‘বড়’দের জন্য শিল্প সম্মেলনের পরে ‘ছোট’দের জন্য বাণিজ্যমেলা।
কলকাতা ও হলদিয়ায় দু’দফায় ‘বেঙ্গল লিডস’-এর আসর বসিয়েও বড় শিল্পে খুব একটা লগ্নি টানতে পারেনি পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এ বার ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পে বিনিয়োগ টানতে বেঙ্গল লিডসেরই ধাঁচে ‘বিজনেস কনক্লেভ’-এর আয়োজন হচ্ছে। সব কিছু ঠিকঠাক চললে সেপ্টেম্বরের গোড়ায় বাইপাসের ধারে মিলনমেলা প্রাঙ্গণে বসবে ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের ওই সরকারি সম্মেলন, যার উদ্বোধন করবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পাঁচ দিনের মেলার উদ্যোক্তা রাজ্যের ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প দফতর। মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং এই দফতরের দায়িত্বে।
বস্তুত পশ্চিমবঙ্গের শিল্পক্ষেত্রে এখন বড় বিনিয়োগ বলতে গেলে প্রায় কিছুই হয়নি। বেঙ্গল লিডসের মঞ্চেও সে ভাবে তাবড় কোনও শিল্পসংস্থার উপস্থিতি নজরে আসেনি। এ হেন লগ্নি-খরার জন্য পরিকাঠামোর অভাব কিংবা প্রশাসনিক লাল ফিতের দিকে যেমন আঙুল উঠছে, তেমন মমতা সরকারের জমি-নীতিকেও দায়ী করছে শিল্প-বাণিজ্য মহলের একাংশ। সরকার অবশ্য তা মানে না। বরং প্রশাসনের কর্তাদের দাবি: এ রাজ্যে বড় শিল্পে বিনিয়োগ আকর্ষণের দিকে সরকার যথোপযুক্ত নজর দিচ্ছে।
একই ভাবে এ বার ক্ষুদ্র-কুটিরশিল্পের বিকাশেও সরকার সমান গুরুত্ব আরোপ করতে চায় বলে জানিয়েছেন প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা। প্রসঙ্গত, মুখ্যমন্ত্রী নিজেও বৃহতের সঙ্গে ক্ষুদ্রের তফাত করতে নারাজ। এমনকী, গান-কবিতা-নাটকের মতো শিল্পকলাকেও তিনি ‘শিল্প’ হিসেবে মানেন। মহাকরণের অন্দরের ইঙ্গিত, ভারী কল-কারখানার মতো ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পেরও যথাযথ উন্নয়নে তিনি সমান জোর দিতে চাইছেন। তাঁর প্রশাসনের কর্তারাও বলছেন, রাজ্যের কুটিরশিল্প মোটেই হেলাফেলার নয়। এখানে বহু টাকা খাটে, বহু মানুষও একে আঁকড়ে বেঁচে রয়েছেন। “পশ্চিমবঙ্গের হস্তশিল্পে নতুন রূপটান ভিন রাজ্যকেও পথ দেখাচ্ছে। এখন বিশ্ব-বাজারের নজর কাড়তে ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পকে সরকার অগ্রাধিকার দিতে চায়।” মন্তব্য এক কর্তার।
আর তারই বার্তা দিতে এই বাণিজ্যমেলার উদ্যোগ বলে প্রশাসনের দাবি। কুটিরশিল্প দফতরের কর্তা বলেন, “একাধিক ব্যাঙ্ক ও ঋণদাতা সংস্থা মেলায় স্টল দেবে। হস্তশিল্পের সঙ্গে জড়িত সমবায়গুলোকে সুযোগ দেওয়া হবে প্রদর্শনের।” কী হবে সেখানে? উদ্যোক্তারা জানাচ্ছেন, রাজ্যে ছোট শিল্পের বিস্তারে সরকার, লগ্নিকারী ও বিভিন্ন ব্যাঙ্কের কর্তৃপক্ষকে এক মঞ্চে বসিয়ে নানা সমস্যার দ্রুত সমাধানের পথ খোঁজাই হবে বাণিজ্যমেলার মূল উদ্দেশ্য। কুটিরশিল্প-সচিব রাজীব সিংহের কথায়, “এখানে বিনিয়োগকারীরা সরকারের থেকে কী সাহায্য পেতে পারেন, এবং সরকার তাঁদের থেকে কী আশা করে, আলোচনায় সেটাই স্পষ্ট করার চেষ্টা হবে কনক্লেভে। এই শিল্পের ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও একটা সম্যক ধারণা পাওয়া যাবে।” মহাকরণের খবর: এ রাজ্যেও মাঝারি শিল্পকে ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প দফতরের অধীনে আনার তোড়জোড় চলছে। এখন সেটি ভারী শিল্পের আওতায়। এক শিল্প-কর্তা বলেন, “ওড়িশা-গুজরাত-মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্য আগেই মাঝারি শিল্পকে ভারী থেকে আলাদা করেছে। দেরিতে হলেও পশ্চিমবঙ্গ সেই পথে হাঁটতে চাইছে।”
ক্ষুদ্রশিল্পের পরিকাঠামো উন্নয়নে রাজ্য কী পদক্ষেপ করছে, মিলনমেলার প্রস্তাবিত বাণিজ্য সম্মেলনে সে তথ্যও পেশ করবেন সংশ্লিষ্ট আধিকারিকেরা। কুটিরশিল্পের এক কর্তা বলেন, “হাতের কাজে আমাদের শিল্পীরা এগিয়ে থাকলেও বিপণনে রাজ্য পিছিয়ে পড়ছে। খোলা বাজারে উপযুক্ত দাম পাচ্ছেন না শিল্পীরা। সরকার কী প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে পারে, কনক্লেভে তা জানানো হবে।” দফতরের এক কর্তার বক্তব্য, “ঋণদানে গড়িমসির অভিযোগ হামেশাই আসে। ঠিকঠাক নথি জমা দিয়েও ঋণ না-মেলার অভিযোগ বিস্তর। আবার ব্যাঙ্কের নালিশ, অনেক সময়ে ঋণ ঠিক মতো শোধ হয় না। দু’পক্ষকে মুখোমুখি বসিয়ে মীমাংসা খোঁজার চেষ্টা হবে।”
কিন্তু ক্ষুদ্র-কুটিরশিল্প বিস্তারের জন্য প্রয়োজনীয় জমি কী ভাবে মিলবে? প্রশাসনের কর্তাদের অবশ্য দাবি, জমি নিয়ে সমস্যা হবে না, সরকারের হাতে থাকা জমিতেই ক্ষুদ্র-কুটিরশিল্প ইউনিট স্থাপন করা সম্ভব। তবু কেনা জমির চরিত্র বদল ও মিউটেশন সংক্রান্ত নানা অভিযোগ প্রায় রোজই জমা পড়ছে মহাকরণে। তার সুরাহায় ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প দফতর ইতিমধ্যে হাওড়ায় একটি ‘সেল’ গড়েছে বলে জানিয়েছেন কর্তারা।
সব মিলিয়ে রাজ্যের ক্ষুদ্র-কুটিরশিল্পের দিকে লগ্নিকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণে সেপ্টেম্বরের বাণিজ্যমেলায় চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখা হবে না বলে উদ্যোক্তাদের ঘোষণা। তাঁরা বলেছেন, ছোট শিল্পের হাত ধরার জন্য রাজ্যের বণিকসভাগুলোকে এতে সামিল হতে আহ্বান জানানো হয়েছে। রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দফতরও ওখানে স্টল দেবে।
কিন্তু যাদের সঙ্গে ক্ষুদ্র-কুটিরশিল্পের কোনও সম্পর্ক নেই, তারা কেন মেলায় থাকবে?
এক শিল্প-কর্তার ব্যাখ্যা, “যোগ না-থাকা সত্ত্বেও পানাগড়ে মাটি উৎসবে একাধিক দফতর স্টল দিয়েছিল। আসলে অনুষ্ঠানের জাঁক বাড়াতেই তাদের ডাকা হচ্ছে।”
|