হাইকোর্টের রায় শোনার পরে অনিশ্চয়তার কালো মেঘ যে কেটে গিয়েছে তা কুমকুম মণ্ডলের মুখ দেখলেই বোঝা যাচ্ছিল। বললেন, “মাথার উপর থেকে ভারী বোঝা নামল। হেরে গেলে পথে বসা ছাড়া উপায় ছিল না। বকেয়া টাকাগুলো পেলে সংসারের খুব উপকার হবে।”
|
লড়াকু। কুমকুম মণ্ডল। |
২০১১ সালের ২০ অগস্ট বসিরহাটের বিদ্যাসাগর অ্যাকাডেমি হাইস্কুলে চতুথর্র্ শ্রেণির কর্মী হিসাবে কাজে যোগ দিয়েছিলেন কুমকুম দেবী। বেতন ঠিক হয়েছিল ১০ হাজার ৭০০ টাকা। কিন্তু অবৈধ নিয়োগের অভিযোগ তোলেন পরিচালন সমিতির দুই সদস্য হারান মণ্ডল ও জব্বল আলি। আদালতে যান তাঁরা। এই অবস্থায় জেলা স্কুল পরিদর্শকের অফিস থেকে কুমকুমদেবীর চাকরির অ্যাপ্রুভাল আসতে কয়েক মাস কেটে যায়। এ নিয়ে অনেক ঘোরাঘুরির পরে ২০১২ সালে ২৫ ডিসেম্বর তাঁর অ্যাপ্রুভাল আসে। কিন্তু তার পরেও নানা কারণ দেখিয়ে তাঁর বেতন আটকে দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ। টানা দু’ বছর ধরে বেতন না পাওয়ায় কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করেন কুমকুম দেবী। মঙ্গলবার বিচারপতি দেবাশিস করগুপ্ত রায় দেন, আগামী ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে ওই অশিক্ষক কর্মীর বেতন বাবদ পাওনা টাকা ৯ শতাংশ সুদ সহ মিটিয়ে দিতে হবে। সুদের টাকা কেটে নিতে হবে প্রধান শিক্ষকের বেতন থেকে। বাদুড়িয়ার উত্তর জঙ্গলপুরে বাসিন্দা কুমকুম দেবীর স্বামী আমিরুল মণ্ডল দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ। মেয়ে সোহানা পারভিন একাদশ ও ছেলে সায়ন মণ্ডল চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। কুমকুম দেবীর কথায়, “অনেক কষ্টে চাকরিটা পেয়েছিলাম। কিন্তু কাজে যোগ দেওয়ার পরে আমাকে নিয়ে টানাহেঁচড়া শুরু হয়। বেতন আটকে যাওয়ায় বহু বার প্রধান শিক্ষক, জেলা স্কুল পরিদর্শকের হাতেপায়ে ধরেছি। কেউ কথা শোনেননি। শেষে সহকর্মীদের পরামর্শে আদালতের শরণাপন্ন হই। মামলা লড়ার জন্য শ্বশুরমশাই জমি বেচে টাকা দিয়েছিলেন আমাকে। ঠিক করেছিলাম আর কান্নাকাটি করে নয়, লড়ে অধিকার আদায় করব।”
স্কুলেরই কিছু সহকর্মী জানান, স্কুলে চতুর্থ শ্রেণির কর্মী নিয়োগে পরিচালন কমিটির কয়েকজন সদস্যের দাবি ছিল স্থানীয় কোনও প্রার্থীকে ওই চাকরি দেওয়া হোক। সম্ভবত সেই কারণেই কুমকুমদেবীর সঙ্গে এই আচরণ।
তাঁর বিরুদ্ধে বেতন বন্ধের অভিযোগ নিয়ে কিছুটা বিস্মিত প্রধান শিক্ষক গৌরহরি ঘরামি। তিনি বলেন, “বেতন দেওয়ার অধিকার আমার নেই। বিষয়টি দেখেন স্কুলের পরিচালন কমিটির সম্পাদক হারাণ মণ্ডল। কমিটির সদস্য থাকাকালীন তিনি কুমকুমদেবীর নিয়োগ অবৈধ বলে অভিযোগ তুলে আদালতে যান। তাঁকে এবং স্কুল পরিদর্শককে কুমকুমদেবীর বেতন মিটিয়ে দিতে অনুরোধ করি। কিন্তু মামলা না মেটা পর্যন্ত বেতনের বিষয়টি ভাবা সম্ভব নয় হসে জানান হারাণবাবু।” তাঁর আরও বক্তব্য, সংবাদপত্রে পড়ে তিনি জেনেছেন, রায়ে তাঁকে দোষী করা হয়েছে। কেন তা বুঝতে পারছেন না। আদালতের রায়ের কপি পেলে আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে পরবর্তী পদক্ষেপ করবেন।
আর হারানবাবুর বক্তব্য, “আমরা নিয়োগের বিরুদ্ধে নই। কিন্তু কুমকুমদেবীর নিয়োগে অনিয়ম ধরা পড়ে। চতুর্থ শ্রেণির কর্মীর ওই পদটি এসসি-র জন্য সংরক্ষিত হলেও আনি না মেনে পদটিতে সাধারণ প্রার্থী নিয়োগ করা হয়। তা ছাড়া কুমকুমদেবীর অ্যাপ্রুভাল রেজিস্টারের কোনও নম্বর জেলার অতিরিক্ত স্কুল পরিদর্শকের দফতরে মেলেনি। তাই আদালতে যাই।”
জেলা স্কুল পরিদর্শক অমর শীল বলেন, “হাইকোর্টের নির্দেশ যাতে এ মাসেই কার্যকর হয় তা দেখার জন্য অতিরিক্ত স্কুল পরিদর্শককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি প্রধান শিক্ষকও যদি নির্দেশ না মানেন তাহলে তাঁর বেতন বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। স্কুলের পরিচালন কমিটির সম্পাদকের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মধ্যশিক্ষা পর্ষদের কাছে লিখিত আবেদন করা হয়েছে।” |