয়ে (সাম্যপ্যারী মাহাতো) জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ থাকার সময়ে বৈঠকে নিয়মিত না-যাওয়ার খবর পেয়ে ভর্ৎসনাও করেছিলেন। এর পরেও তিনি দলের মধ্যে একাধিক গোষ্ঠীর মাথা চাড়া দেওয়ার বিষয়টি পুরোপুরি আটকাতে পারেননি। সিপিএম সূত্রের খবর, দলের নানা গোষ্ঠীর কোন্দল মেটাতে অতীতে তো বটেই, ‘পরিবর্তন’-এর পরেও আলিমুদ্দিনের নেতাদের হস্তক্ষেপ করতে হচ্ছে।
তাঁর বাড়ির সামনে উড়ছে তৃণমূলের পতাকা।
এ বারের জেলা পরিষদের ৩৮ জন বাম প্রার্থীর মধ্যে ৩৭ জনই নতুন। যদি পুরনোদের গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে, তা হলে পুরনোদের নেতৃত্বে ভোটের প্রচার হচ্ছে কেন? নকুলবাবু বললেন, “পুরনো সব ঝেড়ে ফেলা হয়েছে। আমি কিছু প্রার্থীর নাম বলেছিলাম। তবে, সে কথা থাকুক। কী ভাবে, কোথায় প্রচার হবে, সে ব্যাপারে পার্টিই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমাকেও কিছু জায়গায় যেতে হচ্ছে।”
নকুল মাহাতো মানেই অতীতের এত ঘটনা, যে স্মৃতিচারণা ছাড়া তাঁর সাক্ষাৎকার সম্ভব নয়। সেই সূত্রেই তিনি মানভূম জেলার হাল-হকিকতের বর্ণনা করেছেন। জেলায় সেই সময়ে হাইস্কুলের কেমন সমস্যা ছিল, তা বলতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছেন। ধীরে ধীরে জেলায় কী ভাবে স্কুল-কলেজে গড়ার কাজ হল, তা দিন-তারিখ দরে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। বাম আমলের শেষার্ধে সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার লড়াইয়ে জিতলেও বাঁকুড়া জেলা সিপিএমের আপত্তিতে সেখানকার কলেজগুলিকে এক ছাতার তলায় আনতে না-পারার দুঃখটা যে এখনও তাঁর যায়নি, সেটাও বুঝিয়ে দিয়েছেন। আবার শিক্ষা-স্বাস্থ্য বিষয়ক কাজকর্ম কিছু করতে পারলেও শিল্প গড়ার জায়গা হিসেবে পুরুলিয়া যে মহাকরণের সুনজরে তেমন ভাবে কখনওই পড়েনি, সেই আক্ষেপটাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন।
সাড়ে চার দশকের বেশি সময় ধরে পার্টির কর্তৃত্বে থেকেছেন। জেলার আড়াই হাজারের গ্রাম হেঁটে ঘুরেছেন। লোকসেবক সঙ্ঘ, কংগ্রেসের দূর্গ ধূলিসাৎ করে লাল পতাকায় ছেয়ে দিয়েছেন। ধীরে ধীরে বলরামপুর, বান্দোয়ান, অযোধ্যা পাহাড়, বাঘমুণ্ডির বিস্তীর্ণ এলাকা মাওবাদীদের দখলে চলে গিয়েছে। ঝালদা ও লাগোয়া এলাকায় ক্রমশ শক্তিশালী হয়েছে কংগ্রেস। অন্যত্র সিপিএমের লোকজন দলে দলে ভিড়েছেন তৃণমূলের দিকে। আগামী দিনে জেলা পরিষদও দখলের স্বপ্ন দেখছে তৃণমূল। কী বলবেন?
তখন সন্ধ্যা নামছে। উঠোনময় ছোটাছুটি করা বাছুরগুলিকে গোয়ালে বাঁধার নির্দেশ দিলেন নাতিকে। সপ্তম পার্টি কংগ্রেস থেকে একনাগাড়ে ২০১১ সাল অবধি পার্টি কংগ্রেসে যিনি রাজ্য কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধি ছিলেন, সেই নকুলবাবু বললেন, “সত্যকে স্বাভাবিক ভাবে নিতে হয়। আমি ছোট থেকে লড়াই করে বাঁচছি। আমৃত্যু লড়াই করে যাব। আমিও তো অতীতে ভোটে হেরেছি। একটা দুটো ভোটে হারজিত দিয়ে সব কিছুর বিচার করা যায় নাকি! ”

—নিজস্ব চিত্র



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.