ধর্মতলা মোড়
রাত প্রায় পৌনে ১১টা। শহরের প্রাণকেন্দ্রে ধর্মতলা বাসস্ট্যান্ডের সামনে অসংখ্য যাত্রী। সকলেরই গন্তব্য হাওড়া স্টেশন। টানা আধ ঘণ্টা দাঁড়িয়েও বাসের দেখা নেই। বেশ কিছুক্ষণ পরে ডোরিনা ক্রসিংয়ের দিক থেকে একটি ম্যাটাডর আসতেই তার পিছনে ছুটলেন অন্তত একশো জন। ম্যাটাডরের চালকের কেবিন থেকে মুখ বাড়িয়ে খালাসি হাঁকছেন, “হাওড়া ১০ টাকা। উঠে পড়ুন। না হলে হেঁটে চলুন।” চোখের নিমেষে গাদাগাদি ভিড় হয়ে গেল ম্যাটাডরে। আরও কয়েক জন চালকের কেবিনে উঠে পড়লেন। গাড়ি ধরার ভিড়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন ব্যান্ডেলের সুগত বসু। বললেন, “রোজ একই সমস্যা। আর ভাল লাগে না। রাত হলেই বাস বন্ধ। কিছু একটা না পেলে শেষ ট্রেনটাও মিস করব!”
ধর্মতলা বাসস্ট্যান্ড চত্বরে তখন ঝাঁট দিচ্ছেন সাফাইকর্মীরা। সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাসগুলোর মধ্যে রয়েছে হাওড়াগামী অনেক বাসই। কিন্তু তাতে তখন বাসকর্মীদের ঘুমের তোড়জোড়! |
ডোরিনা ক্রসিং
রাত সাড়ে ১০টা। সার দিয়ে দাঁড়িয়ে ট্যাক্সি। কিন্তু পছন্দের রুট ছাড়া অন্য কোথাও বা মিটারে যাবে না কেউ। এক ট্যাক্সিচালক আচমকাই হাঁকতে শুরু করলেন, “টালিগঞ্জ-বাঁশদ্রোণী ২০ টাকা। চলে আসুন। ছেড়ে দেব। বাস কম।” সঙ্গে সঙ্গেই হুড়মুড়িয়ে দৌড়লেন জনা দশেক। রীতিমতো লড়াই করে সেই ট্যাক্সিতে কোনও মতে জায়গা হল ছ’জনের।
এক ট্যাক্সিচালক বলেন, “মিটারে টালিগঞ্জ গেলে বড়জোর ৮০/৯০ টাকা পাব। কিন্তু ছ’জনকে নিয়ে গেলে ১২০ টাকা রোজগার।” স্ত্রী ও ছোট ছেলেকে নিয়ে নিউ মার্কেটে এসেছিলেন বাঁশদ্রোণীর বাসিন্দা পল্লব সরকার। প্রায় এক ঘণ্টা দাঁড়িয়েও বাস পাননি। অগত্যা ট্যাক্সির খোঁজ। প্রথমটায় জায়গা না পেয়ে পরের ট্যাক্সিতে উঠতে-উঠতেই বললেন, “বাস কখন আসবে কেউ জানে না। তাই বেশি ভাড়া লাগলেও ট্যাক্সিই ভরসা।” ট্যাক্সি ছেড়ে দিতেই পিছনে এসে দাঁড়াল নাকতলা-হাওড়া রুটের মিনিবাস। তার তখন বাদুড়-ঝোলা অবস্থা।
ধর্মতলা-লেনিন সরণি
রাত সাড়ে ১০টা। টিপু সুলতান মসজিদের সামনের দোকানগুলির ঝাঁপ এক এক করে বন্ধ হচ্ছে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রাস্তায় বাসের জন্য অপেক্ষমাণ যাত্রীর সংখ্যা। কেউ অফিস থেকে ফিরছেন, কেউ বা নিউ মার্কেট থেকে। কিন্তু শিয়ালদহ, পার্ক সার্কাস, বেলেঘাটা, তপসিয়া, সিআইটি, মৌলালির দিকে যাওয়ার বাস মিলছে না। বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে বিজ্ঞাপন সংস্থার কর্মী সমিত ঘোষ বললেন, “রাত ১১টা পর্যন্ত শিয়ালদহগামী বাস পাওয়া গেলেও অন্য রুটের বাস সাড়ে ৯টা বাজতেই উধাও।” অগত্যা শিয়ালদহ পৌঁছে তার পরে আবার পার্ক সার্কাস পৌঁছতে হবে, জানালেন তিনি।
ভিক্টোরিয়া হাউস
রাত ১০টা। রাস্তার ধারে হাতে গোনা কয়েকটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে। কেউই উত্তরের দিকে যেতে রাজি নয়। অগত্যা রাস্তায় বাসের অপেক্ষায় কয়েক জন যাত্রী। বেশ কিছুক্ষণ পরে একটা সরকারি বাস এল বটে, কিন্তু তাতে চাহিদা মিটল না। কয়েক জন সেই বাসে উঠে গেলেও বাকিরা দাঁড়িয়েই রইলেন। কারণ, ওই বাসটি শ্যামবাজারের পরে আর যাবে না। বাধ্য হয়েই স্ত্রী-মেয়েকে নিয়ে ধর্মতলা মোড়ের দিকে এগিয়ে গেলেন ডানলপের বাসিন্দা শ্যামল পণ্ডিত। বললেন, “এটাই পরিবহণ ব্যবস্থা!” অফিস-ফেরত আর এক যাত্রীর অভিযোগ, “রাতে বাস একেই কম থাকে। তাতে আবার চাঁদনি চক থেকে শ্যামবাজার যেতেই বাসগুলো প্রায় এক ঘণ্টা লাগিয়ে দেয়!”
উল্টোডাঙা মোড়
রাত ১০টা বেজে গিয়েছে। বেলঘরিয়ার বাসিন্দা সৌমিত্র গুহ যাবেন যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনের কাছে একটি বেসরকারি হাসপাতালে। আধ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থেকে বাধ্য হয়েই অটোয় উঠে বসলেন। পাঁচ জন যাত্রী না হলে সেই অটোও আবার ছাড়বে না। অগত্যা ফের মিনিট পনেরো অপেক্ষার পরে হাসপাতালের দিকে রওনা দিতে পারলেন তিনি। |
এক দিকে বিধাননগর রোড স্টেশন, ভিআইপি রোডমুখী দুর্গাপুর ব্রিজের ওঠার মুখ, অন্য দিকে হাডকো মোড়ে ছবিটা একই। সময় যতই গড়িয়েছে, ততই কমেছে বাসের সংখ্যা। চার মাথার মোড়ের চার দিকে অটো আর ট্যাক্সির সারি। এক দিকে ডানলপ, বারাসত। অন্য দিকে গড়িয়ামুখী শাট্লের রমরমা। এমনকী, বিধাননগর রোড স্টেশন থেকে সরাসরি অটোও যাচ্ছে। যাত্রীদের অভিযোগ, বাস কমে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে ৩৫-৪০ টাকার শাট্ল, ২৫-৩০ টাকা অটো ভাড়া দিয়ে যাতায়াত করতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা। এমনকী, স্বল্প দূরত্বে অটোর ভাড়াও রাত দশটার পরে বেড়ে যায়।
ঘড়ির কাঁটা রাত ১০টা পেরোলে হাতে গোনা বাসের দেখা যাও বা মেলে, তার মধ্যে কার্যত সরকারি বাস নেই বললেই চলে। একটি বেসরকারি রুটের চালক পাল্টা দাবিতে বলেন, যাত্রী মেলে না। রাতে সাড়ে দশটা পর্যন্ত বাস চলে। তবে সংখ্যা কমে যাওয়ায় একই রুটের দু’টি বাসের মধ্যে সময় বাড়িয়ে দিতে হয়েছে। উপরন্তু, শাট্ল ট্যাক্সি আর অটোরিকশার জন্য যাত্রীও কমে যাচ্ছে। বিধাননগর রোড স্টেশন স্টপে ৪০ মিনিট দাঁড়ানোর পরে ডানলপের শাট্ল ট্যাক্সিতে উঠে পড়ে আড়িয়াদহের বাসিন্দা গৌতম বসু বললেন, “একটা বাস চলে গেলে পরেরটা যে কখন আসবে, জানা নেই। বাধ্য হয়ে শাট্ল গাড়ি ধরতে হচ্ছে।”
গড়িয়াহাট মোড়
রাত তখন প্রায় পৌনে ১০টা। অফিস-বাজার ফেরত যাত্রীরা দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তাঁদের বেশির ভাগই মহিলা। কিন্তু সরকারি বাস দূরের কথা, আধ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে তিন-চারটির বেশি বেসরকারি বাসের দেখাও মেলেনি। তাতেও বেজায় ভিড়। রাত বাড়তেই বাস উধাও হয়ে যাওয়ার এই সুযোগটাই নিচ্ছেন অটো আর ট্যাক্সির চালকেরা।
গড়িয়াহাট থেকে রুবি মোড়, সাত টাকার ভাড়া বেড়ে তখন হয়ে গিয়েছে ১০ টাকা। তাতেও লাইন কম নয়। ট্যাক্সিওয়ালারাও সামান্য দূরত্ব যেতে মিটারের উপরে অন্তত ২০ টাকা করে বেশি হাঁকছেন।
দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করেও বাস না পেয়ে অগত্যা বেশি ভাড়াতেই বাড়ি ফিরছেন মহিলা-সহ অন্য যাত্রীরা। এমনই এক জন মঞ্জুশ্রী সেনগুপ্তের কথায়, “বাস মিলছে না বলেই অটো-ট্যাক্সিতে বেশি ভাড়া গুনতে হচ্ছে।” |
রুবি মোড়
রাত সওয়া ন’টা। গড়িয়ার দিকে যাওয়ার ভিড়টা ক্রমশ বাড়ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দু’একটা বেসরকারি বাস এল। কিন্তু ভিড়ের চোটে তাতে ওঠাই দায়। সরকারি বাস প্রায় নেই বললেই চলে। একই অবস্থা উল্টোডাঙামুখী যাত্রীদেরও।
বাস কম থাকায় ট্যাক্সিওয়ালারাও তখন মিটারের ভাড়ার উপরে অন্তত কুড়ি-তিরিশ টাকা বেশি হাঁকছেন। বাড়ি ফেরার তাড়ায় বাধ্য হয়ে তাতেই রাজি হয়ে যাচ্ছেন যাত্রীরা। অনেকে দল বেঁধে শাট্ল-এর ব্যবস্থা করছেন।
বারুইপুরে ফিরতে বাস ধরার ভিড়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার কর্মী অর্পিতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বললেন, “এটাই নিত্যদিনের ছবি।”
|
“রিপোর্ট পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব। শহরের যে সব মোড়ে বাস পাওয়া যায়নি, সেখানে কোন কোন নিগমের বাস যায়, কী কী অসুবিধা, সে বিষয়ে খোঁজ নেব।”
মদন মিত্র, পরিবহণমন্ত্রী |
|
“জ্বালানির খরচ বেড়েছে, কিন্তু ভাড়া বাড়েনি। তাই অনেকেই রাতের দিকে বাস চালাচ্ছেন না।”
তপন বন্দ্যোপাধ্যায়, নেতা,
জয়েন্ট কাউন্সিল অফ বাস সিন্ডিকেটস |
|
“যত চালাব, তত ক্ষতি। তাই অফিস-টাইম ছাড়া বাস প্রায় চলছেই না।”
অবশেষ দাঁ, নেতা,
মিনিবাস অপারেটর্স কো-অর্ডিনেশন কমিটি |
|
|
শহরে বাস কার কত |
রাত ৯টা-১১টা |
ব্যস্ত সময়ে |
মিনিবাস |
৪০০ |
১৮০০ |
সাধারণ বাস |
২০০ |
৩৫০০ |
সিটিসি |
১০০ |
২০০ |
সিএসটিসি |
১৭৫ |
৩০০ |
ডব্লিউবিএসটিসি |
৬০ |
৮০ |
সূত্র: জয়েন্ট কাউন্সিল অফ বাস সিন্ডিকেটস,
মিনিবাস অপারেটর্স কো-অর্ডিনেশন কমিটি ও পরিবহণ দফতর। |
|
ছবি: রণজিৎ নন্দী, সুব্রত রায় ও শৌভিক দে।
প্রতিবেদন: কুন্তক চট্টোপাধ্যায়, শুভাশিস ঘটক, কাজল গুপ্ত ও শান্তনু ঘোষ। |