স্ত্রী, শ্যালিকা ও অন্য আত্মীয়াদের ডুলিতে বসিয়ে অভয় দিয়েছিলেন দীর্ঘদেহী মানুষটি। তোমরা এসো, আমি এগোচ্ছি এই বলে তরতরিয়ে নীচে নামছিলেন তিনি।
দেখে কে বলবে বয়স ৬২ পেরিয়ে গিয়েছে। ষাটের দশকে ময়দানের পরিচিত মুখ, ইস্টার্ন রেলের সাইড ব্যাক হেমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ওরফে মংলা যেন এগোচ্ছিলেন বৃষ্টিকে ডজ করতে করতে। কেদার থেকে গৌরীকুণ্ডে নামার পথে তিনি সঙ্গীদের বলেন, “সাবধানে নামো! নীচে দেখা হবে!” তরতাজা সেই মানুষটাই যেন কর্পূরের মতো উবে গিয়েছেন।
হেমেনবাবু একা নন। তাঁর বড় শ্যালকের স্ত্রী কৃষ্ণা সাহা ও ছোট শ্যালিকা মালা রায়েরও কোনও হদিশ নেই।
সেটা ছিল ১৬ জুনের সকাল। কাকভোরে ঝমঝমে বৃষ্টি দেখেও কেদারে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের আশ্রমে আটকে থাকতে চাননি হেমেনবাবুরা। হেমেনবাবু, তাঁর স্ত্রী ভারতীদেবী ও শ্বশুরবাড়ির আত্মীয় মিলিয়ে সাত জনের দলটার তীর্থভ্রমণের পরিকল্পনা আগে থেকেই ছকে রাখা ছিল। ৮ জুন হাওড়া থেকে কুম্ভ এক্সপ্রেসে হরিদ্বার রওনা দিয়েছিলেন তাঁরা। সেখান থেকে বদ্রীনাথ, তুঙ্গনাথ ঘুরে গৌরীকুণ্ড। তার পরে কেদারনাথ-দর্শন সেরে ফের হরিদ্বার নামার কথা ছিল তাঁদের। কিন্তু কালান্তক বৃষ্টি আর জলোচ্ছ্বাসই সব ওলট-পালট করে দিল।
যাদবপুরের বিজয়গড় কলোনির বাড়িতে বসে ‘মংলাদা’র ছোট শ্যালক সৃজনকুমার সাহা বলছিলেন, গৌরীকুণ্ডের দিকে নামার সময়ে ঠিক মাঝামাঝি রামওয়াড়া অবধি পৌঁছেই থমকে যেতে হয়। ডুলিরা হঠাৎ মহিলাদের নামিয়ে দিয়ে বলে, আর যাব না সামনে বিপদ! তখন বিকেল হব-হব! “মংলাদা, আমার ছোট বোন (মালা) ও বড়বৌদি (কৃষ্ণা) খানিকটা এগিয়ে গিয়েছিল। মোবাইলে নেটওয়ার্ক নেই। সন্ধেয় কোনও মতে একটা চায়ের দোকানে ঢুকেও ভাবছিলাম, কাল সকালে গৌরীকুণ্ডে নেমে নিশ্চয়ই সবার দেখা পাব,” বলছেন সৃজনবাবু।
|
চায়ের দোকানে গরম জল, কম্বল-টম্বলও পেয়েছিলেন সৃজনবাবুরা। কিন্তু মাঝরাত্তিরেই বিপদ-সঙ্কেত। বয়স্কদের দলটাকে নিয়ে পড়ি-কী-মরি করে তিন কিলোমিটার চড়াই ভেঙে পাহাড়ে উঠতে হল। এর পরে তিন দিন-তিন রাত মাথার উপরে খোলা আকাশ। খাদ্য-পানীয় জোটেনি ছিটেফোঁটা। কনকনে ঠান্ডা, অবিরাম বৃষ্টির মধ্যে শুধু পাহাড় থেকে পাথর খসার শব্দ ও উত্তাল মন্দাকিনীর গর্জন।
চার দিন পরে, ১৯ জুন সকালে কপ্টার থেকে খাবারের প্যাকেট ফেলেন সেনাবাহিনীর জওয়ানরা। সঙ্গে একটা চিরকুটে নির্দেশ, ‘আপানারা ভীমওয়াড়ায় আসুন।’ সৃজনবাবু বলছিলেন, নিরাশ্রয় জনতার পিছু-পিছু ভীমওয়াড়া অবধি পৌঁছনোর অভিজ্ঞতাও একটা বিভীষিকা! “সুতোর মতো সরু, প্রায় ঝুলন্ত রাস্তা। চারিদিকে ছড়িয়ে শুধু লাশ। নীচেই ফুঁসছে মন্দাকিনী। কোনও মতে পা টিপে টিপে আড়াই কিলোমিটার পথ পেরোতে হল!” সৃজনের স্ত্রী সাধনা বলছিলেন, নামার পথে রামওয়াড়া, ভীমওয়াড়ার দৃশ্যও ভয়ঙ্কর। “ওপরে ওঠার সময়ে যে জনপদ দেখেছিলাম, জমজমাট বাজার দেখেছিলাম, নামার সময়ে দেখি তার কিচ্ছু নেই। জলের তোড়ে সব নিশ্চিহ্ন!”
সৃজন বলতে থাকেন, “ভীমওয়াড়ার পথে আরও একটা রাত মন্দাকিনীর ধারে কাটাতে হয়। তার পর সেনা কপ্টার আমাদের উদ্ধার করে গুপ্তকাশীর ত্রাণ-শিবিরে নামিয়ে দেয়।” কিন্তু মংলাদা, ছোট বোন মালা বা বড়বৌদি কৃষ্ণা, কারও কোনও খোঁজ মেলেনি।
বাড়ি ফিরলেও হেমেন্দ্রনাথের স্ত্রী ভারতীদেবী যেন থম মেরে গিয়েছেন। দু’বছর আগে রেলের চাকরি থেকে অবসর নেওয়া হেমেনবাবু আগে বিজয়গড় ও অরবিন্দ নগরেও থেকেছেন। ফুটবলের সুবাদে পাড়ায় তিনি বরাবরই জনপ্রিয়। ‘মংলাদা’ ছাড়া আড্ডা, ক্যারামের আসর যেন পান্সে। বিজয়গড়ের সমীর চক্রবর্তী হেমেনবাবু ও তাঁর আত্মীয়দের সবারই পরিচিত। তিনি বলছিলেন, “নিখোঁজ তিন জন খুবই মিশুকে স্বভাবের। এই তো সে-দিন হাসতে-হাসতে সবাই বেড়াতে গেলেন!” আর হেমেনবাবুর প্রতিষ্ঠিত যাদবপুর এক্স-ফুটবলার্স অ্যাসোসিয়েশনের কর্তা উৎপল গুহের কথায়, “এক-এক জন মানুষ থাকেন, চুপচাপ স্বভাবের। কিন্তু তাঁদের উপস্থিতির মধ্যেই একটা জোর থাকে। মংলাদা তেমনই এক জন মানুষ।”
নিখোঁজ পরিজনদের ছবি নিয়ে হেমেনবাবুর দুই জামাই এখন হরিদ্বারে পড়ে রয়েছেন। যদি কোনও খোঁজ মেলে। |