প্রতিবাদী নিহত হয়েছেন। কিন্তু নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জারি রাখতে একজোট হয়েছেন সুটিয়ার বহু মহিলা।
কামদুনি থেকে গাইঘাটা যেখানেই নারী নির্যাতনের ঘটনা সামনে আসছে সেখানেই ছুটছেন ওই মহিলারা। নির্যাতিতা বা তাঁদের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে। তাঁদের সাহস জোগাতে।
সেই সুটিয়া, যেখানে ২০০০-২০০৩ সাল পর্যন্ত একের পর এক গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল। একই সঙ্গে ছিল শ্লীলতাহানি, খুন, তোলাবাজি। যে নারকীয় ঘটনার অন্যতম সাক্ষী ছিলেন সুটিয়ার বরুণ বিশ্বাস। ঘটনার প্রতিবাদে গড়া ‘প্রতিবাদী মঞ্চ’-এর সম্পাদকও ছিলেন তিনি। গত বছর ৫ জুলাই গোবরডাঙা রেল স্টেশনের কাছে দুষ্কৃতীদের গুলিতে খুন হন শিয়ালদহের মিত্র ইনস্টিটউশন (মেন)-এর বাংলার শিক্ষক, বছর আটত্রিশের বরুণ।
এক বছর পরে আজ, শুক্রবার বরুণের মৃত্যুবার্ষিকী। বরুণ-হত্যা মামলায় সিআইডি তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে অসন্তোষ জমেছে সুটিয়ায়। মূল চক্রীরা এখনও অধরা বলে ক্ষোভ রয়েছে গ্রামবাসীদের। কিন্তু তার জন্য দমে যেতে রাজি নন গ্রামের মহিলারা। দলে দলে তাঁরা যোগ দিয়েছেন ‘প্রতিবাদী মঞ্চ’-এ। মঞ্চ গড়ে উঠেছিল ২০০২ সালের ১ অগস্ট। সেই সময়ে ১৫০ জন সদস্যের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি ছিলেন মহিলা। আর বরুণ খুন হওয়ার পরে মঞ্চের সদস্যসংখ্যা ছাড়িয়েছে পাঁচশোরও বেশি। মহিলার সংখ্যা ২৫০ জন। এই মহিলাদের মধ্যে যেমন রয়েছেন সুটিয়া গণধর্ষণ কাণ্ডের নির্যাতিতারা, তেমনই রয়েছেন সাধারণ মহিলারাও। |
মঞ্চের সভাপতি ননীগোপাল পোদ্দার বলেন, “বরুণ-খুনের পরে সংগঠনের কাজে আরও গতি এসেছে। মহিলারা আরও সক্রিয় হয়েছেন। মঞ্চের যাবতীয় কর্মসূচিতে মহিলারাই এখন নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আমরা পাশে থেকে তাঁদের সাহায্য করছি।”
আজ বরুণের স্মরণসভা অনুষ্ঠানেরও মূল উদ্যোক্তা মঞ্চের মহিলা সদস্যেরাই। এ জন্য বৃহস্পতিবারই পার্বতী বিশ্বাস নামে এক বৃদ্ধা সদস্য সকালে স্নান সেরে বেরিয়ে পড়েছিলেন অর্থ সংগ্রহে। অবশ্য শুধু পার্বতীদেবীই নন, ছোট দলে ভাগ হয়ে তাঁর মতো পথে নেমেছিলেন আরও অনেকে। তাঁরা বরুণের স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে চান। বরুণের আদর্শ, কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে হবে এটাই তাঁদের পণ। এ জন্য মাইক-প্রচারও চলছে জোরকদমে।
মঞ্চের মহিলা শাখার সভানেত্রী প্রমীলা রায় নিহত বরুণের দিদি। তিনি বলেন, “সামাজিক অত্যাচার, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে ভাইকে খুন হতে হয়েছে। তার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমরা এগিয়ে চলব।” মঞ্চের মহিলা শাখার আর এক সভানেত্রী শোভা বাগচী বলেন, “শুধু সুটিয়ার মধ্যে আমরা নিজেদের আবদ্ধ না রেখে রাজ্যের যেখানেই মহিলা নির্যাতন হবে, সেখানে গিয়েই নির্যাতিতাদের পাশে দাঁড়াব। নিজেদের অভিজ্ঞতা নিয়ে সেখানকার মানুষের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করার সাহস দেওয়ার চেষ্টা করব।”
বরুণ শুধু নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ জানাননি, তাঁর সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রমাণও রেখে গিয়েছেন সুটিয়ায়। তিনি অর্থাভাবে চিকিৎসা করাতে না পারা মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। দুঃস্থ ছাত্রছাত্রীদের বই কিনে দিয়েছেন। বরুণের মৃতদেহ ছুঁয়ে মহিলারা তাঁর সেই আদর্শ টিকিয়ে রাখতে শপথ নিয়েছিলেন এক বছর আগে। তা আজও ভোলেননি তাঁরা। বরুণের মতো মঞ্চের মহিলারাও এখন গরিব মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন।
সুটিয়ার ঘটনায় এক নির্যাতিতা এখন একটি দোকানে সেলাইয়ের কাজ করেন। তিনি বলেন, “বরুণ শিখিয়েছে দারিদ্র থাকলেও সামাজিক অসম্মানের বিরুদ্ধে কী ভাবে লড়াই করা যায়। আমরা সেটাই করছি। তবে, তার খুনিদের এখনও সাজা হল না এটা মেনে নিতে পারি না।”
একটি খুনের ঘটনা সুটিয়ায় মহিলাদের শিখিয়েছে সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে অন্যায়ের বিরোধিতা করতে।
|