স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি যে, এমনটা হতে পারে! দিনে-দুপুরে, এক রাস্তা লোকের চেখের সামনে!
বুধবার বিকেল তখন পাঁচটা হবে। ব্যারাকপুর থেকে বাড়ি ফিরছিলাম। মানে, নোয়াপাড়ার লকগেটে। আমাদের মারুতি গাড়িটা চালাচ্ছিল আমার খুড়তুতো ভাই অভীক।
ওর পাশে বসেছিল জ্যাঠতুতো ভাই রণজিত। পিছনে আমি।
খোশগল্প করতে করতে যাচ্ছিলাম। তাল কাটল নোয়াপাড়ার কাছে সুকান্তপল্লিতে এসে
দেখি, রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে স্কুলের কয়েকটি মেয়ে। আর তাদের পাশে-পাশে যাচ্ছে একটা লাল মোটরবাইক। তাতে বসা দু’টো ছেলে। মেয়েগুলিকে ক্রমাগত উত্ত্যক্ত করছে। কুৎসিৎ অঙ্গভঙ্গি তো আছেই, এমনকী বার বার ওদের সামনে গিয়ে পথ আটকে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। এমন এঁকে-বেঁকে মোটরবাইক চলছে যে, রাস্তায় অন্য লোকজনও ঠিকঠাক হাঁটতে পারছে না। তবে দেখলাম, ছেলে দু’টোর কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। কারণ, ওদের কেউ কিছু বলছে না!
আমাদের গাড়িও ঠিক মতো এগোতে পারছিল না। অভীক তাই হর্ন দিতে থাকে। আর তাতেই ক্ষেপে ওঠে মোটরবাইকের দুই সওয়ারি। মেয়েদের থেকে নজর সরিয়ে ওরা মোটরবাইক রাস্তার পাশে দাঁড় করাল। তার পরে তেড়ে এল আমাদের গাড়ির দিকে। এক জন বনেটে চাপড় মেরে জানলা দিয়ে মুখ গলিয়ে নোংরা গালি দিয়ে বলল, ‘‘জানিস আমি কে? দেখ, কোমরে কী গোঁজা আছে। রাস্তায় ফেলে একদম জানে মেরে দেব! কোনও বাপ বাঁচাতে পারবে না।’’ বুঝতে পারলাম, ওর কোমরে পিস্তল গোঁজা। ভয়ে তখন আমাদের হাড় হিম। তা-ও আমি ওকে বলেছিলাম, “এ ভাবে কথা বলছ কেন? মোটরবাইক রাস্তায় বার বার দাঁড় করাচ্ছিলে বলে সবার অসুবিধে হচ্ছিল। এখন তো ওটা সরিয়েছ।
মিটে গিয়েছে।” |
(বাঁ দিক থেকে) রিকি, রণজিত ও অভীক। রণজিত পেটে অস্ত্রোপচারের দাগ দেখাচ্ছেন,
দুষ্কৃতীরা যেখানে মেরেছে বলে অভিযোগ। বৃহস্পতিবার নোয়াপাড়ার বাড়িতে। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায় |
যে-ই না বলা, আমাকে ওরা টেনে গাড়ি থেকে নামাল। শুরু হল বেধড়ক মার। সঙ্গে অশ্রাব্য গালিগালাজ। মারতে মারতে আমাকে রাস্তার ধারের নর্দমায় ফেলে দিল। আমাকে বাঁচাতে গিয়ে দু’ভাইও খুব মার খেল। শেষে এক ভদ্রলোক ছুটে এসে ছেলেগুলোকে আটকালেন। কথা শুনে বুঝলাম, তিনি ওদের চেনেন। তিনিই আমাদের ওখান থেকে বার করে দিলেন। মারের চোটে তখন আমার হাত থেকে রক্ত ঝরছে। ভাইদের মুখ ফুলে গিয়েছে। রণজিতের পেটে অপারেশন হয়েছিল। তার উপরে মেরেছে। চেনা ডাক্তারবাবুকে দেখিয়ে সন্ধে নাগাদ নোয়াপাড়া থানায় গেলাম নালিশ লেখাতে। জানতাম না, ওখানে আরও ভোগান্তি আমাদের অপেক্ষায়।
থানায় আইসি ছিলেন না। এক অফিসারকে সব খুলে বলার পরে উনি আমাদের বসতে বললেন। প্রায় চার ঘণ্টা বসিয়ে রেখে আমাদের বলা হল অভিযোগ লিখে দিতে। প্রথমে যা লিখলাম, তা পড়ে অফিসার বললেন, ‘‘এ ভাবে অভিযোগ হয় না। ঠিক করে লেখো।’’ আবার লিখলাম। সেটাও বাতিল করে দিলেন। বার বার এমন হতে থাকায় বাধ্য হয়ে বললাম, ‘‘আপনারাই বলে দিন, কী ভাবে লিখব।’’
শেষে ওঁরই কথা মতো অভিযোগ লিখে জমা দিলাম। নোয়াপাড়া থানার অফিসারটি সেই অভিযোগ নিলেন নেহাতই দায়সারা ভাবে। ওঁকে বলেছিলাম, এফআইআর করতে চাই। তা হল না। আমাদের হাতে জেনারেল ডায়েরি (জিডি)-র নম্বর লেখা একটা টুকরো কাগজ ধরিয়ে দেওয়া হল। আমার হাত দিয়ে তখনও রক্ত ঝরছে। থানার আর এক অফিসার পরামর্শ দিলেন, “হাসপাতালে চলে যান।” নিজেরাই ব্যারাকপুর মহকুমা হাসপাতালে গেলাম।
পুলিশ সম্পর্কে ছোট থেকে অনেক গল্প শুনে আসছি। পুলিশের ক্ষমতা সম্পর্কে অন্য রকম ধারণাও ছিল। কিন্তু এক সন্ধের মধ্যে সব পাল্টে গিয়েছে। প্রতিকারের আশা নিয়ে থানায় গিয়ে মনে হয়েছে, পুলিশ আমাদের জন্য নয়। তাই বোধহয় আমাদের অভিযোগ কোনও গুরুত্ব পেল না। এ-ও টের পেলাম, ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল এখন দুষ্কৃতীদের মুক্তাঞ্চল।
নিজের বাড়ির আশপাশই যে এতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে, এত দিনে সেটা মালুম হল! |