গুজরাতকে হিংসা নয়, আমরাও ঐতিহাসিক
শিল্প আর শিল্পকলার মধ্যে কোনও ফারাক নেই তাঁর কাছে। তাই শিল্প সম্মেলনের মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি অনায়াসে বলতে পারেন, “এ বারে একটা গান হোক। কে কে গান শোনাবে? আমি জানি ধানুকা সাহেব পারেন।”
খোদ মুখ্যমন্ত্রীর ডাক সি কে ধানুকা এড়ান কী করে! সুতরাং তাঁকে মঞ্চে উঠতে হল। “সা রে গা মা পা... সঞ্জীব আপনিও আসুন।” সঞ্জীব গোয়েন্কাও এলেন। ‘সারেগামা’-র কর্ণধার হিসেবে ‘গোটা সঙ্গীত দুনিয়ার মালিক’ তো তিনিই। সবাই মিলে গান ধরলেন: যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে...। থুড়ি ‘তোমার’ ডাক শুনে। পাছে মুখ্যমন্ত্রীর অসম্মান হয়, তা-ই বোধহয় রবীন্দ্রনাথকেও পাল্টে নিলেন গায়করা। তবে মুখ্যমন্ত্রীর ডাক শুনে শিল্পজগতের রথী-মহারথীরা কেউ আসেননি। তাই হলদিয়ায় ‘বেঙ্গল লিডস’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সমাপ্তি সঙ্গীতটা আক্ষরিক অর্থেই প্রতীকী হয়ে রইল।
ক’দিন আগেই অবশ্য ওই শিল্প মহারথীরা সাড়া দিয়েছিলেন আর এক মুখ্যমন্ত্রীর ডাকে। ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’ সম্মেলনে নরেন্দ্র মোদীকে ঘিরে বসেছিল চাঁদের হাট। গুজরাতের সাফল্য অবশ্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, খুব বড় ব্যাপার কিছু নয়। কারণ, মোদীর রাজ্যকে ৩৪ বছর সিপিএমের অপশাসন সহ্য করতে হয়নি। বরং বাংলা যেটুকু পেরেছে, সেটা সত্যিই কৃতিত্বের। কারণ, পরিবর্তনের দেড় বছরেই অনেক কিছু করে দেখিয়েছে তাঁর সরকার। এহেন ব্যাখ্যা শুনিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর (হলদিয়া ডেভেলপমেন্ট অথরিটি-র পোস্টারে অবশ্য তিনি ‘জননেত্রী’) মন্তব্য, “গুজবে কান দেবেন না। অন্যকে হিংসাও করবেন না।”
‘একলা চলো’ গান ধরলেন সি কে ধানুকা। সঙ্গে রয়েছেন সঞ্জীব গোয়েন্কা,
সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। ছবি: সুদীপ আচার্য
কিন্তু হলদিয়ায় ‘বেঙ্গল লিডস’-এর আসরে (মমতার কথায় যা ঐতিহাসিক) মোদী-রাজ্যের কথা কেন? কারণ, শিল্পমহল বারবারই এ রাজ্যের সঙ্গে তুলনা টানে গুজরাতের। কারণ, মোদী-রাজ্য লাগাতার উন্নয়নের রথ ছুটিয়েছে, লগ্নি টানার জন্য ঝাঁপিয়েছে এবং সফল হয়েছে। তার পাশে কোথায় পশ্চিমবঙ্গ? এই হাহাকার এ রাজ্যের শিল্প মহলে বারবারই ধ্বনিত হয়েছে। মমতা অবশ্য মনে করেন, এ সবই আসলে সংবাদমাধ্যমের একাংশের অপপ্রচার। সে কথা এ দিন স্পষ্ট করে বলেওছেন তিনি। কিন্তু সেখানেই থেমে যাননি। বক্তৃতার প্রথম পনেরো মিনিট ধরে বুঝিয়েছেন, গুজরাত কেন গুজরাত। তার পর বাকি সময়টা ধরে বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গ কেন পশ্চিমবঙ্গ।
মুখ্যমন্ত্রীর সামগ্রিক বক্তব্য শুনে শ্রোতাদের অনেকেরই মনে হয়েছে, চনমনে যেন এ রাজ্যই! পিছিয়ে বরং গুজরাত! অনাবাসী শিল্পপতি প্রসূন মুখোপাধ্যায় যেমন বললেন, “গুজরাতে দু’বছর অন্তর শিল্প সম্মেলন হয়! এ রাজ্যে তো প্রতি বছর!”
মমতা এ দিন বলেন, পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে গুজরাতের অবস্থার কোনও তুলনা হয় না। না অবস্থানগত ভাবে, না পরিকাঠামোগত ভাবে, না অর্থনীতিগত ভাবে। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য গুজরাতে জনসংখ্যা যেমন কম, তেমনই কম জনসংখ্যার ঘনত্ব। অথচ জমির পরিমাণ এ রাজ্যের চেয়ে অনেক বেশি। গুজরাতে ১৭টি বন্দর রয়েছে। ৩৪ বছরের বাম আমলের মতো বিপুল করের বোঝা তাদের উপর নেই! এ রাজ্যের মতো সুদের টাকাও গুনতে হয় না তাদের।
রাজনীতি ও কর্মসংস্কৃতি? আবার উল্টো ছবি। এখানে কথায় কথায় বন্ধ, রাস্তা অবরোধ। গুজরাতকে সেই দুর্ভোগ পোহাতে হয় না। ভোটের সময়েই শাসক-বিরোধীরা শুধু লড়াই করেন। বাকি সময় রাজ্যের উন্নয়নেই মাথা ঘামান। মুখ্যমন্ত্রীর কটাক্ষ, “এখানে বামেরা যাঁরা এত গুজরাত গুজরাত করছেন, তাঁরা কেন এ সব কথা বলছেন না? চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম।”
কিছু সংলাপ
এক্সেলেন্ট মোমেন্ট! ইনসাইড অ্যান্ড আউটসাইড অনেকে এসেছেন।
এক শ্রেণির সংবাদমাধ্যম বাংলায় থেকে গুজরাতের হয়ে ওকালতি করে।
পশ্চিমবঙ্গের শিল্প নিয়ে বাজে গুজব, বাজে প্রচার চলছে।
গুজবে কান দেবেন না। অন্যকে হিংসাও করবেন না।
কৃষি উৎপাদনে পশ্চিমবঙ্গ জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে। শিল্পে আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাবে।
সরাসরি জমি কিনুন। সরকার জমি নিতে গেলেই হাল্লাগোল্লা হয়।
সাগরে আনআইডেন্টিফায়েড বিচ পাওয়া গিয়েছে, সুন্দরবনে আফ্রিকান সাফারি হবে।
রেলের কারখানা, বিদ্যুৎ প্রকল্প, সেল-এর প্রকল্প এগুলো কুটির শিল্প?
আমি সব সময় আশাবাদী। আপনারাও ইতিবাচক থাকুন।
মমতার দাবি, এই কথাগুলো বলছে না সংবাদমাধ্যমও। “বলবে কেন? আমি তো আর সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মাইনি। রোজ টিভি চ্যানেলে নেগেটিভ প্রচার।” পশ্চিমবঙ্গকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লড়াইটা যে কত কঠিন, সেই প্রসঙ্গেই এ বার চলে যান মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যে বন্দর মাত্র দুটো। তাও কেন্দ্র ঠিক মতো ড্রেজিং করে না। সঙ্গে রয়েছে আর্থিক বঞ্চনা। মাত্র তিন বছরের জন্য সুদের উপর ছাড় চেয়েছিলেন তাঁরা। রাজ্যে হাঁড়ির হাল। কিন্তু কেন্দ্র গা করছে না। যদি সব টাকা দেনা শোধ করতেই চলে যায়, তা হলে শিল্প সংস্থাকে রাজ্য কী করে আর্থিক সাহায্য দেবে? রাজ্যের আর্থিক সমস্যার সুরাহার জন্য তিনি এ রাজ্যের শিল্প-কর্তাদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দরবার করতে যাবেন বলে জানালেন। নতুন গুজরাত বানাতে কেন্দ্রের সাহায্যের কমতি ছিল না। অবদান ছিল মমতারও!
কী রকম? যখন মমতা রেলমন্ত্রী, তখন গুজরাতে বন্দর গড়ার জন্য তিনিও সাহায্য করেছিলেন। ভুজের ভূমিকম্পের পরে যখন ‘অটলজি’-‘আডবাণীজি’ চিন্তিত কী ভাবে গুজরাতের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলা যায়, রেলমন্ত্রী হিসেবে মমতা মাত্র ১২ ঘণ্টা সময় চান। “আমি গর্বিত যে, যা চেয়েছিলাম, করতে পেরেছিলাম। এবং ত্রাণ ঠিক মতো পৌঁছেছিল।” তা না হলে ভূমিকম্প বিধ্বস্ত গুজরাত কী আর ঘুরে দাঁড়াতে পারত, মন্তব্য মমতার। গুজরাতের উন্নয়ানে তাঁর অবদানের কথা মানছে বিরোধী সিপিএমও। সূর্যকান্ত মিশ্রর কথায়, “গুজরাত সাম্প্রতিক কালে যে শিল্পে বাড়তি বল পেয়েছে, তার কৃতিত্ব এ রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর! তিনিই সিঙ্গুরের গাড়ি কারখানা গুজরাতকে উপহার দিয়েছেন!”
পশ্চিমবঙ্গ তা হলে কী উপহার পাচ্ছে? অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র ও শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এক গুচ্ছ ফিরিস্তি দিয়েছেন। কী কী করেছে নতুন সরকার, তার ফিরিস্তি। চেনা কথা, শোনা কথাগুলোই আবার বললেন কর-কাঠামো সংস্কার, স্বচ্ছ জমি বণ্টন নীতি, শ্রমদিবস নষ্ট হওয়া কমা, ই-টেন্ডারিংয়ের কথা। সে কথা শুনে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রর টিপ্পনী, “আমাদের সময়ে যে শ্রমদিবস বেশি নষ্ট হতো বলছেন, সেটা ওঁদের অবদান। আর এখনকার সরকারের আমলে শ্রমদিবস কম নষ্ট হচ্ছে বলছেন, সেটা আমাদের অবদান।” মুখ্যমন্ত্রীর বক্তৃতায়, ফের পাহাড়-জঙ্গলমহল শান্ত হওয়ার প্রসঙ্গ। জমি ব্যাঙ্ক, জমি মানচিত্র, জমি ব্যবহার নীতি তৈরির প্রসঙ্গ। দেশের চেয়ে রাজ্যের জিডিপি বেশি থাকার প্রসঙ্গ। শিল্পপতিদের সঙ্গে সরাসরি আমলাদের কথা বলিয়ে দেওয়ার চেনা চমক। যার পরেই মমতা চেনা ভঙ্গিতে বলবেন, “আমি লোককে বিভ্রান্ত করি না।”
বড় শিল্প কই? প্রশ্ন শিল্পশহরের
শিল্প মেলা হচ্ছে ভাল। তবে সবার আগে শিল্পশহরে রাজনীতির খেলা বন্ধ করতে হবে। দেখে যা মনে হচ্ছে ক্ষুদ্র শিল্পে জোর দিতে চাইছে সরকার।
সাজাহান আলি,
বাংলায় শিল্পনীতি বলে কিছু নেই। কল-কারখানা করতে হলে জমির ব্যবস্থাও করতে হবে। এই সব না করে খালি শিল্পমেলা করলে আখেরে লাভ হবে বলে মনে হচ্ছে না। শমীক ভট্টাচার্য,
নতুন সরকারের আমলে তো হলদিয়ায় কোনও নতুন কারখানা হতে দেখলাম না। যদি এই বেঙ্গল লিডস করে একটা শিল্পসংস্থাও আসে রাজ্যে, তা হলেও আমাদের লাভ। বিউটি রায়,
শিল্প এলে তো আমরাই কাজ পাব। তবে অধিকাংশই হয় সরকারি, নয় হলদিয়ার কল-কারখানার স্টল দেখলাম। নতুন বড় শিল্পসংস্থা না এলে লাভ নেই। মৌসুমী দে,
কিন্তু এত আয়োজন, এত ঘোষণা কার জন্য? রাজ্যের চেনামুখ আর গোল্ডম্যান স্যাক্স-এর সঞ্জয় চট্টোপাধ্যায় ছাড়া আর কোনও বড় শিল্পপতি বা শিল্পসংস্থা তো ছিলেন না এ দিন। এমনকী রাজ্যে বড় লগ্নির নমুনা হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী যাদের নাম নিলেন, তাঁদেরও অনেকে ছিলেন না। যেমন সেল-এর চেয়ারম্যান, যেমন এনটিপিসি-র প্রতিনিধি। মুখ্যমন্ত্রী বক্তৃতা করতে গিয়ে খোঁজ করছিলেন, এনটিপিসি-র কেউ আছেন? সাড়া এল না। মুখ্যমন্ত্রী নিজেই জানিয়ে দিলেন, আলিপুরদুয়ারে তাদের প্রস্তাব অনুমোদন করছে রাজ্য। কাটোয়া ও রঘুনাথপুরেও প্রকল্প হবে। কিন্তু ঘটনা হল, রাজ্য জমি দিতে নারাজ হওয়ায় থমকে রয়েছে কাটোয়ার তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প।
এ রাজ্যে বড় শিল্প না থাকার অভিযোগ খণ্ডন করতে যে সব দৃষ্টান্ত এল, তার বেশির ভাগই অবশ্য রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পসংস্থার লগ্নি। রাজ্যের বিভিন্ন শিল্প পার্কে ১২টি শিল্পসংস্থাকে জমি বণ্টনের চিঠি বিলোনো হল। ২৭টি সংস্থাকে দেওয়া হল ঊর্ধ্বসীমার বেশি জমি রাখার ছাড়পত্র। রেলমন্ত্রী থাকাকালীন রাজ্যে ১৩টি রেল-কারখানা গড়ার কথা বলেছিলেন মমতা। ডানকুনি, কাঁচরাপাড়া, শিলিগুড়ি ইত্যাদি অনেক জায়গাতেই কাজ চলছে বলে জানালেন। সেল-ও তাদের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রকল্প গড়ছে। এ সব কি বড় শিল্প নয়? জবাব চাইলেন মুখ্যমন্ত্রী। হলদিয়ায় সঞ্জীব গোয়েন্কার মতো অনাবাসী শিল্পোদ্যোগী প্রসূন মুখোপাধ্যায় এ রাজ্যে বিদ্যুৎ শিল্পে লগ্নি করছেন। বিদ্যুৎ ব্যাঙ্কও হচ্ছে রাজ্যে, দাবি করলেন মমতা (যদিও নিন্দুকেরা বলেন, শিল্প নেই বলেই বিদ্যুৎ বাড়তি)। মমতার প্রশ্ন, “এগুলো কি কুটির শিল্প?” তবে রাজ্যের নজর তো যে ছোট ও মাঝারি শিল্পে, তা কখনও গোপন করেনি সরকার। তালা কারখানা, আগরবাতি তৈরির শিল্পোদ্যোগীরাও তাই ভরসা করে এসেছিলেন শিল্প সম্মেলনে। যা দেখে সূর্যকান্তর সরস মন্তব্য, “বোঝাই যাচ্ছে, যাঁদের ডাকছেন, কেউ আসছেন না!”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.